শিশুহত্যার এই দেশে...
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ১৬ মার্চ, ২০১৬, ০৯:০৭:৪৯ রাত
শিশুবিক্রির ক্ষতটি অনেক পুরনো হলেও নৃশংসভাবে শিশু হত্যার ধারাবাহিক এই ঘটনাগুলো একেবারেই সাম্প্রতিক এবং অবশ্যই ভয়ঙ্কর। কিন্তু নতুন হলেও আকারে-প্রকারে বুঝতে বাকি থাকে না যে, তা এক দূরগামী ভীষণ অশনি সংকেত।
গ্রামে-গঞ্জে, মফস্বলে বিবাদ-বিসংবাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্কদের সেই রেষারেষি শিশু-কিশোরদের পর্যন্ত সাধারণত গড়াতো না। এমনও হয়েছে, সকাল বেলায় এ-পাড়া আর ও-পাড়ার প্রবীণরা টেঁটা-বল্লম নিয়ে মাঠে লড়াই করেছে। বিকালে সেই মাঠেই দুই পাড়ার শিশু-কিশোর একসঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে! অথচ আজ হল কী যে, শিশুরা দূরের বা ও-পাড়ার পিতৃশত্রু নয়, ঘরের কাছের তথাকথিত আপনজনের কাছেও নিরাপদ নয়। এমন কি ঘরেও তো তাদের নিরাপত্তা নেই, মনে হচ্ছে!
আর তাই দেখতে হল যে, চাচার হাতে, মামার হাতে, নানার বাসায়; এমনকি মায়ের হাতেও সন্তান খুন একেবারে অভাবিতভাবে, ঠান্ডা মাথায়। এই শীতলতার প্রকোপ এতোই বেশি যে, সন্তান হারিয়ে পিতার মাঝেও কোনো ভাবান্তর তৈরি হয় না। মর্গে সন্তান রেখেই পিতা-মাতা দু-জনে গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা হন। না, চোখের পানিও ঝরতে দেখে নি কেউ। এজন্য পিতা মামলা করতেও আগ্রহী নন। প্রশ্ন হলো, কেন এমন হচ্ছে? সামনে কি তা আরো হতে থাকবে? না, সমাজ-ভাবুকদের মনে এ ধরনের প্রশ্ন জাগে না। কারণ, সবার মন-প্রাণ এখন ভোঁতা, একেবারে ভোঁতা।
যে শিশু ভবিষ্যত স্বপ্নের আধার, একান্ত আশার আশ্রয়, তাদের ব্যাপারে হঠাৎ করে মানুষের চিন্তা ও আচরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। আর তাই কি বড়দের পোষিত-লালিত ক্ষোভের দায়ভার তাদের ঘাড়েই পতিত হচ্ছে বারংবার? তা না হলে এমন কি সূত্রের উদ্ভব হল বা মনোবিকারের পরিস্থিতি তৈরি হল, যা মানুষকে নিজের সন্তানের ব্যাপারেও বোধ-বিবেকহীন করে তোলে? খুব সাবধানে এবং সক্রিয়ভাবে এর তত্ত্ব-তালাশ করতে হবে। এবং পদক্ষেপও নিতে হবে দ্রুত এবং সম্মিলিতভাবে। না হলে সমূহ বিনাশের প্রতীক্ষা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।
স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য আবহমান কাল ধরেই হয়ে আসছে। তবুও সন্তান ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ। বিবাহকেন্দ্রিক সামাজিক যে বন্ধন, এতো শুধু জৈবিক প্রবৃত্তি ও চাহিদাপূরণের নিমিত্ত মাত্র নয়। অবচতেনভাবে মানুষের মনে প্রজনন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা এবং অন্তিম জীবনের নিরাপত্তাটাও জাগরুক থাকে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে। এখন তাহলে বৈধ পথের সেই সন্তানকে কেন গলা টিপে মারার উৎসব শুরু হল? স্বামী-স্ত্রীর সামান্য খুনসুটিতে নিজেদের খুন ঝরানোর এ কেমন দুর্মতি?
ধর্মবোধ কমে গেছে, সে বলা যাবে না। কিন্তু মর্মের কোথাও কোনো সূতো ঢিলে হয়ে গেছে বা ছিঁড়ে গেছে বোধহয়। যার কারণে বাহ্যিক আড়ম্বরতার কোনো কমতিই চোখে পড়ছে না। ধর্মও মনে হয় সেই আড়ম্বরতার আওতায়। কিন্তু কী সেই সূতো, যার ঢিলে হওয়ায় বা ছিঁড়ে যাওয়ায় জীবনবোধও পাল্টে যেতে পারে? ভাবুক সমাজ অবশ্যই তা জানেন। কিন্তু পাছে তাদেরও সংযত হতে হয়, সেই ভয়ে মুখ খুলছেন না। কিছু নয়, সে হল ভোগবাদী-পুঁজিবাদী মানসিকতার তীব্র গরল! এ গরল একবার হজম হয়েছে তো আর মুক্তি নেই। তখন পৃথিবী নামক গোলকধামে নিজের বাইরে ভিন্ন কাউকে নিয়ে ভাবনার ফুরসত তৈরি হবে না। আত্মকেন্দ্রিকতা এবং এর পরবর্তী ধাপ নিরেট আত্মসর্বস্বতা-ই তখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের তথাকথিত ভাবুক সমাজও সেই গরলের শিকার!
প্রতীচ্যের গড়নটাই বস্তুবাদের ওপর। অথচ প্রাচ্যের হয়ে ওঠা কিন্তু ভাববাদ বা আধ্যাত্মিকতাকে কেন্দ্র করে। আর তাই প্রাচ্যে ভাববাদ ত্যাগ করা মানে নিজের নাড়ির বন্ধনটুকু ছিঁড়ে ফেলা। এই ভাববাদ একান্ত প্রথাগত ধর্ম অর্থে নয়, এর চেতনা জীবনের আরো গভীরে প্রোথিত; যা স্বার্থের বাইরে মানুষকে মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে উৎসাহিত করে। ফলস্বরূপ এই প্রাচ্যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিল সমাজের উঁচু স্তরে, সবারই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। বয়োবৃদ্ধদেরকে কেউ বোঝা নয়, সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমার অংশ হিসাবেই মূল্যায়ন করত। পুঁজির পাশাখেলায় আজ গণেশ উল্টে গেছে। ময়-মুরব্বি এখন আর্থ-সামাজিক বোঝা! সেই ¯্রােত আস্তে আস্তে নিচের দিকে গড়াচ্ছে। কখনো নিজ সন্তানদেরও বোঝা মনে হচ্ছে। আর তখনই ঝেড়ে ফেলার নির্মম আচরণ!
সত্য বটে, ভাবচর্চার নানা পর্বে তা অমানবিকতার নাগপাশের রূপ ধারন করে, করতে পারে। আর তাই ইউরোপীয় আলোকায়নের সূত্র ধরে এগুলোকে আমরা প্রশ্ন করতে শিখি। মনে হয়, ইউরোপ থেকে এটিই আমাদের মস্ত পাওয়া। কিন্তু ভিন্ন জীবনাচারে অভ্যস্ত একটি জাতির সকল কিছু তো বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার শিক্ষা আলোকায়নপর্বেও নেই। যে আলখাল্লা শীতপ্রধান দেশে প্রযোজ্য, তা উষ্ণপ্রধান দেশে সমস্যা তৈরি করবে, এটা ভুলে গেলে চলবে না। আর তাই মানতেই হবে, আমাদের দৈনন্দিন প্রাচ্য জীবনের গভীরেও এমন কিছু সূত্র রয়ে গেছে, যার কর্তনে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দপতন ঘটতে পারে।
হলাহল গলাধঃকরণ যেমন শক্তিমান শিবকেও নীলকণ্ঠ বানিয়ে ফেলে, তেমনই পুঁজি নামক গরলও জীবনের রঙ পাল্টে দেয়, বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। আর পুঁজি মানে পুঁজ, যার অন্তর্চেতনা শুধু উৎকট ব্যক্তি স্বকীয়তা। অন্যের জন্য কোনো নিবেদন নয়, সামান্য দান-অনুদান নয়, চুল পরিমাণ ছাড় নয়। এর শেষকথা হল শুধু আত্মসর্বস্বতা, আত্মপূজা। এদিয়ে আর যাই হোক, কোনো সমাজ চলতে পারে না। একটি রশিও যদি টিকে থাকতে চায় নানা চাপের মুখে, তখন একাধিক ক্ষুদ্র রশির সমন্বয়ে তাকে মোটা হতে হয়। প্রথাগত সামাজিক বিন্যাসের পরতে পরতে পরস্পরে জড়িয় থাকার, সয়ে থাকার এ-ই ছিল প্রধান সুবিধা, অন্তত বেড়ে উঠার পূর্ব পর্যন্ত নব জাতকের অনন্য অবলম্বন। কিন্তু বাছ-বিচারহীন প্রতীচ্যায়ন ভেতর থেকে ক্ষয়ের সূচনা করেছে। তাই আজ একূল-দুকূল হারানোর পথে।
পুঁজির দৌড় কতটা অন্ধতা তৈরি করতে পারে, তাতো বর্তমানে গণহারে শৈশব ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখে সহজেই বোঝা যায়। তথাকথিত ইঁদুর দৌড়ের কারণে যেখানে শৈশবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, দাদা-দাদিসহ নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্ত কোটরাবদ্ধভাবে বেড়ে উঠতে হয়, সেখানে শিশুদের মনে মানবতা-বোধ জাগার সুযোগ থাকে কই? মনুষ্যত্ব ও মানবতা নয়, ভাল স্কুল, ভাল রেজাল্ট, ভাল ক্যারিয়ার- এটাই মূল লক্ষ্য। আর এসবই পুঁজিরই অনুষঙ্গ। এ-সব অনুষঙ্গের পেছনে দৌড়াতে গিয়েই মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে। এ পথের সামান্যতম বাধায় মনে হতাশা তৈরি করছে, যে হতাশা-ই হল বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ।
এখানেই মনে পড়ে সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহর অমর সৃষ্টি ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র কথা, যেখানে মোহাম্মদ মোস্তফা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই আত্মহত্যা সমাজ-বিচ্ছিন্নতার অনিবার্য ফল! তা না হলে প্রাক-ঔপনেবিশেক সময়ে যারা শিক্ষিত বলে সমাজে পরিচিত ছিলেন, সমাজের অন্য সব সদস্যের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সহজ এবং গভীর। তীব্র বেদনার কথাটি তাকে বলতেও কারো দ্বিধা হতো না। স্বজন-পরিজনের কাছে তারাও প্রাণ খুলে বলতে পারতো যে কোনো সুখ-দুঃখের কথা। আজ তো শিক্ষিত লোকই পরস্পর বিচ্ছিন্ন। অশিক্ষিত/ নিরক্ষর লোকজন তাদের শরণ নেবে কীভাবে?
প্রাচ্যে পারিবারিক বন্ধনের যে নজির ও ঐতিহ্য ছিল, এর সবটাই ফেলে দেওয়ার মতো? যৌথ পরিবারের সদস্য কোনোভাবেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ পেত না। হ্যাঁ, এতে নিজের মতো করে চলার অনেক বাধাবিপত্তি ছিল এবং এখনো আছে। আর তাই ইউরোপীয় শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিভাষা জানতে পারার নগদ প্রাপ্তির লোভ তার মনে কঠিনভাবে গেড়ে বসে। আর তাই প্রথমেই এই পারিবারিক যৌথতার বন্ধনে আঘাত হানে। এখন তো নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ! কিন্তু অণু-পরিবারে মানবের মানবতাটুকু রক্ষিত থাকার সুযোগ আছে কি-না, এনিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলে নি। এখন প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। কারণ, অণু-পরিবারের অনিবার্য অনুষঙ্গই হল বৃদ্ধাশ্রম! অথচ সেই বৃদ্ধ যখন পরিবারে অপাঙ্ক্তেয়ভাবে থাকতো, তখনো অন্তত সেই পরিবারের শিশুদের জন্য তারা বড় একটি বটগাছের মতো ছিল। নিপীড়িত বধূটি একান্তে তার কাছেই মন খুলে কিছু বলতে পারতো। এখন ‘সেই রামও নেই, তাই সেই অযোদ্ধাও নেই’।
আমাদের তাই প্রাচ্য ঐতিহ্যের অযোদ্ধা তৈরি করতে হবে। সে প্রাচীন কালের অযোদ্ধা নয়, পূর্ব-পশ্চিমের সকল উত্তম উপাদানের সাগর-সঙ্গমেই সেই অযোদ্ধার গোড়াপত্তন হবে। সেখানে কোনো নারীর কূটচালে যেমন রামকে বনবাসে যেতে হবে না, তেমনই সীতাকেও রামের ক্রীড়নক হওয়া চলবে না। সবাই পরস্পরে ঘনিষ্ট হয়ে থাকবে। সূর্পনখার আবেদনে রাম ক্ষিপ্ত হবে না, রাবণ কর্তৃক সীতাও লুণ্ঠিত হবে না। লঙ্কাও আক্রমণের শিকার হবে না। সে অযোদ্ধা কীভাবে তৈরি হতে পারে, আসুন হে প্রাচ্যবাসী, কল্পনা করি, চেষ্টা করি। নিজেদের চিন্তা চেতনা, আচার-আচরণ একান্ত আত্মকেন্দ্রিক নয়, ভবিষ্যতমুখী করে তুলি। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার জন্যই এ ভূমিটাকে সহনীয় ও বাসযোগ্য করে তুলি। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১০৪৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার এ আহবানে সহমত৷ কেউকি আছে সাড়া দেবার! হয়ত নেই, কারণ পশ্চীমা বিষ ধীরে ধীরে প্রায় সকলের মাঝেই সংক্রমিত হয়ে গেছে৷ আর সমাজপতি, তারাতো আগেই মুরিদ হয়ে বসে আছে৷ আপনার এ মূল্যবান মূল্যায়ণের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ৷
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন