কে আছো জোয়ান? হও আগোয়ান...

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৮ মে, ২০১৫, ১২:১৬:১৫ দুপুর

(উৎসর্গ: তারুণ্যের প্রতিভূ ড. মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম)

ইসলামি ব্যাখ্যার দুনিয়ায় যে অতিরিক্ত মতবিরোধ, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, পরস্পরবিরোধিতা, একদেশদর্শিতা এবং এ সব বিষয়ে অন্য বা ভিন্ন মতের পরিসরকে সংকোচিত করার প্রবণতা, এর পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও, মূল কারণ হল অপূর্ণ-খণ্ডিত শিক্ষা এবং অসততা। কোথাও বা কারো হয়ত পূর্ণত এবং অখণ্ড শিক্ষা আছে, কিন্তু সততা নেই এক ফোঁটাও। সততা যদিও-বা কারো থেকে থাকে, তিনি নিঃসঙ্গ পথিক। আবার শুধু সততা থাকলেও অপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে কেউ সামনে এগুতে পারে না, এ তো জানা কথা-ই। এজন্যই মূলত সঙ্কট রয়ে যাচ্ছে বহাল তবিয়তে, কাল থেকে কালান্তরে। তবে এখানে আজ শুধু মুসলিবিশ্বের ধর্মবিষয়ক শিক্ষা, তাও আবার সুনির্দিষ্ট একটি শাখার অপূর্ণতার বিষয়টিই তুলে ধরা হবে।

আল-কুরআনের প্রতিটি আয়াতের পৃথক পৃথক ভাবপরিমণ্ডল রয়েছে। তাই আয়াতগুলোকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করেও একটি মর্মার্থ তৈরি করা যায়। একই সঙ্গে পূর্ণ একটি আয়াতকে খণ্ড-খণ্ডভাবে উদ্ধার করেও ভাবার্থ দাঁড় করানো যায়। আবার প্রতিটি আয়াতকে নিজস্ব অবস্থানে রেখে, অপরাপর সকল আয়াতের সঙ্গে মিলিয়েও একটি ভাবপরিমণ্ডল তৈরি করা যায়, যা কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিত আয়াতের বিপরীত অভিমুখে যেতে পারে। কিন্তু সেই পথে আমরা পা মাড়াই না। সামগ্রিকতা ও অখণ্ডতার প্রতি আমাদের ঝোঁক নিতান্ত কম। অথচ সকল আয়াতকে স্বাধীনভাবে এবং এর প্রেক্ষাপট ও পটভূমির সঙ্গে মিলিয়ে বিশাল ভাবপরিমণ্ডল দাঁড় করানো এখন অনেক সহজ। কারণ, মুফাসরিনে-কিরাম ‘আসবাব আল-নুজুল’ তথা শানে নুজুল বিষয়ে অসংখ্য বইপত্র রচনা করে আল-কুরআনের মূলভাব ও ভাবপরিমণ্ডল রক্ষার ক্ষেত্রে যে অসাধারণ শ্রম ব্যয় করেছেন, তা বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল।

ইসলামের মূল পরিচিতি, বিস্তৃতি ও সারনির্যাস নির্মাণে আল-কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদিস ও সুন্নাহর সংশ্লিষ্টতাও অনিবার্য। অন্তত তা বৃহত্তর মুসলিম-সমাজের চিন্তা ও চেতনা এমনই। বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিতভাবে সুন্নাহ ও হাদিসের যে ভাবার্থ তৈরি হয়, এর সকল দিক ও সামগ্রিক বিবরণকে সামনে রেখে তৈরিকৃত সারনির্যাস কুরআনের মতোই কখনো কখনো খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন হাদিসের বিপরীত অভিমুখে যেতে পারে এবং যায়-ও।

অবাক ব্যাপার হল, আল-কুরআনের শানে নুজুল অনুসন্ধানে, নির্ধারণে উলামায়ে-কিরামের যে ব্যাপক ও বিপুল অংশগ্রহণ এবং নানা মাপের গ্রন্থ-বিরচন, তা হাদিস-সুন্নাহ-সংশ্লিষ্ট তথা শানে ওরুদ বিষয়ে নেই। যতটুকু আছে, তা ‘আসবাব আল-নুজুল’-এর অনুপাতে একেবারেই নগণ্য। উলুমুল কুরআন তথা কুরআন-সংশ্লিষ্ট জ্ঞানকাণ্ড এবং উলুমুল হাদিস তথা হাদিস-সংশ্লিষ্ট জ্ঞানকাণ্ড ইত্যাদির ইতিহাস ঘাটলে তা সহজেই প্রতীয়মান হয়।

এ-বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন আবু হাফস আল-উকবারি (মৃ-৩৯৯ হি.) এবং আবু হামিদ আবদুল জলিল আল-জুবারি। তাদের সেই গ্রন্থদুটির নাম পরবর্তী আলেম-ওলামার লেখালেখিতে পাওয়া গেলেও এর কপি পৃথিবী কোথায় কোথাও নেই। এরপর এ বিষয়ে বিধি-বিধান রচনা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন ইমাম আল-বালকিনি (মৃ-৮০৫)। তার রচিত গ্রন্থের নাম “মাহাসিন আল-ইসতিলাহ’। তারই অনুসরণে কিছু সংযোজনসহ ইমাম সুয়ুতি (মৃ-৯১১) রচনা করেন ‘আল-লুমা ফি আসবাব আল-হাদিস’। সুয়ুতির পথ ধরে বর্ধিত আকারে ইবনে হামজা আল-হানাফি (মৃ-১১১০ হি.) রচনা করেন ‘আল-বায়ান ওয়া আল-তারিফ ফি আসবাব ওরুদ আল-হাদিস আল-শারিফ’।

হাজার হাজার হাদিসের প্রেক্ষাপট ও পটভূমির নির্দেশনায় এ রকম একটি বা দুটি মাত্র বই? সুয়ুতির গ্রন্থে ৯৮টি হাদিসের পেছনে ২৭৪টি প্রেক্ষাপটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইবনে হামজার মতে, গ্রন্থ সম্পন্ন করার আগেই সুয়ুতির মৃত্যু ঘটে! তবে বলতেই হবে, তিনি এবিষয়ের অসাধারণ এক পথিকৃৎ। ইবনে হামজা ১৮৩৯ হাদিস উল্লেখ করে এদের প্রেক্ষাপট ও পটভূমি নির্ণয়ের প্রয়াস চালান।

আধুনিক সময়ে এ বিষয়ে একাডেমিক চেষ্টা নিয়োগ করেন কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাফাত সাইদ। তিনি মূলত বালকিনি, সুয়ুতি এবং ইবনে হামজার রচনা ও দিক-নির্দেশনার মূল্যায়ন করে এ বিষয়ক উদ্যোগের প্রতি দৃষ্টি-আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তিনি নতুন কোনো পথের সন্ধান দেন নি, বরং তাদের বর্ণিত পদ্ধতি ও রীতি-নীতির একটি সারনির্যাস তৈরি করেন মাত্র। হ্যাঁ, ‘আসবাব-আল-ওরুদ’-এর বিধিবদ্ধকরণে এবং একাডেমিক বিন্যাসকরণে মালোয়েশিয়ার বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ আসরি জয়নুল আবেদিনের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার মতো। তিনি পেছনের আলোকবিন্যাস ও নির্দেশনাসহ আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রায় সকল হাদিস ও সুন্নাহর কারণ, প্রেক্ষাপট ও পটভূমি নির্ণয় করার প্রয়াস চালান। ইসলামের এ-দীর্ঘ পরিক্রমায় এটাই যেহেতু ‘আসবাব আল-ওরুদ’ বিষয়ে একটু সুবিন্যস্ত এবং একাডেমিক পরিসরে রচিত বই, তাই এর বিষয়গত ও ঐতিহাসিক মূল্য অপপরিসীম। কিন্তু তা দীর্ঘ বিরতির পর এক সুবিস্তৃত সংযোজন হিসাবে একে কোনোভাবেই পরিপূর্ণ বলা যাবে না।

শোনা যায়, জর্মন এবং ফরাসি ভাষায় ইসলামি জ্ঞানকা-সমূহের নানামাত্রিক কাজ হয়েছে। তবে এ-বিষয়ে এখনো কোনো কাজের সন্ধান এখনো পাওয়া যায় নি। উপরন্তু ইউরোপীয় আলোকায়ন-পর্বের প্রভাবে বা আঘাতে মুসলিম-বিশ্বেও জ্ঞানচর্চার কসরত চলতে থাকে। ড. আসরির চেষ্টাটা এরই অংশ বলে মনে হয়। এর বাইরেও হয়ত বিভিন্ন রকম কাজ থাকতে পারে। এ-বিষয়ে পাঠক-বন্ধুদের কাছে কোনো নতুন তথ্য থাকলে অবহিত করার অনুরোধ জানাই।

সিহাহ সিত্তাহ তথা ছয় বিশুদ্ধ গ্রন্থসহ হাদিস ও সুন্নাহর আরো অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। এই ‘ছয়’-এর বাইরে আর কোনো বিশুদ্ধ হাদিস নেই, এমন কথা ‘আল-বানি’র মতো কঠোর-কঠিন মেধাও বলতে পারেন নি। তাহলে এত সব সহিহ হাদিস ও সুন্নাহর প্রেক্ষাপট, পটভূমি এবং কারণ নির্ণিত হবে কখন, কীভাবে এবং কাদের মাধ্যমে?

অনেককেই বলতে শুনি, প্রতীচ্যে যা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ও দলবদ্ধভাবে এবং যৌথপ্রয়াসে, তা-ই আবার প্রাচ্যে হয় একক ব্যক্তি প্রচেষ্টায়। ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়ে ব্যক্তিপ্রচেষ্টার এমন ভুরি ভুরি নজির আছে। কিন্তু সুবিশাল হাদিস-শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি কেন এবং কীভাবে চোখের আড়ালে পড়ে রইল, তা অবশ্যই বিষ্ময়-জাগানিয়া। মুসলিম-সমাজে হাদিস ও সুন্নাহ-প্রেমী অনেক যোগ্য, মেধাবী ও পরিশ্রমী তরুণের উপস্থিতি রয়েছে, তাদের উচিত কালবিলম্ব না করে অতি দ্রুত অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং নিবেদনের সঙ্গে এ কাজে আত্মনিয়োগ করা। এবিষয়টি নিয়ে ইদানিং পড়ছি আর ভাবছি: এমন ধীমান, কর্মনিষ্ঠ এবং নিবেদিত তারুণ্যের সাক্ষাৎ কি শিগগিরই ঘটবে, যিনি আপন শ্রম-বিনিয়োগ করে শূন্য এ-মাঠকে ফল-ফুল ও ফসলে ভরিয়ে দেবেন? নাকি শূন্য এ-মাঠ শূন্যই রয়ে যাবে, আর তৃষ্ণার্থীরা ঘুরে যাবে নিরাশ হয়ে? আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১১৭০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

318927
০৯ মে ২০১৫ রাত ১২:২৫
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : হাদীস গ্রন্থগুলোর তো অনেক ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচিত হয়েছে ! যাতে শানে উরুদ বিস্তারিত ভাবেই রয়েছে, তাছাড়া ফিকাহের কিতাবগুলোতেওতো এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ! Surprised



০৯ মে ২০১৫ রাত ১১:১৯
260235
রওশন জমির লিখেছেন :
আয়াতের শানে নুজুলও তো বিভিন্ন তাফসিরের কিতাবে রয়েছে, কিন্তু তবুও উলামায়ে কেরাম সুনির্দিষ্টভাবে 'আসবাব আল-নুজুল' গ্রন্থ রচনা করেছেন। কুরআনের প্রতিটি সুরার, ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিটি আয়াতের শানে নুজুল পাওয়া যাবে। হাদিসের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো কাজ হয় নি; সে রকম কোনো গ্রন্থও খুব বেশি নেই। এ জায়গাটি এখনো শূন্য। আসরি'র গবেষণাটি এ শূন্যতা পূরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে আরো কিছু কাজ হয়েছে, যা লেখাটি পোস্ট করার পর জানতে পারি। কিন্তু সেগুলো এখনো প্রকাশকের হাত ধরে পাঠকের চোখের সামনে আসতে পারে নি। বিশাল হাদিসের ভাণ্ডারের তুলনায় তা এখনো নিতান্ত নগণ্য! তাই আপনার মতো তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি!
338356
২৯ আগস্ট ২০১৫ সকাল ০৬:২১
রক্তলাল লিখেছেন : আফনে কিতা করইন? গবেষণা করইন না কে রে?
২৯ আগস্ট ২০১৫ সকাল ০৬:৪৫
279845
রওশন জমির লিখেছেন :
সে যোগ্যতা কতটুকু আছে, তা তো জানি না। তবে নিয়মিত পড়ছি। আর পরিকল্পনামতো এগুচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর তাওফিকের ওপর নির্ভর। আমিন।
২৯ আগস্ট ২০১৫ সকাল ০৬:৫৮
279848
রক্তলাল লিখেছেন : ditto

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File