স্যার সৈয়দ আহমদ এবং মুসলিম সমাজের সেকাল-একাল
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১২:৫০:০২ দুপুর
পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতিতে স্যার সৈয়দ আহমদের মূল্যায়ন কীভাবে হতে পারে বা আদৌ তার মূল্যায়নের দরকার আছে কি-না, এ কথা এবারে এসে বারবার মনে পড়তে লাগলো। বিশেষত যখন দেখি, গোঁড়া কওমি আলেমও এখন সরকারি স্বীকৃতির ভিখিরি। কেউ কেউ আরো এক কাঠি সরেস, নিজ সন্তানকে স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেন, যা ছিল স্যার সৈয়দ আহমদের লক্ষ্যকেই বাস্তবায়ন করে। তাই ভেবে-চিন্তে স্যার সৈয়দ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে, অন্তত পুনর্মূল্যায়নের অবকাশ তৈরি হলে মন্দ হয় না।
১৮১৭ সনে সৈয়দ আহমদের জন্ম হয় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তৎকালীন মুসলিম নবাব বা রাজা-বাদশাদের সঙ্গে তার পরিবারের যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল, তাতে স্পষ্ট যে, তারা ছিল মুসলিম শাসনের কর্তাশ্রেণী পর্যায়ের এবং অবশ্যই সুবিধাভোগী। নিন্দুকদের অনেকের হয়ত তেমন ইসলামি আবহে বেড়ে উঠার সুযোগই হয় নি, যেটি সৈয়দ সাহেব পার করেছেন। আবার তার প্রাথমিক শিক্ষা তো প্রথাগত ধর্মীয় সিলেবাস ও পরিবেশেই হয়েছে। যাদের কাছে পাঠ নিয়েছেন, তারা নিজেরাও ছিলেন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং একান্ত ধর্মনিষ্ঠ। তাতে তাঁর মন-মনন-মানসিকতা ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট হবে, তা আর বিচিত্র কি? কিন্তু এতো সব ছায়ায়, বেড়াজালের ভেতরে বেড়ে ওঠেও তিনি এক সময় যুগান্তকরী এক মিশনের কর্ণধার হয়ে বসেন। তিনি নিরেট ধর্মশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান থেকে সরে আসেন। তখন তিনি বলতে, মুসলমানদেরকে ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তবে তিনি প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধিতা করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ এখনো মেলে নি। হ্যাঁ, দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, তারই সতীর্থ কাসেম নানুতুবির ইন্তেকাল হলে শোকবাণীতে সেই মাদারাসায় সাহায্য অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
মুসলিম সমাজের একটি অংশ বিশেষত প্রথানিষ্ঠ মোল্লা-মাওলানারা তাকে অত্যন্ত নিকৃষ্টভাবে উপস্থাপন করেন। এই উপস্থাপনা কতটা ন্যায়সঙ্গত আর কতটা অজ্ঞতাপ্রসূত এবং অদূরদর্শিতাজাত তা বোধহয় ভেবে দেখা যেতে পারে। আপাতত এই বিরোধিতার মূল কারণ হিসাবে এ কয়টি বিষয়ই সামনে আসে: (ক) সকল আলেম-ওলামা যখন একমাত্র ধর্মীয় (মাদরসা) শিক্ষার পক্ষে, তিনি তখন ইংরেজি শিক্ষার ওকালতি করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এর জন্য একটি প্রতিষ্ঠানও খুলে বসেন। (খ) একজন লেখক হিসাবে ধর্মীয় নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু বেশ কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যার সঙ্গে প্রচলিত মোল্লা-মাওলানার ব্যাখ্যার অনেক তফাৎ। (গ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে তুরস্কভিত্তিক খেলাফত ভেঙে গেলে ভারতীয় মুসলিম প্রায় সবাই খেলাফত রক্ষার আন্দোলন করলেও তিনি এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। (ঘ) তিনি ব্রিটিশ-বিরোধিতার সকল উপায় ও মাধ্যমই বর্জন করেন। এমন কি ভারতের মুক্তির জন্য মুসলিম সমাজও যখন কংগ্রেসের আশ্রয় নিতে থাকে, তিনি তখন এর থেকে দূরে, অনেক দূরে। (ঙ) ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের তিনি কঠোর সমালোচক। তার নানা লেখায় এই সব বিদ্রোহীদের তিরস্কার করেছেন নানাভাবে। এমন কি ব্রিটিশ শাসনকে তিনি আল্লাহর রহমত হিসাবেও বর্ণনা করেছেন!
নিশ্চিত নই, তিনি হয়ত আরো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, যা তৎকালীন আলেম সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। জানতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আপাতত উপরোক্ত কারণগুলো তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বিচার করলে সৈয়দ সাহেবের দোষের মাত্রাটুকু পরিমাপ করা সহজ হয়।
(ক) তিনি যদি ইংরেজি শিক্ষার কথা না বলে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতেন, তাহলেও কি ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মুক্তি ঘটত? আবার তার ইংরেজি শিক্ষার আবেদনে, ব্যবস্থাপনায় কি এমন এমন ক্ষতি হয়ে গেল যে, সব সময় তাকে এ শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য নিন্দামন্দ করতে হয়? তিনি তো জোর করে কাউকে এ শিক্ষা গিলতে বাধ্য করেন নি। যারা স্বেচ্ছায় ইংরেজি শিক্ষার ‘গ্যাড়াকলে’ পা না দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে ‘পুষ্ট’ হয়েছেন, তাদের তুলনায় আলীগড়ি শিক্ষিতদের অবদান, স্বাধীনতার আগে কি পড়ে, কোনো অংশে কম?
(খ) প্রথাগত মানসিকতায় একটি বিষয়ের যে ব্যাখ্যা হতে পারে, সে ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণের বিবেচনায় এর ব্যাখ্যা ভিন্ন রকম হতেই পারে। পরকাল-মুজেজাসহ হাশর-নশরের ব্যাপারে তার ব্যাখ্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ জন্য তাকে এভাবে গালমন্দ না করে লেখার জবাব লেখাতে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যেতো।
(গ) তুরস্কভিত্তিক খেলাফত-রক্ষার কি এমন যুক্তি ছিল যে, এর বিরোধিতা করলে কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম ও মুসলিম সমাজ-বিরোধী হিসাবে আখ্যায়িত করতে হেব? তুরস্কভিত্তিক খেলাফতের বিরোধিতা খোদ তুরস্ক থেকেই শুরু হয়। যে খেলাফত নিজ অধিবাসীরা রাখতে চায় না, তা রক্ষার জন্য অন্য দেশের, অন্য ভূখণ্ডের মানুষের এতো দায় কেন? এতে লাভই-বা কি? উপরন্তু এর জন্য ইসলামবিরোধী শক্তি ব্রিটিশের কাছে আবেদন-নিবেদন করতে হবে কেন?
(ঘ) কংগ্রেস হল ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করলে মুসলিম সমাজ ক্ষিপ্ত হবে কেন? পরাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সংগঠন করার কোনো অধিকার কি খোদ পরাধীন মানুষদের কাছেও নেই? আর একটি সংগঠন যদি নিজে নিজেই বেশ শক্তিমান হয়ে ওঠে, তাহলে একজন ব্যক্তির সমর্থন-অসমর্থনে কী যায়-আসে? তাছাড়া ব্রিটিশের বিরোধিতা-ই ব্যক্তি সততার মাপকাঠি হতে পারে কি? যারা বিরোধিতা করেছেন, তারা যদি শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশের আঁচলেই আশ্রয় নিয়ে কোনো অন্যায় করে না থাকেন, তাহলে তিনি শুরু থেকেই তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে কী এমন ভুল করলেন যে তাকে শত্রু হিসাবে গণ্য করতে হবে?
(ঙ) ব্রিটিশ শাসনের বৈধতার পক্ষে তিনি কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে কেউ বলতে পারবে না। তিনি শুধু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। অর্থাৎ তিনি বলেছেন সংঘাত নয়, সমঝোতার পথে আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা। যে কোনো রকমের বিদ্রোহ এই মতাদর্শের বিরোধী। তাই ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতার কারণে তাকে কেন এমনভাবে সমালোচনা করা হবে? এই বিদ্রোহ তখন মুসলিম সমাজে যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল, তা প্রত্যক্ষ করেও বা বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজে যে নিগ্রহের পাহাড় নেমে আসবে, তা অনুমান করেও তিনি একে সমর্থন করেন কীভাবে? আসন্ন বিপর্যয়ের নিশ্চয়তা সত্ত্বেও নীরব থাকা হতো অন্য রকমের অপরাধ।
এই ভাবে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, কৃষ্ণপক্ষীয় চাঁদের অপর পিঠে আলো, শুধুই আলো। যা অন্য কোনো ভূবনকে আলোকিত করে তুলছে। তবে যারা কৃষ্ণ-পিঠকেই বেছে নিয়েছেন নিজেদের একমাত্র গন্তব্য ও নিয়তি হিসাবে, আলোর স্পর্শ তারা পাবে না, সে তো নিশ্চিত। কিন্তু আজ এই সময়ে, অনেক দূরে দাঁড়িয়ে যখন পেছন ফিরে তাকাতে হয়, তখন কি এটা স্পষ্ট হয় না যে, আমাদের বিচার ছিল তাৎক্ষণিৎ অন্ধ আবেগের ওপর, যুক্তিপরম্পরাহীন অদূরদর্শিতার ওপর, আর সৈয়দ সাহেবের দৃষ্টি ছিল অনেক দূর প্রসারিত? এতো দিন যাদের বাণী শুনে তাকে নিন্দামন্দ করেছি, আজ পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা কি সেই সব ক্ষুদ্রদৃষ্টির মহৎ (?) পূর্ব পুরুষদের সামান্য সমালোচনা করতেও প্রস্তুত আছি? আমরা কোন পক্ষে: অন্ধকারের না আলোর? কাউকে তা না বলে আসুন চোখ বুজে নিজেরাই অনুভব করি।
আমিন!
বিষয়: বিবিধ
১০৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন