বিভীষিকার গ্রন্থি-মোচনে আত্মদহনের গ্লানি!
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ৩০ মার্চ, ২০১৫, ১০:৪২:৩৩ রাত
পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহিংসতার বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কখনো বড় রকমের কোনো সহিংসতার শিকার হতে হয় নি। অন্যের প্রতি সহিংস হাত বাড়ানোর কোনো অভ্যাস-অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু কখনো যদি অতর্কিত সহিংসতার বিভীষিকা নেমে আসে আমার বা পরিবারের কোনো সদস্যের ওপর, কী হবে আমার অনুভূতি?
সম্প্রতি পরিবারের সবচে ছোট ভাইয়ের ওপর তেমনই একটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ভাইটি তুলনামূলক সহৃদয় এবং সহনশীল-সংবেদনশীল। পরিবারের আর সবার ব্যাপারে ওর প্রচ- রকমের দুর্বলতা। নিজে কষ্ট করবে, কাউকে বুঝতেও দেবে না। মনে হবে, ওর কাছে এটাই স্বাভাবিক। এবারেই ইন্টার পরীক্ষা দেবে। এ যাবৎ ওর নামে কোনো বিচার আসে নি। মানে, ও ঘরে যেমন, বাইরেও তেমন। কোনো উৎপাত-উপদ্রবে নেই। সতত শান্ত। অথচ আজ কি-না ও-ই হল নির্মম আক্রমণের শিকার!
গাঁও-গেরামে, শহরে-বন্দরে জমিজমা ও বাড়ির সীমানা নিয়ে কত রকমের দেন-দরবার হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পাশাপাশি বসবাসরত দুই পরিবার-প্রধান দরবার করছেন, অথচ তাদের ছেলে-মেয়েরা এক রুমে বসে তাসখেলায় ব্যস্ত বা একই খেলার মাঠে মিলিতভাবে দূরের কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তুমুলভাবে লড়াইরত। এর ব্যতিক্রমও হয়। আমাদের পাশের বাড়ির সঙ্গে আব্বা-আম্মার ঝগড়া-বিবাদ থাকলেও আমরা কখনোই নাক গলাই নি। খবরও নিই না। ওদের সঙ্গে সম্প্রীতি বিনিময়ে কখনোই সংকোচ জাগে নি, জাগেও না।
বাড়ির সীমানা-চৌহদ্দি সংক্রান্ত বিবাদে এবারে, ২৫ মার্চ সকালে, আব্বা-আম্মা প্রথমে নিপীড়নের শিকার, আলাভোলা বড় ভাইটিও। আম্মার অসুস্থতার জন্য ছোট দুটি বোন আম্মার পাশে আপাতত আছে, ওরাও রেহাই পায় নি। এ খবর শোনে সেজো ও সর্বকনিষ্ঠ ভাইটিও দেখার উদ্দেশ্যে বাড়িতে আসে। বাড়িতে ঢোকার পূর্বেই সেজোটিকে সরদার গোছের দু-একজন বারণ করার ছুতোয় চেপে ধরে। সেজোটির চোখের সামনে প্রহারে প্রহারে ছোটোটির মাথা ফাটিয়ে দেয় ওরই দীর্ঘদিনের বা বাল্যকালের বন্ধু, আমাদেরই তথাকথিত চাচাতো ভাই! ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, লালে লাল হয়ে যায় সমস্ত শরীর।
ঘটনাটির পর মাথায় এক ধরনের অস্থিরতা চেপে বসে। ঘুম আসছে না কোনোভাবেই। যেই পরিবারে শিশুর প্রতি কোনো রকমের সহিংসতা নেই। যারা নিজেরা পরস্পরে মারামারি করে না, বাইরের অন্য কারো সঙ্গেও না; যারা কাউকে কটু বাক্য বলে না; গ্রামের পঞ্চম শ্রেণি পার হবার যারা নিজ বাড়িতেই মেহমানের মত আচরণ পায়, তারা যদি পিতা-মাতাকে দেখতে আসার কারণে এমনভাবে রক্তাক্ত হয়, তাহলে তা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? এর পেছনের কারণ কিছুটা অবশ্য বুঝতে পারি। আর তা হল ঈর্ষাপরায়ণ সেই সব সরদার-মাতব্বরদের প্ররোচনা, যারা নিজেদের সন্তানদের প্রাইমারি পাশ করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এরা নষ্টামি করার পরও আমাদের কাছে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রত্যাশা করে। কিন্তু পায় না। তাই নিজেরা সরাসরি কিছু করার সুযোগ না পেয়ে নির্বোধ পড়শিকে পশুবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ করছে এবং করে।
আমার এই রক্তের (?) পড়শিরা এর পূর্বে একাধিকবার আব্বা-আম্মাকে তাড়া করেছে। আম্মাকে জখম করেছে। আব্বাকে মারার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছে। ওদের মুখের ভাষা তো শালীনতার সকল মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়, এমন কি কোনো কিছু না ঘটলেও। তবুও ওদের ভেতরের জেদ কমে না। রক্তের নেশা চাগাড় দিয়ে ওঠে। পড়শির মুরব্বি, বর্তমানে বিগত, আমার আব্বার চাচা হন, সেই সুবাধে তিনি আমাদের দাদা। সন্তানের অনাদায়ী ঋণের জন্য গ্রামবাসী তথা সাহেব-সরদার তার ওপর মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করে। চাচার প্রতি দরদি হয়ে সেই জরিমানার জামিন হন আমারই পিতা। অথচ তার সমর্থ আপন ভাতিজাও তখন বর্তমান। বিগতপ্রাণ মুরব্বির বড় ছেলে অনেক আগে থেকেই অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত, এখন জেলে। প্রথমবার যখন তিনি পুলিশ-কেইসে পড়েন, তখন আমার আব্বাই থানা-আদালত করে ছাড়িয়ে আনেন। মুরব্বির আপন ভাতিজা যখন মোটরবাইক থেকে পড়ে গিয়ে ভীষণভাবে আহত হন, তখন নানা রকমের খরচ বহন করে দেশের গোলযোগপূর্ণ অবস্থায় (সম্ভবত ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে) আমার পিতা-ই তার চিকিৎসা করান। তারপরও দরদি সেই লোকটির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, আমার ভাই আজ ভীষণভাবে রক্তাক্ত, তিনি নিজে সস্ত্রীক আহত, অন্যান্য সন্তানও প্রহৃত!
সংক্ষিপ্ত এবং অতি ক্ষুদ্র এই জীবন-পরিসরে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমার স্বভাব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িতের পক্ষেই আমার নৈতিক, কখনো কখনো সক্রিয় অবস্থান। এজন্য নিজ সংসারেও সমালোচনা সইতে হয়। গ্রামে যে-অন্ধ পক্ষপাতমূলক সমাজ-ব্যবস্থা প্রচলিত, তাদের আমি/ আমরা চক্ষুশূলÑ অন্যায় কাজেও সমান হারে সমর্থন না দেওয়ার অপরাধে! তথাকথিত সমাজের বিবেকহীন-নীতিহীন, অর্থলোলুপ সাহেব-মাতবররা আমার/আমাদের প্রতি ভীষণ বিরক্ত!
প্রখ্যাত লেখক ডা. লুৎফর রহমানের মতো নীতিকথামূলক কোনো বই রচনা আমার দ্বারা হয় নি, কিন্তু যেই নীতিতে আমার আস্থা, আপাত সন্তান-সন্ততি ও স্বজন-পরিজনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে না পড়লে, পারতপক্ষে তাতে ছাড় দিই না। এজন্যই পরিবারের এমন কঠিন দিনেও আমাকে দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকতে হল!
আমার সবচে ন্যাওটা ভাইটির আহত হওয়ার সংবাদে অঝোরধারায় কাঁদতে হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছে এর প্রতিকার ও যথাবিহিত করা নিয়ে ভাবছি। আমার প্রথম চিন্তা ওর পরীক্ষা। যে করেই হোক পরীক্ষা দিতেই হবে, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি কৃতিত্বের সঙ্গে পাড়ি দিতে হবে। মামলা-মোকদ্দমা ও থানা-পুলিসের কথা মাথায়-ই নেই। একমাত্র চিন্তা হল, ওকে যে করেই হোক সুস্থ করে তুলতে হবে। কিন্তু গ্রাম্য-সমাজের দূষিত ক্লেদাক্ত সেই মাতবরদের ফোন: ‘মামলা করো না’- আমাকে সচকিত করে। আমার টনক নড়ে: আরে, তাইতো! মামলায় তো এর প্রতিকার হতেই পারে!
পরক্ষণেই আবার ভাবি, ওরা পাশের বাড়ির আপনজন। ওরাই এতদিনকার দুঃখ-সুখের ভাগিদার। পুলিশ যদি ওদের নিপীড়ন করে, তখন কি খুব ভাল লাগবে? সে তো কখনোই সইতে পারবো না। কঠোরভাবে বিবেকে বাঁধবে, তিরের মতো বিঁধবে। উপরন্তু, ওরা তুলনামূলক আর্থিকভাবে দুর্বল। যদিও মুখের ঠাঁট অনেক, ঝাঁঝও বেশি। পুলিশি হয়রানি এদের দুর্দশা বাড়াবে মাত্র। ভাই-বোনদের সাথে এনিয়ে কাউন্সিলিং-এর উদ্যোগ নিই। ওদের উত্তর হল, ‘তোমাকে এজন্যই তৎক্ষণাৎ জানানো হয় নি। তোমার নীতিবাক্য দিয়ে সমাজে টিকে থাকা যাবে না।’ ধীরবুদ্ধি পিতাও ঘটনার আকস্মিকতায় ও অতিরঞ্জনে হতবুদ্ধি। পরক্ষণেই চোখ গেল হাসপাতালে শুয়ে থাকা রক্তাক্ত ভাইটির দিকে। বিবেক বে-সামাল, ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। না, যেমন কুকুর তেমন মুগুড় না হলে চলে না!
এতবড় একটা নিপীড়নের পরও পক্ষপাতদুষ্ট সরদার নামের সমাজের নষ্ট কীটরা অপপ্রচারের ধোঁয়া তুলতে থাকে। এদের কারো কারো কথা, ‘দোষ সব আমাদেরই! অন্য কারো নয়।’ কোনো কোনো অর্বাচীনের বক্তব্য হল, ‘তাদের কথা না-মানা হলে, মানে, মামলা থেকে বিরত না হলে সমাজচ্যুত করা হবে!’ যে-খানে জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মানের নিশ্চয়তা নেই, সেখান থেকে বিচ্যুতি মন্দ নয় কিন্তু। এ সমস্ত কিল দেবার গোসাইদের থেকে সরতে পারলেও জনম ধন্য হবে। অবশ্য কোনো কোনো শুভাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীর আন্তরিক পরামর্শও আছে। তাদের কথা হল: ‘তোমরা শিক্ষিত মানুষ, তুলনামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এসব গ-মূর্খ ও গরিব মানুষদের সঙ্গে লড়তে যাবে কেন? এদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা লড়লে মানুষ মন্দ বলবে।’ আন্তরিকতার জন্য তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ তায়ালা তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন। কিন্তু কুকুর যদি তেড়ে আসে, কামড়ে দেয় পিতা-মাতা ও ভাইবোনকে একেবারে চোখের সামনে, তখন কী হবে আমার বা আমাদের ভূমিকা? শিক্ষা ও ভদ্রতার তকমা নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকবো? কুকুরকে নিরাপদে কামড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবো? কুকুরকে যারা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে, তাদের অস্ত্রকে ভোতা করার উদ্যোগ নেব না?
জর্জ বার্নর্ড শ’র একটি বাণী বোধহয় এ রকম: ‘সত্যিকারের নিরপেক্ষ ব্যক্তি কঠিন মুহূর্তে নিজের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়।’ একদিকে রয়েছে আমার পড়শিরা, যারা অন্যের প্ররোচনায় মারমুখো ও খুনপিয়াসি হতে কসুর করে না। অন্যদিকে রয়েছে সহিংস বিভীষিকার গ্রন্থি-মোচনের দায়। আমার ভাই-বোন ভীষণভাবে আহত, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দা-বটি ও খুন্তি-শাবলের আঘাতে পিতা-মাতা নির্বাক, নিস্তব্ধ। নিজ হাতে বা উদ্যোগে সহিংসতা ঘটানোর বা প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো প্রবণতা আমাদের ধাঁতে নেই। যাদের কাছে বিচার চাইবো, সেই সব সমাজি সরদাররা পক্ষপাত-দুষ্ট, অর্থগৃধ্নু । অপরাধের দায়ে পড়শিদের অর্থদন্ড দিয়ে সে অর্থ ওরা-ই আত্মসাৎ করার প্রতিযোগিতায় নামবে। তাই আপাতত মনে হচ্ছে থানা-পুলিশই মন্দের ভালো। কারণ, একেই ওরা প্রচন্ড রকম ভয় পায়। তারপরও ভাবছি, পুলিশ যদি কোনো অতিরঞ্জন করে ফেলে, এর দায় কি অস্বীকার করা যাবে? আমি নিরপেক্ষ কি-না, জানি না। তবে এখন এই চরম সিদ্ধান্তহীনতার পর্যায় পার করছি।
বিষয়: বিবিধ
১০৪০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার বাড়ি কোথায় জানিনা, তবে বাংলাদেশের বিঃবাড়িয়ার দিখে এরকম ঘটনা খুব বেশী ঘটে থাকে! পত্রিকা খুললেই এমন খবরাখবর চোখে পড়ে।
সরদারেরা তামাসা দেখার জন্য ব্যস্ততা তৈরী করে..... বিশেষ করে পুরনো দিনের অভ্যাস টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উটে!
এটাই সমাজের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন