তুর্কি অভ্যুত্থান এবং ফতহুল্লাহ গুলেন
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২০ আগস্ট, ২০১৬, ০৮:২৬:৪০ সকাল
১। নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে কোনো রকমের অবৈধ অভ্যুত্থান গণতন্ত্রপ্রেমী বিবেকবাক সকল মানুষকেই আহত করে। এবারে তাই বৈশ্বিক গণতন্ত্রচর্চার অংশীদার তুরস্কে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে অনেকেই স্তম্ভিত। আবার অভ্যুত্থানের ব্যর্থতায় তাদের স্বস্তির কথাও জানা যায়। অবশ্য মেকি মানবতাবাদীরা এতে আশাহত। চোখ লজ্জার কারণে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছেন না। উল্টো পিঠও আছে! পৃথিবীর নানা (মুসলিম) দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর লেজ ধরে এগুতে চায়। ০১/১১ এর সন্ত্রাসী আক্রমণ পর্যন্ত এ রকম অসংখ্য নজির রয়েছে। সে-সব স্ববিরোধী মাসিকতার লোকজন, যারা এবারে ইসলামপন্থী এরদোয়ানের সমর্থক, তারা সেনাবাহিনীকে তুলোধুনা করেছেন। সুদানের হাসান তুরাবি সামরিক বা স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে যখন হাত মেলাতেন, তখন এদের কাছে তা ছিল কৌশল মাত্র, তাই এতে তাদের কোনো আপত্তি-অসম্মতি প্রকাশ পেত না। পাকিস্তান পর্বে আইয়ুবশাহী বা যুদ্ধকালীন ইয়াহইয়া-ফরমান আলীর সঙ্গে এদের সখ্যতা ইতিহাসের অকাট্য অংশ। ৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারেও এরা অনেক স্বস্তিবোধ করেছে। সে যাক, এবারে এরদোয়ানের পক্ষে যেহেতু গণতান্ত্রিক যুক্তি আছে, তাই এবারে এ পক্ষ নেওয়ায় দোষ নেই।
২। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কোনো রকমের অভ্যুত্থান-চেষ্টা অমার্জনীয় অপরাধ। সামরিক অভ্যুত্থান মানেই হলো প্রচণ্ড রকমের রক্তক্ষরণ। সাম্প্রতিক ব্যর্থ এই অভ্যুত্থানেও যে রক্তক্ষরণের সামান্য সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, তা গা শিউরে উঠার মতো। সফল হলে এরা যে সিসিকেও ছাড়িয়ে যেত, তা আর বলতে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে সামান্য চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে দেখা যায় যে সব জেনারেল বা সেনা-কর্মকর্তা এই অভ্যুত্থানে সম্মতি দেন নি, বিদ্রোহীরা তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। শতাধিক সেনাসদস্য মৃত্যুর যে খবরটি পাওয়া যাচ্ছে, তারা সহকর্মী বিদ্রোহীদের হাতেই জীবন দিয়েছেন। এ ছাড়া আরো শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন সেনা-ট্যাঙ্কের নিচে চাপা পড়ে। তিন হাজারের মতো মানুষ গুরুতর আহত। তুর্কি পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরদোয়ানের হত্যাচেষ্টাও চলে। এ ছাড়া আরো অনেক কিছুই ঘটেছে, যা হয়ত ভবিষ্যতে জানা যাবে। কিন্তু এর চেয়েও অবাক করার মতো বিষয় হলো, ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা ফতহুল্লাহ গুলেন বা তার প্রতিষ্ঠিত-পরিচালিত দলের সম্পৃক্তি বা সম্পৃক্তির অভিযোগ!
৩। কামাল আতাতুর্ক যখন খেলাফত রাষ্ট্র ভেঙে দিয়ে ধর্মচর্চাকে সীমিত করেন, তখন তারই একজন ধর্মপরায়ণ সহযোদ্ধা বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি জন-পরিসরে ধর্মচর্চা সচল রাখার উদ্যোগ নেন। জেল-জুলুম সহ্য করেই তিনি ধর্মীয় ঐতিহ্য ও প্রথা-প্রচলন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। সেই থেকে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা যেমন চরমভাবে বাসা বাঁধে, তেমনই নুরসির প্রচেষ্টা ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনতার মাঝে বিস্তৃত হতে থাকে। বর্তমান ক্ষমতাসীন একেপি যেমন নুরসির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তেমনই ক্ষমতার সমান্তরাল ব্যক্তি গুলেনও নিজেকে নুরসির একান্ত অনুসারী হিসাবে দাবি করেন। যদিও হঠৎ করে এবারের অভ্যুত্থানের পর বারবার অভিযোগের আঙুল গুলেনের দিকে তোলা হচ্ছে। কিন্তু কে সেই গুলেন?
৪। ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া গুলেন পারিবারিক মণ্ডলে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হন। পরিবারে তৎকালীন আলেম-ওলামার যাতায়াত ছিল। সেই শিক্ষানবিসির কালেই আল-নুর আন্দোলনের নেতা বদিউজ্জামান নুরসির রচনাবলির পাঠ নেন এবং মনে ও মননে বেশ দাগ কাটে তা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পাঠের পরিধিও বাড়তে থাকে। জাগতিক জ্ঞানতত্ত্বেও নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করেন। রসায়ন, পদার্থ, জ্যোতির্বিদ্যা, জীবনবিজ্ঞানসহ প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সংস্কৃতি ও দর্শন সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল হন। বিশ বছর বয়সেই মসজিদের ইমাম হিসাবে নিযুক্ত হন। তখন প্রায় আড়াই বছর নিরবিচ্ছিন্ন্ভাবে আধ্যাত্মিক সাধনা মগ্ন থাকেন। এরপর ইজমিরের এক জামে মসজিদে নিযুক্ত হন। তখন থেকে দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। পশ্চিম আনাদোলে ভ্রাম্যমান দায়ি হিসাবে কাজ করেছেন। তার ওয়াজ-বক্তৃতায় মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও স্রষ্টার প্রতি নিবেদনের কথা তুলে ধরেন।
৫। একই সঙ্গে মসজিদের পাশে ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টের উপস্থিত মানুষদের উপদেশ দিতেন। হাইস্কুল বা কলেজের শিক্ষার্থীরা তার ধর্মীয় আলোচনায় স্বস্তিবোধ করত। তৎকালীন ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মুখ থেকে ছাত্রদের এমন কথাও শুনতে হতো, যা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মবোধের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। ছাত্ররা এসব বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা না করেও গ্রহণযোগ্য, বিশেষত শিশু-কিশোর মনোচিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারতেন। এভাবেই তার প্রসার বাড়তে থাকে।
৬। গুলেনের পার্টির নাম তুর্কি উচ্চারণে হিজমত, যার মূল আরবি হল খিদমত অর্থাৎ সেবা পার্টি। এ পার্টির মূলনীতি রাজনীতি নয়, পরস্পরের সেবা! এই সেবার মাধ্যমেই গুলেন-ভক্তদের মাঝে পারস্পরিক দৃঢ় বন্ধনের তৈরি হয়। সম্ভবত ১৯৯০ সালের পর এ সেবা ভক্তবৃন্দকে ছাড়িয়ে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হতে থাকে। তখন তিনি সকল রকমের হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগপূর্বক বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে এবং দার্শনিক ঘারানার সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন। যা দেশের ভিতরে এবং বাইরে এক ধরনের আলোড়ন ও জাগরণের সৃষ্টি করে। কোনো রকমের গোঁড়ামিহীন উদার মানসিকতার পরিচয় পেয়ে ইহুদি রেবাইসহ খ্রিস্টানজগতের প্রধান পোপও তার সঙ্গে সংলাপে আগ্রহী হন। এভাবেই বৈশ্বিক দরবারে তার পদচারণা বাড়তে থাকে।
৭। তিনি নকশবন্দি সুফি তরিকার অনুসারী হলেও শুধু এ আনুষ্ঠানিকতার মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। প্রধানত তুর্কি এবং গৌণত বিশ্ব জনতার পথ প্রদর্শনের জন্য শিক্ষা বিস্তারের মহান উদ্যোগটি বেছে নেন। অতীতের সকল ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতাদের থেকে তার পার্থক্য হল, তিনি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের বিধি-ব্যবস্থার মাঝেও অভূতপূর্বভাবে নিজের কাজ চালিয়ে নিতে সক্ষম। তার পার্টির প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক থেকে উচ্চ পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই গুণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে এক কথায় অনন্য। এর বিস্তৃতি প্রায় বিশ্বের একশো আশিটি দেশে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই তো দেড় ডজনের মতো।
৮। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রচার মাধ্যমেও নিজ অবস্থান পোক্ত করতে পেরেছেন। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ নানা রকমের প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। বিশ্বের ৩০টির মতো ভাষায় সম্প্রচারিত হয়। তুরস্কের সর্বাধিক শ্রোত, দর্শিত, পঠিত ও প্রচারিত মিডিয়া তারই ভক্তদের পরিচালিত। আরবি ভাষায় প্রচারিত হিরা পত্রিকাটি প্রতি মাসে মিশর থেকে বের হয়। যদিও এর সম্পাদনা পরিষদ ইস্তাম্বুলেই থাকেন। তিনি প্রায় ষাটটির মতো গ্রন্থের রচয়িতা, যা বিশ্বের কুড়িটি ভাষায় অনূদিত।
৯। কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক দেশে পাশ্চত্যকরণের প্রবাহ শুরু হয়। তিনি প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা না করে, অত্যন্ত সুকৌশলে এই পাশ্চাত্যকরণ প্রবণতা রুখে দাঁড়ান ধর্মের নামে নয়, তুর্কি ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে। রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে কোনো রকমের সংঘাতমূলক পথে যেতে অসম্মত তিনি। ঘোষণা দিয়ে শত্রুতা উৎপাদন না করে বা পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে তুর্কি প্রবণতার আলোকে তরুণ ও জনমানুষের মন ও মননের খোরাক যোগাতে থাকেন। মনে ছিল অগাধ বল ও আল্লাহর প্রতি নিখাদ বিশ্বাস। এভাবেই তার কাজ সফলতার মুখ দেখতে থাকে। সকল শক্তিই তার সামনে গলে যেতে থাকে।
১০। ষাট ও সত্তর দশকে তুরস্কে যখন বাম মানসিকতার প্রবল প্রতাপ, ধর্মীয় চিন্তা ও তুর্কি ঐতিহ্য ঢাকা পড়তে থাকে। অবশ্য এর আগে পঞ্চাশের দশকেও ক্ষমতাসীন সরকার ধর্ম ও আলেম-ওলেমার বিরুদ্ধে কঠিন চাপ তৈরি করেছিল। সেই জটিল সময়ে গুলেন ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হন। সেই সময় থেকেই তিনি মানুষদের নিজের দিকে টানতে থাকেন। তখন মফস্বলের সাধারণ জনতা পড়ালেখার উদ্দেশ্যে সন্তানদের শহরমুখো করতে চাইতো না, শিক্ষা বিষয়ে সরকারের গৃহীত ধর্মনিরপক্ষে নীতির কারণে। তাদের আশঙ্কা ছিল, এ শিক্ষা গ্রহণ করলে সন্তানরা ধর্মবিমুখ বা ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যেতে পারে। তখন গুলেন ছাত্রাবাস তৈরির উদ্যোগ নেন। এরপর অভিভাবকদের এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের সন্তানগণ তার আবাসে থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ততদিনে অবশ্য তিনি স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের কাছে ধর্মীয় বিষয়ে আশ্রয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। পরিবারে প্রাপ্ত ধর্মবোধের সাথে কোনো বক্তব্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তিনি সমাধান দিতেন। এভাবেই সাধারণ জনতার আস্থা তার প্রতি বাড়তে থাকে।
১১। হিজমত পার্টির আওতাধীন দেশের ভিতরে এবং বাইরে অসংখ্য ব্যবসায়িক পতিষ্ঠান বিদ্যমান। এসবই ওয়াকফের প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচালিত এবং সর্বত্র প্রশংসিত। এক সূত্র মতে, পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গেই তার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থের পরিমাণ ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
১২। এহেন গুলেনের সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক বা বিরোধটা কোথায়, তা এবার খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তুরস্কের সংবিধান অনুসারে ধর্মীয় রাজনীতি বা পার্টি নিষিদ্ধ। একে পার্টি এর পূর্বে ভিন্ন নামে নির্বাচিত হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর আপত্তি ও ষড়যন্ত্রের কারণে তারা ক্ষমতায় বসতে পারে নি। গুলেন/ হিজমত পার্টির সঙ্গে এরদোয়ানের পূর্বসূরীরা তখন কৌশলগত ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেন। সেই ঐক্যের হাত ধরেই একেপি ক্ষমতারোহণ করে।
১৩। একেপির ক্ষমতারোহণ যেহেতু গুলেন/ হিকমত পার্টির বদান্যতায়, তাই সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা থাকতেই পারে। আবার যেভাবেই হোক, ক্ষমতায় যেহেতু একেপি, তাই সে দল ও এর নেতাকর্মীদেরও নানা প্রত্যাশা আছে এবং থাকবারই কথা। একটা সময় পর্যন্ত প্রত্যাশাপূরণ নিয়ে হয়ত সহনশীলতা ছিল। কিন্তু যখন থেকে সেই সহিষ্ণুতার তিরোধান, তখন থেকেই বিবাদের শুরু, এবং পরিণামে বর্তমানের সংঘাত।
১৪। জানা যায়, সরকারি নানা নিয়োগে, বিশেষত বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে গুলেন-সমর্থকরা কৌশলে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু হিকমত পার্টি শুধুমাত্র খানকাহকেন্দ্রিক কোনো গোষ্ঠী নয়, একই সঙ্গে এরা ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রচার-মাধ্যমেও বেশ প্রভাববিস্তারী, তাই এগুলোকে সচল ও নির্বিঘ্ন রাখার জন্য হলেও সরকারের নানা পর্যায়ে নিজস্ব মতাদর্শের লোক দরকার। এজন্যই হযত গুলেনপন্থীরা এজন্য চেষ্টা করে থাকেন।
১৫। সামাজিক-ব্যবসায়িক ও প্রচারকেন্দ্রিক বিস্তৃত পরিসরে একেপির হয়ত তেমন পরিকল্পিত অবস্থান নেই। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর তাদেরও চোখ পড়ে যে, তারা এ বিষয়ে তুলনামূলক পিছিয়ে। উপরন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে হিকমতের স্থিতাবস্থা মানে একেপির সে এক-ই শূন্যতা। তাই এ-পর্যায়ে এসে গুলেনপন্থীদের ছাড় দিতে সম্মত হয় নি।
১৬। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, প্রচার মাধ্যম ও সাংস্কৃতিক জগত যেহেতু গুলেনপন্থীদের হাতে, তাই সেগুলোতে সরকারের প্রত্যাশিত উপস্থিতি না থাকারই কথা। এগুলো গুলেনের গুণকীর্তন না হোক, নিন্দা-মন্দ করে না। অন্যদিকে সরকারের নেতিবাচক কর্মকা-ের বেলায় সরব ভূমিকা পালন করে। এভাবেই হয়ত সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হয়।
১৭। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে ধারাবাহিক তিনবার ক্ষমতারোহণের পর একেপির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তারা এক সময়ের জোট শরিকদের অবহেলা করতে থাকে। নিজেদের গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে গুলেন-পন্থীদের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধে।
১৮। গুলেন সুফিবাদী লোক। উপরন্তু তিনি তুরস্কের মিডিয়া মোগল হয়ে আড়ালতা-প্রবণ এবং খ্যাতির প্রতি অনীহ। তাই হতে পারে এবারের অভ্যুত্থানে তিনি সরাসরি জড়িত নন, অবহিতও নন। তিনি একটি লেখায় সে রকমই বলেছেন। তবে তার ভক্তবৃন্দের থেকে উচ্চ পর্যায়ের লোকজন, যারা খুব ক্ষতাশালী, তারা অভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এমতাবস্থায় গুলেনের বক্তব্য বা অবস্থান কী? পৃথিবীর ইতিহাস বলে, জগদ্বিখ্যাতরা ভক্তদের অপরাধের বেলায় একেবারে অন্ধ। এরা মোসাহেবদের কথায় যতটা ইমান রাখে, অন্য কারো প্রতি নয়। না, এখানে গুলেন ব্যতিক্রম হিসাবে নজির তৈরি করলেন। তিনি যারা এ অভ্যুত্থানে জড়িত, তাদের তার আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করলেন!
২১। কূটনৈতিকপাড়ার গুঞ্জন হলো, এটি এরদোয়ানের সাজানো। প্রমাণ, ঘটনার পরপর লিস্ট ধরে, যা আগেই করা ছিল, গুলেনপন্থীদের চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ। শুধু সামরিক বাহিনীর লোকদের নয়, বেসামরিক লোকদেরও, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। উদ্দেশ্য, যেনতেন প্রকারে গুলেনকে কুপোকাত করা। এতে লাভের খাতায় অনেক কিছুই যোগ হবে। বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ইসলামি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার গোড়া কেটে দেওয়া। উপরন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সকল প্রতিষ্ঠান আস্তে আস্তে একেপির হস্তগত হবে, যা তাদের সংহতকরণের কাজে লাগবে।
২২। ক্ষমতায় যেহেতু এরদোয়ান। আবার আইসিসের কারণে তুর্কি সাহায্য ন্যাটো ও আমেরিকার বিশেষ প্রয়োজন। তাই এরদোয়ানের ইচ্ছামতো তারা হয়ত সাড়া দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু যত সংহতই হোক, হাজার হাজার দক্ষ যোগ্য মানুষদের চাকরিচ্যুতকরণ দেশকে দুর্বল করে তুলবে। তাই আজ না হোক পরে হলেও একেপির বড় রকমের খেসারতের আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।
২৩। হতে পারে, হিকমত পার্টি নয়; অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন বা ইজরাইল জড়িত। কারণ, চাঁছাচোলা এরদোয়ানকে দিয়ে তাদের কার্যোদ্ধারে ব্যঘাত হয়। তাই নানা ভাবে ফুসলিয়ে লোভী জেনারেলদের অভ্যুত্থানে রাজি করানো গেল। উদ্দেশ্য, সরকারকে এতোটা নাড়িয়ে তোলা যেন ক্ষমতার লোভে হলেও আমেরিকার তল্পিবাহক হতে বাধ্য হয়।
২৪। এরেদোয়ান নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তটি সুবর্ণপ্রসূ তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। আমরা ততদিন অপেক্ষ করতে রাজি আছি।
২৫। শেষকথা হল, গুলেন-এরদোয়ানের সঙ্কট কি মুসলিম মানসিকতার সঙ্কট না ধর্মবোধের সঙ্কট, যত তিক্তই হোক, এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারলে ভবিষ্যত পথচলায় সুবিধা হবে। কারণ, অতীতের অনেক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান যেমন ধর্মের নামে, ধর্মের দোহাই দিয়ে শাসন করতে গিয়ে বিস্তর সীমালঙ্ঘন করেছেন, তেমনই মুসলিম ধর্মপুরুষ, ধর্মতাত্ত্বিকরাও বাস্তবতা অনুধাবন না করে একরোখা নীতি-ব্যবস্থা ধর্মের নামেই ভক্ত জনতার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই চাপচাপি আর সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারটুকু নির্মোহভাবে চিহ্নিত করা দরকার এবং এই মুহূর্তেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।
বিষয়: বিবিধ
১০৫২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু কাজটা সহজসাধ্য নয়!
করবে টা কে!!!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
আপনাকে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন