রোহিঙ্গা-মুক্তির সহজ পথ

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ০৪:০৭:৩৫ বিকাল

১। মায়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা-নিপীড়নের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এদের মুক্তির কথা মুখে মুখে বললেও বাস্তবে অবশ্য করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে সবাই উদাসীন। আর তাই যখনই মায়ানমারে তাদের ওপর নির্যাতনের গজব নেমে আসে, তখনই মিডিয়ার কিছু ক্লিপ দেখে আমরা গেল গেল বলে চিৎকার করে উঠি। যখন নির্যাতনের মাত্রা কমে আসে, পত্রিকা-প্রচারমাধ্যম ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবেই এত দিন পার হয়ে এলো। তাই অনুরোধ: ফেসবুকে, ব্লগে, নিবন্ধে, সমাবেশে, মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে কলম নেড়ে, গলা ফুলিয়ে তাদের পক্ষে কিছু বলার আগে একবার, শুধু একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি সত্যি তাদের মুক্তি চান কি-না? যদি চান, তাহলে সকল রকমের ভ-ামি, লোক-দেখানো ভং ত্যাগ করে যা করণীয়, তাই করার জন্য প্রস্তুত হন এবং এগিয়ে আসুন।

২। বর্তমানের এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের জন্য যদি কিছু করার থাকে, সে এক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই আছে। তার বাইরে যারা আছেন, তারা সবাই মিলে যা করবেন, তার আওয়াজ নিজের কানের বাইরে অন্য কোথাও পৌঁছাবে না। কারণ, তা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়; হতে পারে তা আমাদের প্রতিবেশী। আমরা সাধারণ জনতা অন্য দেশের ব্যাপারে যতই চিল্লা-পাল্লা করি, তা কেউ কানে নেবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা একা যা বলবেন, তা অন্তত আন্তর্জাতিক মহলের কানে পৌঁছাবে। সে পৌঁছানোটাই বড় দরকারি বিষয়। তবে এ-ও সত্য যে, মায়ানমার দেশটি পৃথিবী থেকে এতোটা বিচ্ছিন্ন যে, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা না শুনলেও তাদের কিচ্ছু হবে না। তাহলে এ মুহূর্তে করণীয় কী?

৩। রোহিঙ্গাদের মুক্তিকামী সকল গোষ্ঠী, সকল রকমের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানাতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সেই সব মানুষরা কি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে পারবে? না, কখনোই না। এর জন্যও শেখ হাসিনার সাহায্য দরকার। অর্থাৎ কীভাবে এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়া যায়, তা শেখ হাসিনার সঙ্গে পরামর্শ করেই নির্ণয় করতে হবে। যেমন পররাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নিয়ে আসিয়ান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটিশ হাই-কমিশন, ওআইসি, জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার দ্বারস্থ হতে পারে। করণীয় নির্ধারণের জন্য মুসলিমবিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। তবে সবার আগে দেশের স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রেখেই একমাত্র দেশের বাইরের মানুষের শান্তির জন্য কাজ করা যেতে পারে।

৪। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ যে সব-সময় আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে, তা কিন্তু নয়। শুরু থেকেই তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। আর তাই দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের একাংশ বাংলাদেশে বসবাস করছে। কিন্তু মায়ানমার সরকার তাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে একেবারেই গা করছে না। তেমন কোনো লক্ষণও নেই। আবার যারা আশ্রিত, তারাও যে সবাই ধোয়া তুলসি পাতা, তাও নয়। জীবন-বাঁচানোর তাগিদে এরা সকল রকমের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অথবা বলা যায়, আমরা সুযোগসন্ধানীরা অপরাধ করতে তাদের বাধ্য করি। তারা যখন এখান থেকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যায়, তা কিন্তু এদেশের কুচক্রী মহলের হাত ধরেই যায়। বিদেশ গিয়েও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখায় না। উল্টো বুড়ো আঙুল দেখায়, ক্ষেত্রবিশেষে নিপীড়ন করে! আবার বাংলাদেশী দালালরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা রকম ব্যবসায়িক ধান্ধায় মেতে ওঠে। অসহায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বিক্রি করে করে দেয় দেশের ভিতরের এবং বাইরের নানা বেশ্যাপল্লীতে। সে-সবও না হয় মানা যেত, যদি কার্যকরভাবে মায়ানমার সরকার তাদের ব্যাপারে কিছু করার জন্য আগ্রহী হত। তাতো হচ্ছে না, ভবিষ্যতেও হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার আগে সমস্ত ফাঁক, বর্ণিত ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে।

৫। রোহিঙ্গা সমস্যা দেশের বাইরের, কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশেও নানা ধর্মের সংখ্যালঘু রয়েছে। যদি সত্যি সত্যি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাই, তাহলে ভেতরের সংখ্যালঘু, তা যে ধর্মেরই হোক, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং অবশ্যই বিনা শর্তে। এদের মানবিক ও নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে দেশের অভ্যন্তরস্থ সংখ্যালঘুদের সমর্থন আদায় করে নিতে পারলে তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণ্যযোগ্যতা পাবার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া আমরা বাঙালিরা/ মুসলিমরা একা তা করতে গেলে এর আওয়াজ এক মুসলিম সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কারো দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না। অন্য কেউ তা গুরুত্ব দিতে চাইবে না। আবার তাও সম্ভব হবে কি-না, এরও তো কোনো গ্যারান্টি নেই।

৬। ইতিহাস বলে, এ-যাবৎকাল রোহিঙ্গাদের যতটা যোগাযোগ অ-আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ততটা কোনোভাবেই ছিল না। রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচিতি ব্যবহার করে অন্তত মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চলত। এর সদ্ব্যবহার কতটুকু হত, তা তো সবার চোখের সামনেই। সেই সব অর্থ বিপথগামী নানা গোষ্ঠীর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এই সব গোষ্ঠী রহস্যজনক কারণে আওয়ামী লীগ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। তাই যারা রোহিঙ্গাদের মুক্তির প্রতি উৎসাহী, তাদেরকে এ-বিষয়গুলো তীব্র নজরদারিতে রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য আনীত কোনো অর্থই যেন অসমীচিন পথে ব্যবহার না হতে পারে, তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। আর যাই হোক, বর্তমানে রোহিঙ্গা বা তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর কোনো আচরণ আওয়ামী লীগের কাছে সন্দেহজনক হলে চলবে না। এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে।

৭। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরে যে সশস্ত্র তৎপরতা রয়েছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। যে দেশের সাধারণ নাগরিকত্ব আছে, সে দেশে বসবাস করেও তো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যুৎ করা যায় না। সেখানে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বহীনভাবে তা করে সুবিধা করবে কীভাবে? তাদের সশস্ত্র তৎপরতা মায়ানমারের অভ্যন্তরে তো কোনোভাবেই চলবে না। তারা যতবারই কোনো অপারেশন চালিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মায়ানমার সরকার শত গুণ বেশি নিপীড়ন চালিয়েছে। অথচ লাভের লাভ কিছুই হয় নি। আবার তাদের সশস্ত্র তৎপরতা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ বা ভারত কোনোভাবেই মেনে নেবে না। কারণ, এতে এ দুই দেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হতে পারে। তা এ দুটি দেশ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।

৮। রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোকে যুগোপযোগী আত্মশক্তি অর্জনের সাধনা করতে হবে। এর একমাত্র উপায় যুগোপযোগী আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা। যে-সব রোহিঙ্গারা দেশের বাইরে আছেন, তারা যদি নিজ জাতির মুক্তি চান এবং রোহিঙ্গা সমর্থক গোষ্ঠীও যদি তাদেরকে কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে চান, তাহলে হতভাগা এই জাতিটির শিক্ষার বিষয়ে সকল রকমের উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মকেন্দ্রিকতা বা অন্ধতার শিক্ষা নয়। যে শিক্ষায় তারা নিজেরা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মতামত আদান-প্রদানে সক্ষম হবে, সে মানের শিক্ষা। পথটা অনেক বন্ধুর, কঠিন এবং অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি। জঙ্গিবাদী নানা চিন্তা বাদ দিয়ে রোহিঙ্গারা যত দ্রুত তা বুঝতে সক্ষম হবে, ততই মঙ্গল। তাদেরকে বোঝানোর জন্য রোহিঙ্গা-হিতাকাক্সক্ষী বাঙালিরা এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি জাতিকে দীর্ঘমেয়াদে প্রস্তুত করা যেমন কঠিন, হঠকারী চিন্তা মাথায় নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেওয়া ও স্বজাতিসহ অন্যদের বিপত্তি তৈরি করাই ততই সহজ।

৯। রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দরদ একটু বেশি। এটা মন্দ নয়। কিন্তু তারা যদি সত্যি সত্যি রোহিঙ্গা-মুক্তি প্রত্যাশী হন, তাহলে দেওবন্দি-বেরেলি-সালাফি-আলাপি সবাইকে অন্তত এই বিষয়ে নিঃশর্তভাবে এক প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতে হবে। বিষয়টি যেহেতু একান্ত মানবিক, তাই গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে পড়ে থাকা অদূরদর্শিতার পরিচায়ক হবে। কিন্তু এটা কি তারা বুঝতে সক্ষম হবেন? যারা এ বিষয়ে বেশি ঐক্যের জন্য এগিয়ে যাবেন, তাদের নিষ্ঠা ও এখলাসই প্রকাশ পাবে। আর হ্যাঁ, এক হওয়া মানেই নিজেদের মতো করে আন্দোলন নয়, তাদেরকে সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগের আশ্রয় ও ছায়া নিয়েই সামনে বাড়তে হবে।

১০। রোহিঙ্গা বিষয়টি বেশ জটিল এবং নজিরবিহীন করুণ। এ নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে কিছু করা যাবে না। এর সহজ ও তড়িৎ কোনো রাস্তা নেই। এর জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। নিকট ভবিষ্যতে নয়; দূর বা অদূর ভবিষ্যতের জন্য সুচিন্তিত পরিকল্পনা নির্ণয় করতে হবে। সেই পরিকল্পনা ধাপে-ধাপে বা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য বছরওয়ারি বা দশক ওয়ারি নিরীক্ষার ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু কে করবে এই কাজ? এর জন্যও দরকার সরকারি মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সহযোগিতা। এজন্যই দরকার নেতৃত্বগুণসম্পন্ন মানুষ। এখন কি পুরো দেশে এমন একজন ব্যক্তি আছেন বা কোনো গোষ্ঠী আছে, যার/ যাদের নেতৃত্বে এই নিপীড়িত মানবতার মুক্তির ব্রতটি লক্ষ-অভিমুখে এগিয়ে যেতে পারে? জানি, নেই। কসম করে বললেও এর জন্য কাফ্ফারা দিতে হবে না। তবে আমি কাফ্ফারা দিতে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি।

বিষয়: বিবিধ

১২৭০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

380207
২৭ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৩৬
কুয়েত থেকে লিখেছেন : র্দুবলের স্থান কোন জায়গায় নেই সবলেরা তামাসাই দেখেন। তাদের উচিত ছিল লড়াই করেই বেঁছে থাকা। তখন অন্যরাও গিয়ে তাদের সাথে যোগ দিতে পারতো। প্রতিবেশীদের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। তারা তা করবেনা কারন ভারত যদি নারাজ হয়ে যায়..? আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
৩০ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৯
314744
রওশন জমির লিখেছেন :
লড়াই তো ওরা করছেই, তবে বেঁচে থাকার নয়; মরে যাওয়ার। এপর্যন্ত লড়াই করে ওরা কোনো সুবিধা করতে পারে নি।

প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব আছে বটে। তবে নিজে বাঁচলে বাপের নাম!
ধন্যবাদ।
380229
২৭ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:৫৪
স্বপন২ লিখেছেন :


হাসিনা বক্তব্য,রোহিঙ্গাদের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের আশ্রয় ও ছায়া নিয়েই সামনে বাড়তে হবে।হূম!!




৩০ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:১২
314745
রওশন জমির লিখেছেন :
দেখুন, চিন্তা করুন। সমস্যার শুরু ৬২ সাল থেকে, তাও সামরিকভাবে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন প্রথম ৯৬-তে। এর আগে তো কত সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে!

ধন্যবাদ,

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File