ফাঁসি ও তৎপরবর্তী প্রতিক্রিয়া
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:২৮:৪১ রাত
দেশের বাইরে বাংলাদেশির সঙ্গে এক তরুণ পাকিস্তানির দেখা। বাঙালির প্রশ্ন, কেমন আছো তোমরা, মানে তোমরা পাকিস্তানিরা? পাকিস্তানি তরুণের উত্তরঃ 'একাত্তরে তোমাদের সঙ্গে যে নৃশংসতা হয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত এখন আমরা করছি নানাভাবে। মিডিয়ার মাধ্যমে তোমরা তা দেখতে পাচ্ছো।' না, সকল পাকিস্তানির বিশ্বাস এ রকম নয়। তবে তরুণদের মানসিকতা তুলনামূলক ইতিবাচক।
পাকিস্তান যে এদেশে ফাঁসি হওয়ার পরপর নানা বিবৃতি দিচ্ছে, এটা আমলে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। ওরা রাস্তায় মিছিলও করছে। তা করুক। পুরনো বন্ধুদের জন্য কিছু একটা তো করতে হয়, তাই তা করা। আবার আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক কানাঘুষা সম্পর্কে যাদের নূ্যনতম ধারনা আছে, তাদের অজানা নয় যে, অন্তত সাকার সঙ্গে পাকিদের সম্পর্ক পূর্ব থেকেই গভীর। দ্বিতীয়ত, সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি মানে একাত্তরকে খুঁড়ে তোলা, যা পাকিস্তান প্রাণপণে ভুলে থাকতে চায়। পুরনো ক্ষত কেই-বা খুঁচিয়ে বেদনার্ত হতে চায়! তৃতীয়ত, হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের দহরম-মহরম সম্পর্ক। বিরোধীদের বিচারের (বিনাশের) মাধ্যমে হাসিনার হাতই শক্তিশালী হচ্ছে, যার নীট লাভ একান্ত ভারতের। তাই থেকে থেকে একটু জানান দেওয়ার চেষ্টা, মৃতপ্রায় পাকিস্তানের গোঙানি!
পাকিস্তানের কিছু করার থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে আড়ালে-আবডালেও করতে পারতো। যেমন ধরুন, সৌদি সরকারের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে পাকসেনারা। পাকিস্তানের সদিচ্ছা থাকলে সে-সূত্র ধরেই হাসিনা সরকারকে জব্দ করার চেষ্টা করতে পারতো। তা হয় নি। সৌদি সরকারের বক্তব্যও ছিল এমন যে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরা নাক গলাবে না। শীতল কানাঘুষায় ভেসে বেড়ায় যে, গো-আজমের জন্য সৌদির সামান্য একটা রেকুয়েস্ট ছিল। তা তো রক্ষা পেলই। তা না হলে অপরাধের শিরোমণি বেঁচে যায় কীভাবে?
তুরস্কও সামান্য তৎপরতা দেখানোর চেষ্টা করেছে। আমার মনে হয়, একাত্তরের ব্যাপারে, বাংলার মানুষের চেতনার ব্যাপারে তারা অসচেতন। অবশ্য, 'একে' পার্টিও তো শেষ পর্যন্ত মোল্লাদের সমাবেশ। তাই অপরিপক্ষ বক্তব্য ও আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর বাইরে যাদের আওয়াজ শোনা যায় বা গিয়েছে, তারা বসন্তের কোকিল। টাকার বাউল বাতাস আছে তো কুহু কুহু ডাক আছে, তা না হলে, সুনসান নীরবতা। তাই কারো কুহু রবে লাফিয়ে বা তেতে উঠার খুব বেশি প্রয়োজন নেই।
সাইয়েদ কুতুব ফাঁসির পরেও বেঁচে আছেন এবং থাকবেন। কারণ, তাঁর ঘিলু ছিল। তাঁর চিন্তা, চেতনা ও তৎপরতা শুধু মিশরকে ঘিরেই আবর্তিত হত না। দেশ-কাল পেরিয়ে সুদূরের অভিযাত্রী ছিলেন তিনি। আমাদের যে কয়জনের ফাঁসি হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে, তারা বাংলার আলুলায়িত আলো-বাতাসে বড়ই কাতর ছিল। স্বপ্ন ছিল যে কোনোভাবে এর রঙ-রস চিবিয়ে খাওয়া। তা পূরণ হয়েছে। এমনকি বড় রকমের রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেলেও তাদের প্রাপ্তিতে চিড় ধরে নি। আবার দেশ-কাল অতিক্রমী কোনো বিবেক ও মেধা তাদের ছিল না। তাই বিধির বিধান তাদের এই অবিমৃষ্যতাকে মেনে নিতে পারে নি। মুখ ব্যদান করে তাদের গ্রাস করে ফেলে। এখন যা হছে, দেশে এবং বিদেশে, তা খাবারের পর ঢেকুর তোলার মতো।
একে একে ফাঁসি হতে চলেছে। যাদের পক্ষে ক্ষয়, তাদের প্রতিক্রিয়াটা একটু বেশিই হবে, কথা-বার্তায়ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হতে পারে। এ নিয়ে টেনশন করার কিছু নেই। সবচে' বড় কথা হল, দীর্ঘ দিনের আবর্জনা-জঞ্জাল সরে যাচ্ছে। তাই যারা এই বিচারের প্রত্যাশী, তাদের উচিৎ আত্ম-তৃপ্তিতে না ভোগে, গঠনমূলক কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া। বিচার পরবর্তী সময়ে দেশ যেন আত্মকলহের আবর্তে না পড়ে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকা।
একাত্তরে দেশটার উপর দিয়ে বড় একটা ধকল গেছে। সে ধকল শেষ হতে না হতে নির্বোধ ও আবাল লাল ঝান্ডার উৎপাত শুরু হয়। সোভিয়েত বলয়ের সাহায্যে পাকিস্তানের জটর থেকে বের হওয়া নতুন দেশকে আমেরিকান বলয় মেনে নিতে পারে নি। আবার পুরোপুরি কব্জায় নিতে না পেরে সোভিয়েত-ভারতেরও স্বস্তি ছিল না। অভ্যান্তরীণ শত্রু তো উঁৎ পেতে ছিলই। সকল অপশক্তির সম্মিলনে ৭৫-এর শোকাবহ ঘটনা।
এরপর তো পুরনো সেই মানবরূপী দানবদের তুমুল চিৎকার! মনে হচ্ছিল, অসুররা-ই পৃথিবীতে জয়ী হয়, স্থায়ী হয়। অনেক ঘোর পথে এসে শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে, বিধির বিধানই শক্তিমান এবং জয়ী। তবে বিধির বিধানের পথ বেশ এবড়োখেবড়ো এবং বন্ধুর। সে পথে চলার জন্যে যে অনুশীলনের প্রয়োজন, তা পূর্বে যেমন কারো ছিল না; এখনও নেই। তাই ভয় হয় মাঝে-মাঝে, শঙ্কার দোলা প্রাণে ভীষণ আঘাত করে।
না, প্রাণ হরণে কোনো কৃতিত্ব নেই। কিন্তু বিচারের বেলায় দয়ালু হলে জগৎ টিকবে না। দণ্ডের কঠোরতায় যখন বিচারকের মনে বিষণ্নতা দেখা দেয়, সেটা-ই আসল বিচার। এটা কোনোক্রমেই প্রতিশোধ নয়। আজ যারা বিধির বিধানে 'স্বজন' হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, তারা একটু সেই একাত্তরের দিকে চোখ রাখুন। সে সময়ে স্বজন-হারানো মানুষদের কথা একটু ভাবুন। আর নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, তাদের প্রতি আপনার কোনো সহানুভূতি কাজ করে কি না, কখনো করেছে কি-না? আপনার হারানো (ফাঁসিকাষ্টে ঝোলা) সেই 'স্বজন' সন্তপ্ত সেই মানুষদের জন্য কী করেছেন, সে ব্যাপারে আপনাদের কী বলেছেন, একটু স্মরণ করুন।
বিষয়: রাজনীতি
১২৮০ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্কাইপ কেলেন্কারি এই বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে অনেক আগেই। জননেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন সেই ব্যক্তি যার নামে ১৯৪২ সালে সারা ভারতবর্ষে ফজলুল কাদের চৌধুরী সপ্তাহ পালিত হয়েছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অবদানের জন্য।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ৭১ এ বাংলাদেশেই ছিলেন না। কিন্তু তাঁর পক্ষে কোন সাফাই সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয় নি। হাইকোর্টের একজন বিচারপতিও সাক্ষী দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনুমতি মেলে নি। এর নাম আবার ন্যায়বিচার????????
১-'যাদের পক্ষে ক্ষয়, তাদের প্রতিক্রিয়াটা একটু বেশিই হবে, কথা-বার্তায়ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হতে পারে।'
২-বিরুদ্ধে যখন রায় হয়, পৃথিবীর কোনো আসামি পক্ষই কি তা মেনে নিয়েছে? প্রশ্ন তুলে নি?
৩-সাধুরও পতন ঘটে। এমনকি দেবতারও। সাকা-ফকাও এর বাইরে নয়।
৪-সাকা কি পাকিস্তানে শিকল দিয়ে বাধা ছিল? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসা তার জন্য কি নিষেধ ছিল? কথাবার্তায় ভেংচানি ও ত্যাদড় আচরণে বোঝা যায়, বাধনহারার এক শেষ এই সাকা! তাই ভাঁওতাবাজির পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পিতার রাজত্বে হানা দিয়ে একটু-আধটু মজা নিতে (নৃশংসতা ও নোংরামির সৃষ্টিতে) তার কোনো বাধা-ই ছিল না।
১-আরে ভাই, এতো দূরে যান কেন? খোদ গো-আজমের সাথেও কি বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল না? কিন্তু একাত্তরে এই গোলামের ভূমিকা কী ছিল? হয়ত সে সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ফকার সম্পর্ক ভাল ছিল, রাজনৈতিক বিবাদ ছিল না, তাই বিনে মাইনেতে কাজ করার উদ্যোগ!
২-কখনো কখনো ঐতিহাসিক মামলায় বিনে পয়সায় লড়াতেও লাভ আছে। খ্যাতি আছে। বঙ্গবন্ধু তো তেমনই এক তারকা, যার পাশে ভিড়লেই অন্যদের চোখ পড়ত। নিজের পসার হত। সুতরাং এ দিয়ে একাত্তরের অপরাধ ঢাকার কোনো সুযোগ নেই।
১-হত্যা হত্যা-ই, সে একাত্তরে হোক কি বাহাত্তরে। আমরা সবই স্বীকার করি। আর সে সূত্রেই 'নির্বোধ ও আবাল লাল ঝান্ডার উৎপাত' শব্দবন্ধ্যের উল্লেখ, এর প্রতি ইঙ্গিত করার লক্ষেই। কিন্তু ৭১-গণহত্যা-নৃশংসতা, সে বাঙালি কর্তৃক হোক বা পাকিস্তানি কর্তৃক, তা স্বীকারে আপনাদের এতো সংকোচ কেন?
২-রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচার-অপপ্রচারের ভূমিকাটি কার বা কাদের? রক্ষীবাহিনীর কাজকর্ম কি সবই ক্রিয়া? না এর মাঝে প্রতিক্রিয়াও আছে? সত্যি বলছেন ভাইয়া, 'ল্যাঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট'! নিজের ল্যাঞ্জাখান একটু নেড়ে-চেড়ে দেখুন। অনেক সওয়াব পাবেন; অন্তর্চক্ষু খুলে যাবে।
ধন্যবাদ।
১-পাকিস্তানের সমালোচনা হলে আঁতে লাগে বুঝি? সে মন্দ নয়। কিন্তু পাকিস্তানের কোন অর্থনীতির কথা বলছেন? সামাজিক অর্থনীতি না রাজনৈতিক অর্থনীতি? পাকিস্তানের অর্থনীতি ও এর বৈষম্য নিয়ে গবেষণা করার অপরাধে দেশ-ছাড়া সেই মেয়েটির নাম ভুলে গেছি এই মুহূর্তে! আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই। কেন ছাড়তে হল দেশ? কী তার অপরাধ? এরই নাম অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা?
২-৪৭-এর আগে তাদের যে অবস্থান ছিল, ৭১ পর্যন্ত তাদের অবস্থান কী হল? বা ৭১-একাত্তর পরবর্তী সময়ে তাদের প্রবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ভূমি ও জনসংখ্যার অনুপাত মাথায় রেখে ৭১ পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের বিষয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করুন, চর্মচক্ষু খসে যাবে। দাসানুদাস্য বশ্য সাদামাটা কোনো বক্তব্যও আর থাকবে না।
৩-গুলেনের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় এসে খেই হারানো 'একে'র ব্যাপারে কিছু শুনতেও বাঁধে বুঝি? যাক, শেষ পর্যন্ত আবার গুলেনেরই হংকারে খেই ফিরে পাওয়া 'একে'র এখনো পুরোপুরি হুঁশ হয় নি। তাই অদূরদর্শী ও অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য ও পদক্ষেপের প্রকাশ ঘটে কখনো কখনো। গুলেনের পররাষ্ট্রনৈতিক সতর্কতাগুলো একটু পর্যবেক্ষণ করুন, তখন যাকে খুব হাস্যকরতার উপাদান মনে হচ্ছে, তাকেই বাস্তব পথ খুঁজে পাবার দিশা মনে হবে।
৪-প্রমাণ ছাড়া ফাঁসি হয় না। নাট্যামোদীদের জন্য নাটক ছাড়া গত্যান্তর নেই।
এ আপনার ধারনা। এটি তিল পরিমাণ সত্য হলেও খুশি হতাম। দুঃখিত, তা হয় নি। ধন্যবাদ।
পিশাচিনীর রক্তনেশার উল্লাসকেও না ভুজুং ভাজুং দিয়ে চালিয়ে দেয়া যায়।
কাপুরুষতায় পরিপূর্ণ মেরুদন্ডহীন গা বাচানো নিষ্ঠুর প্রয়াস।
ঠিক
অপেক্ষা করছি বিচারের পাল্লার যখন হাত বদল হয় তখন কে কাকে অদয়ালু হিসাবে দোষ দেয় আর দুর্গন্ধময় যুক্তি তুলে ধরে।
যে ধর্ষণ ও বলাৎকার ধর্মে নিষিদ্ধ, তাতে বিচারের বোধ জাগে না। কিন্তু শাসনগত ব্যবস্থার হেলনে-দোলনে যাদের সর্বস্ব কেঁপে উঠে, একেই আবার 'ধর্ষণ' নাম দিয়ে তৃপ্তি পান, তাদের কাছে বিচারের কী অর্থ, আমার জানা নেই। তাদের বিচারই কি, আর বিচারের পাল্লাই কি, সে এক রহস্য বটে। সে রহস্য উদ্ঘাটনের অপেক্ষা আমারও বিলক্ষণ আছে।
'বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান
তুমি কি এমনই শক্তিমান?'
তোমার হাতে বিচার দন্ড, কে রাজাকার, যোদ্ধা খোজ!
ঐ পাকিদের বেতন ভাতায় ছিলে তাদের আস্তানায়,
দাগী খোজ নিজের দেশের চিপা গলির কোনায় কানায়।
হাইকোর্ট চেনাও বাঙ্গালরে মারছ মানুষ রক্তনেশায় -
প্রণব দাদার কৃপায় চেয়ার - নাগাল তোমার কে'বা পায়।
মত্ত আছো রক্ত-হোলির দেশ নাশা এ' মরণ খেল'এ,
সংজ্ঞা সকল বদলাবে - গনেশ যখন উল্টাবে!
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
(উটপাখি/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
মন্তব্য করতে লগইন করুন