রাজনীতির বেল-পাকা এবং কাক-সমাচার
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৭:০৫:৩২ সন্ধ্যা
জমে উঠেছে রাজনৈতিক আগুনের পেট্রোলিয়াম খেলা। এক দল ছুঁড়ে মারে, এক দল মরে। যারা মারে, তারা ক্ষমতায় বসবে না; এরা আজীবন অস্ত্র নিয়েই দাপিয়ে বেড়াবে, পাহারা দেবে নিজ প্রভুর। যারা মরে, তাদের তো ক্ষমতায় বসার প্রশ্নই ওঠে না। তারা মরে গিয়ে দাবার গুটি হয়। তাতে কারো পতনের ঘণ্টা বেজে ওঠে, কারো ক্ষমতারোহণের পথ উন্মুক্ত হয়। তবে এটা বলতেই হবে, এরা মরে গিয়ে মুক্তি পায়। বিপরীত পক্ষে তাদের সন্তান-সন্ততি, স্বজন-পরিজন আপনহারার বেদনায় কাতর হয়, পাথর হয়। ভেতরের দগদগে দাগে ব্যাকুল হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেট্রোলের ব্যবহার নতুন নয়, আগেও হয়েছে। কিন্তু কম, একেবারেই কম। এবার হচ্ছে ব্যাপকভাবে, অভাবিত পরিমাণে। তবুও কারো নড়ে উঠার লক্ষণ নেই। বিবেকের জাগরণ নেই। কারণ, কারো কারো লক্ষ্য অন্যের শরীর পুড়িয়ে আলু সিদ্ধ করা নয় শুধু, বিরানি রান্না করা। হ্যাঁ, বিরানির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মানে, আওয়ামী লীগের সুর নরম হতে শুরু করেছে, শাসনীয় রশি শিথিল হতে যাচ্ছে। বিদেশের সরোবরে ঢেউ উঠছে! তাহলে কি পরিবর্তন আসন্ন?
হয়ত-বা! কিন্তু এ পরিবর্তন কি বিএনপির জন্য ক্ষমতারোহণের সহায়ক হবে? নাকি এতে সাময়িক মুক্তির স্বাদ মিলবে মাত্র? নাকি তা উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়া ও পোড়ার অভিজ্ঞতা এনে দেবে? ইত্যকার নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে সামনে এগোনো যেতে পারে।
এর আগে একটু আলোচনা করা দরকার আওয়ামী লীগ সত্যি সত্যি ক্ষমতা ছাড়বে কি-না। এর ভেতরের ও বাইরের অবস্থা কী? যদি না-ই ছাড়ে, তাহলে এমন খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কেন? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ক্ষমতার স্বাদ এমনই মোহনীয় যে, তা স্বেচ্ছায় ছাড়ার কোনো নজির পৃথিবীতে খুব একটা নেই। ভারতীয় বা এশীয় ঋষি-দরবেশ ও গান্ধির মতো লোকজন ছাড়া এমন কেউ করে না। যতদূর জানি, আওয়ামী লীগে ঋষি-দরবেশ বা গান্ধির মতো কোনো লোক নেই। অপরাপর দলের মতো এটিও ত্যাগের চেয়ে ভোগের মহিমায় সেঁটে থাকতে চায়। ত্যাগ যদি-বা করতেই হয় সাধারণ জনতা করবে, কখনোই আওয়ামী লীগ নয়।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে আওয়ামী লীগের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধিতার একটি গুণগ্রাহী গোষ্ঠী আছে। তারা আওয়ামী লীগকে সহজে ত্যাগ করবে বলে মনে হয় না। বিশেষত ইজরাইল তো কোনোভাবেই ধর্মীয় গ্রুপ-সমর্থিত/ সমন্বিত কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, চাইবেও না। তাই আন্তর্জাতিক পরিম-লে ইজরাইলের অঙুলি-হেলন তো আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক হবেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দামোদর মোদী হলেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র দলে। ক্ষমতায় বসার পূর্বে তার সেই ‘খুনপিয়াসি’ ভাবটা আর নেই। কংগ্রেসের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ বিষয়ে অ-বন্ধু/ শত্রুর সঙ্গে আপস-রফা করবেন, তেমনটা মনে হয় না। উপরন্তু ভারতীয় বৈদেশিক রাজনীতি পরিচালিত হয় র’-এর শলা-পরামর্শে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে র’-এর সম্পর্ক পুরনো এবং গভীর। আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী হলেও ভারতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু অ-আওয়ামী লীগ (জামায়াত-বিএনপি) ভারতীয় স্বার্থ-রক্ষায় অমনোযোগী, ক্ষেত্রে বিশেষে অনাগ্রহী এবং বিরোধী। তাই সার্বিক বিবেচনায় র’-এর অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে।
তাহলে কি আওয়ামী লীগ আবারও ভারতের জোরে, র’-এর রসায়নে টিকে যাবে? না, তা বলা যায় না। র’-এর হিসাব-নিকাশ আরো জটিল এবং অবশ্যই কুটিল। তবে যেহেতু নিজেদের স্বার্থ-রক্ষা-ই তাদের মূল লক্ষ্য, তাই তাদের ধারাপাতে কখনো কখনো দুয়ে দুয়ে তিন যেমন হতে পারে, তেমনই পাঁচও হতে পারে। এ নির্ভর করে পারিপার্শ্বিকতার ওপর। সেই সঙ্গে রয়েছে ভারত ব্যতীত জগতের অন্যান্য শক্তিগুলোর অবস্থান ও ভূমিকা। যদি ভারত তাদের আশ্বস্ত করতে পারে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ শুধু তাদের হাতে থাকবে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলোকেও যথাযথ এবং ক্ষেত্রেবিশেষে বেশি সুযোগ দেবে, তাহলে বোধহয় একটা দফারফা হতে পারে।
আর হ্যাঁ, সব চেয়ে বড় কথা হল আওয়ামী লীগকে নিজের মেরুদ- সোজা করতে হবে। এখানে এসে মনে পড়ছে, আওয়ামী লীগের পীঠ বেঁকে গেছে। কারণ, ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের পূর্বে নেতাকর্মীদের মাঝে যতটা সক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে, এখন ততটা নেই। বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের উপস্থিতিটা তেমন জোরালো নয়। বরং সবাই যেন ভবিষ্যতের নিরাপত্তা-চিন্তায় আত্ম-সংযমের চর্চা করছেন! এমন কি মিডিয়াতে গুটিকয় নেতা ও মন্ত্রীর বক্তব্যই ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে। এই যে মাঠ পর্যায়ের স্থবিরতা, এটাই মনে হয়, আওয়ামী লীগের জন্য সব চেয়ে বড় অশনি সংকেত। আর এজন্যই বাজারময় ছড়িয়ে পড়েছে যে, আওয়ামী লীগের দিন শেষ!
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র দায়, বোধহয়, খোদ শেখ হাসিনা ও জয়ের উপরই বর্তেছে। তাই মায়ে-ছেলে মিলে অন্তত কথা দিয়ে উষ্ণতা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। আরো হতাশার কথা হল, মধ্য সারির নেতারা এখনই বিএনপিসহ প্রশাসনের লোকদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছেন। উপরন্তু গোধের উপর বিষফেঁাঁড়ার মতো প্রশাসনযন্ত্র তথা পুলিশও একটু গা ঢিলা করে বসে আছে। সত্যি, আর কত? তারা তো ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত!
এ পরিস্থিতি তৈরি হল কীভাবে? সে উত্তর এভাবে দেওয়া যায় যে, সংসদ থেকে সুকৌশলে বিএনপিকে খারিজ করে দিয়েও আওয়ামী লীগের আশ মেটে নি। জামায়াতের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিকেও সমান নিপীড়নে জব্দ করতে চেয়েছে। এই অতিরঞ্জনই এখন তাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভালই চলছিল। কোনো ঝুট-ঝামেলা ছিল না, নেই। কিন্তু আপোষহীন নেত্রী এবারে সত্যি সত্যি আপোষহীনতার শপথ করে বসেছেন। তিনি গো ধরলে তাকে বশ মানানো যায়, এমন শ্রুতি বাজারে নেই। অন্যদিকে দেয়ালে পীঠ-ঠেকা হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা শেষ কামড় দিয়ে মাঠে নেমেছেন। (নাকি পালিয়েছেন?) আওয়ামী লীগ সরকার সামান্য একটি সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে, একটি দলের প্রধানকে অবরুদ্ধ করে মূলত দেশকে অবরুদ্ধ করার পথ সুগম করেছে। এই অবরুদ্ধ দেশে চলছে আগুনের হুলি খেলা। ভারতীয় ঋষি-যাজকদের বহ্নুৎসবে মানুষ পোড়ানো হত কি-না জানা নেই, কিন্তু এখনকার এই উৎসবে জ্বলছে দেশ, পুড়ছে মানুষ।
এ পোড়াপুড়ির জন্য দায়ী কে? বাহ্যত মনে হয় এবং অবশ্যই বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু কুমিল্লার পেট্রোলবোমার জন্য গ্রেফতার হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো বিএনপি নেতার মন্তব্য হল, সরকার পালানোর পথ খুঁজছে। তাই নিজেরাই নাশকতা তৈরি করে বের হওয়ার উপায় সন্ধান করছে। আবার আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য হল, অবরোধ যাদের, তারাই তো জ্বালাও-পোড়াও করছে। পেট্রোল বোমা মারতে গিয়ে গান-ফায়ারে নয়, ট্রাক ফায়ারে মরছে বিএনপি-জামায়াত! বোমারুদের ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও সাধারণ কেউ পুরস্কার নিতে আসছে না। আসবে বলেও মনে হয় না। তাই বলা যায়, এভাবে চলতে থাকলে পরিবর্তন অত্যাসন্ন। কিন্তু পরিবর্তন মানেই কি মুক্তি?
মাঠ পর্যায়ের সাধারণ মানুষের ভাষাহীন কামনা: সেনাবাহিনী আসুক। কিন্তু সেনাবাহিনী আসলেই কি রাজনৈতিক মুক্তি ঘটবে? বিএনপির ভাগ্যে শিকেয় ছিঁড়বে? তা তো নাও হতে পারে। প্রথমত, পাঁচ বছরে সেনাবিভাগে আওয়ামী লীগ যে পরিবর্তন সাধন করেছে, তাতে একাধিক স্তরে আওয়ামী-সহায়ক অফিসার থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তখন যদি নির্বাচন হয়, তাতে সহানুভূতি ও আনুকূল্য আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দ্বিতীয়ত, ভারত যদি মনে করে, নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনলে সহজেই ল্যাঠা চুকে যাবে। সাপের (বিএনপি-জামায়াতের) বিষ মুখ দিয়ে বের হওয়ার অবকাশ পাবে না। লেজে গিয়েই তা গুটিয়ে যাবে, কু-লি পাকাবে শুধু, তাতে মন্দ কি? হ্যাঁ, এখানেই দামোদর দাস মোদির তোষামোদি আচরণের মাজেজা লোকায়িত থাকতে পারে। তৃতীয়ত, তারেক-কোকোকে যে-সব সেনা অফিসার প্রহার করেছেন, তাদের মাজা ভাঙা, হাটু ভাঙায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা সবাই এখনো অবসরে যান নি; অধিকাংশ এখনো চাকরিতে বহাল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা যে রোষানলে পড়বেন না, প্রতিশোধের শিকার হবেন না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? তাই বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার আয়োজনে তাদের কেই-বা স্বাচ্ছন্দবোধ করবে? তাই সন্দেহ এখানে আছেই। উপরন্তু, ভারতসহ বাইরের শক্তিগুলো যদি মনে করে, দুই বেগম আর নয়; এবার একটু সেনা-শাসন চলুক। তখন কি করবে বিএনপি? হ্যাঁ, এতে একমাত্র লাভবান হবে জামায়াত। এই সুযোগে তারা নিজেদেরে গুছিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তারেকের ভাগ্য মনে হয় খুলবে না। তাহলে বিকল্প কোনো পথ?
ধরেই নিই, বিএনপি ক্ষমতায় এলো। তখনো কি সাধারণ মানুষের স্বস্তি মিলবে? পরের কথা দূরেই রাখি, বিএনপির ঘরের কথাই বলি। হেফাজত কি তখন বসে থাকবে? তারা অদ্ভুত তের দফা দিয়ে এমন সব আচরণ শুরু করবে যে, বিএনপি পড়ে যেতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগ এতে ঘৃতাহুতি না দিলেও হাত তালি দেবে নিশ্চয়। জামায়াত সাজাপ্রাপ্ত মহা পুরুষদের মুক্তির জন্য উঠে-পড়ে লাগবে। কারণ, জামায়াতের কাছে দেশ নয়, নেতা বড়। তাছাড়া বুভুক্ষু ছাত্র-যুব-স্বেচ্ছাসেবক ইত্যকার দলের খাই খাই আচরণে বিএনপিসহ সারা দেশে হায় হায় রব তো উঠবেই।
শেষ কথা হল, আগুন নিয়ে খেলার যে প্রবণতা তৈরি হল, তাতে বোঝা যায়, শুধু পোড়া মাটিই থাকবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বা থাকলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন পূর্বকালের বহ্নুৎসব-কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে, তা বোধহয় হবে না। একাত্তরের সেনা-বেষ্টনেও আগুন ধরানোর, বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিজ্ঞতা যে দলের আছে, তাদের কাছে/ সামনে বিএনপি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারবে না, যাতে নিরস্ত হবে।
সুতরাং.. জো¡লো... পোড়ো..
হে আমার স্বদেশ...
তোমার-আমার নিয়তি
রেল লাইন, রেল লাইন...
বিষয়: রাজনীতি
১২৬৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইসলামি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির দাবিদাররাও কি এই 'কেউ'য়ের অন্তর্ভুক্ত নয়?
মন্তব্য করতে লগইন করুন