আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৪ জানুয়ারি, ২০১৪, ০২:৫৫:০৭ দুপুর
শেষ পর্যন্ত ১৮ দলীয় জোটের ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র আয়োজনে সরকার ও তার দল যেভাবে পথে-ঘাটে অবস্থান নেয়, তাতে বাহ্যত আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও পরিণাম নিয়ে শঙ্কার সঙ্গত কারণ আছে। রাজনীতির মাঠে শক্তির মহড়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু শক্তির প্রকাশ যদি নিজের ভিতকে খুইয়ে দেয়, তাহলে তা শক্তি নয়, মূলত তা অপশক্তি। সমস্যা হল, আবেগের তোড়ে প্রকাশিত অশুভ শক্তি ও অপশক্তির বিষয়ে অনেক মানুষই, বিশেষত ক্ষমতাসীন মানুষ যথার্থ সময়ে সচেতন হতে পারেন না।
এ প্রোগ্রামে দেশের কোনো প্রান্তেই বিরোধী দলকে বের হতে দেওয়া হল না। সরকার ও তার দল খোলামেলাভাবে সকল রকমের যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে ঠেকিয়ে দেয়। ঢাকার অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষকে যেভাবে আতঙ্কগ্রস্ত করে কোটরাবদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য করা হল, দূর থেকে আগত মফস্বলের মানুষজন যেভাবে পশুতাড়নের শিকার হল, তাতে বাহাদুরির প্রকাশ মূলত লজ্জার, যদি লজ্জা বলে কিছু থাকে। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অংশগ্রহণেচ্ছু সাংবাদিক সমাজ, উচ্চ পর্যায়ের আইনজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা সরকারি দলের সমর্থকদের দ্বারা লাঞ্ছিত হলেন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রহৃত হলেন। এতে বিএনপির ডাকা গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বাধাগ্রস্ত এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতার যাত্রাপথ সুগম হলেও অন্যায় ও অপরাধের ঝুলি যে ভার হল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ঝুলি কখনো খালেদা জিয়াকে বহন করতে হবে না। তা কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে খোদ শেখ হাসিনা ও তার দলকেই।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক করার অনেক উপায়ই ছিল, যা ছিল না সে হল সদিচ্ছা। তাই দেশ-বিদেশের নানা দাওয়াই দিয়ে মূলত কালক্ষেপণ করে নির্বাচনের মূল সময়কে উপস্থিত করা হল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কীভাবে তা সম্পন্ন করা যায়, তা নিয়ে সরকারি দলের নানা তৎপরতার কথা সংবাদপত্রের পাতায় অবচেতনভাবে বের হয়ে পড়েছে। কারণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি বর্তমান আওয়ামী লীগের আদৌ কোনো আগ্রহ ছিল না। নিরপেক্ষ নির্বাচনে তাদের যে নজিরবিহীন ভরাডুবি হবে, তা তারা ভাল করেই জানেন। এই পরাজয়ের মাশুল অত্যন্ত তিক্ত এবং অবশ্যই নজিরবিহীন হত। আপাত সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচন-নির্বাচন খেলায় তারা জিতে গেলেও ইতিহাস তাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির দাবিদার দলটি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় নি। আর তাই ভয়ের তোড়ে একটি জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়। এভাবেই আওয়ামী লীগ সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে শক্তির পথে পা রাখে। বাড়তে থাকে অপরাধের দেনা।
আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরের মিডিয়াগুলোকে নিজের আওতায় নিয়ে আসে, বিরোধী কণ্ঠের মিডিয়াগুলোকে নিভিয়ে দিয়ে। আর তোষামোদে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর দল তো আছেই, যারা সরকারের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে দোহার টানায় বেশ পটু। সরকার যদি বলে, দিনের মধ্যভাগে আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, তাহলে তারা তারস্বরে অগণিত তারকা দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারেন। এ নিয়ে টকশো গরম করতে পারেন। দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের সব চেয়ে বড় সহায় হল ভারত। ভারত সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়, দিচ্ছে এবং তা তাকে দিতেই হবে। এছাড়া ভারতের অন্য কোনো ভরসা নেই। কিন্তু ভারতের এই পিঠ চাপড়ানিতে আওয়ামী লীগের শেষ মুক্তি আছে তো?
ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। তার এন্তার শক্তি। তার কাছে আমাদের এবং বিশেষত আওয়ামী লীগের ঋণের শেষ নেই। একাত্তরে তারা আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছে, তা ইতিহাসে বিরল। নিন্দুকেরা বলে, ভারত নিজের স্বার্থেই সাহায্য করেছে। তা করুক। কিন্তু আখেরে লাভটা তো আমাদেরই হল। সেই লাভ যেন হাতছাড়া না হয়, সেই সচেতনতা সৃষ্টি ও রক্ষা করা সবার জন্যই দরকারি। এই দরকারি বিষয়টা কোন পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে, সে বিষয়ে কারো উদ্যোগ না থাকলেও বাগবিস্তার ছিল এবং আছে। আছে অযথা ভারতবিদ্বেষ চর্চা ও প্রচারণার একটি চমৎকার আয়োজন।
আর হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক বিজয়ের জন্য এক ভারতের সহায়তা-ই যথেষ্ট। তারপরও আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রচারণা তো আছেই। কারণ, আওয়ামী লীগ এ দেশের সব চেয়ে পুরনো দল। দেশের বাইরে কর্মসূত্রে যে-সব বাংলাদেশি সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করছেন, বিশেষত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কর্পোরেট সংস্থায়, তাদের সিংহভাগই আওয়ামী ঘরানার। কারণ, আওয়ামী লীগের যে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার কথা বলে, তা পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত এবং স্বীকৃত। তাই সেই সব মানুষজন আওয়ামী লীগের পক্ষে, নিদেনপক্ষে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে কাজ করে থাকে। উপরন্তু ভারতীয় বা বহির্বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও জনতাও এতে সাহস ও শক্তি যোগায়। আর সেই সুবাদেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে।
২০০৯ সালে নির্বাচিত হয়ে তারা যে সম্মুখপানে যাত্রা শুরু করে, তাতে তাদের অনেক ইতিবাচক সংযোজন আছে। যদিও এই উন্নয়নের কৃতিত্ব একান্ত তাদের নয়। কারণ, যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, এতে বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং পোশাক খাতের অবদানই প্রাধান। এ দুটি খাত তো রাজনীতির রীতি মেনে চলে না। তাই এখানে একক কোনো দলকে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ, এতটুকু বলা যেতে পারে যে, তা তাদের শাসনামলে হয়েছে। যে-সব খাতে তারা উন্নয়নের সূচক দেখাচ্ছেন, তা মিথ্যে নয়। আবার এটাও সত্য যে, তা পূর্ববর্তী সরকারের ধারবাবাহিকতার ফসল। এ সব উন্নয়ন আওয়ামী লীগ শূন্য থেকে শুরু করে নি। তবুও তা আওয়ামী উন্নয়ন হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত উন্নয়নের পরও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এত ভয় কেন, দ্বিধা কেন?
বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে, বেশ কয়েকটি সিটি নির্বাচনে তাদের পরাজয় জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবির পূর্বাভাস দেয়। উপরন্তু দেশ-বিদেশের নানা জরিপের ফলও তাদের সামনে রয়েছে। এ সবই তাদের জন্য সাক্ষাৎ নেতিবাচক বার্তা। কিন্তু ভেতরের খবর তো আওয়ামী লীগেরও জানা। প্রথমত, এদেশে সোজা পথে লাগাতার দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার নজির নেই। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে তারা দলের অভ্যন্তরীণ সদস্যসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দিয়েও তো মাঠ জরিপ করেছেন। এর কোনোটিই জন্য সুসংবাদ দিতে পারে নি। তৃতীয়ত, বিগত পাঁচ বছরের অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও তো তারা সম্যক অবগত। এত সব নেতিবচিকতা নিয়ে মুখ দেখানোর বা জনগণের সামনে দাঁড়ানোর কোনো উপায় আছে কি? তাই সোজা পথে পা বাড়ানোর আর সাহস হল না।
বাঁকা পথে পা বাড়ানো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আওয়ামী লীগ সেই ঝুঁকির পথটাই বেছে নিল। ঝুঁকির পথটাকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে আরো কিছু নেতিবাচক ও অন্যায় আচরণকে উপায় হিসাবে গ্রহণ করে। এই সব অন্যায় আচরণ ও নেতিবাচকতার মাত্রা এতটাই বে-পরোয়া যে, তা ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ও বিবেকী মানুষের মনে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবুও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য নানা রকমের অপকৌশল গ্রহণ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাইরের শক্তির মাঝে এক ভারত ছাড়া অন্যান্য শক্তিগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে আওয়ামী লীগের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কারণ, এ দেশের মানুষ অতি নিপীড়নকে কখনোই মেনে নেয় না। হয়ত অসহায় মুহূর্তে নীরব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু নিপীড়কের সমর্থক হয় না। এভাবেই আওয়ামী লীগ দেশে জনসমর্থনশূন্য হয়ে যাচ্ছে বা হয়ে গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতার নেশায় এক ভারতভক্তি অন্যদের মনে বিবমিষা জাগাতে পারে। অন্যরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আওয়ামীগকে একান্ত ভারতেই সেঁধিয়ে থাকতে হবে!
ভারত যদি আওয়ামী লীগের এই দুর্বলতাকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানোয় উদ্যোগী হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে পিঠ সোজা করে দাঁড়ানো সহজ হবে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তখন কীভাবে বজায় থাকবে, সে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়। ভারত বৃহৎ দেশ। তার অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নানা এজেন্ডা রয়েছে। এ সব বাস্তবায়নে একক কোনো দল বা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করলে হয় না। তা ছাড়া আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। তাই আজকের বন্ধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে তখন বৈরি আচরণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের কী করার থাকতে পারে?
জামায়াতের যারা যুদ্ধাপরাধী বা এদের সমর্থক, তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই। কিন্তু বিএনপি বা অন্যান্য দল ও মানুষদের দমন করলে, নিধন করলে আওয়ামী লীগের শাসনের পথ কণ্ঠকমুক্ত হতে পারে সত্য। এতে শেষ মুক্তি নেই। কারণ, দেশের সঙ্গে তো এদের কোনো বিরোধ নেই। গণতান্ত্রিক সমাজে বৈচিত্র ও ভিন্নমত হল শক্তি ও সক্ষমতা। দলন-দমন ও নিপীড়নের মাধ্যমে সেই সক্ষমতা বিনষ্ট করলে তো আখেরে নিজেরই বিলয়ের পথ তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল হল মানব শরীরের বাহুর মতো। শক্তিশালী বিরোধী দলহীন রাষ্ট্র দুর্বল বাহু বা বাহুহীন রাষ্ট্র। বাহুহীন হয়ে বাইরের চাপকে যেমন হজম করা কঠিন, তেমনই অন্য শক্তি ও দেশ কর্তৃক বিলিন হওয়ার পথও কণ্ঠকমুক্ত হবে। তাই নিজের স্বার্থেই নিজের বাহুর যত্ন নেওয়ার দরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগের সেই সুমতি আগেও হয় নি, এখনো হবে না।
তাই একক শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় বসার পর আওয়ামী লীগ যদি ভারত কর্তৃক পরিচালিত এজেন্ডার তল্পিবাহক হয়, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ নির্বিঘ্নে রক্ষা পাবে, তা বলা যায় না। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা না হলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ব্যবস্থার কী হবে? আওয়ামী লীগ যদি ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে কি আওয়ামী লীগ অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে? আওয়ামী লীগ না থাকলে দেশের অবস্থাটা-ই বা কী দাঁড়াবে? কারণ, ততদিনে তো অন্য সকল শক্তিও নিঃশেষিত।
বিষয়: রাজনীতি
১০৮২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের নেতা-নেত্রী তাদের কথা আর কি বলা যাবে, যা বোঝা যায় তাতে করে তারাও সেই অর্থের-ই গোলাম, উন্নয়নকল্পে তারা দেশের সেবক বা পরিচালক না। তারাও চাকরামীই করে যাচ্ছে অর্থের জন্যই এবং তা পাচ্ছে দেশের বাইরে থেকেও। দেশ তাদের জন্য অর্থ-উপার্জনের আরেকটি ক্ষেত্র – আর কিছুই না। এমন নেতা নেত্রী থাকলে এতে করে কি আর হবে? ইংরেজদের সময়ও আমরা গোলাম ছিলাম, পাকিস্তানের সময়ও এবং এখনও। এ ধারা থেকে বের না হয়ে আসলে ভবিষ্যতেও তাই-ই হবে।
আমাদের সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু সেই সমস্ত সম্ভাবনাকেই আমরা মূল্য দ্বারা নিরূপিত করি বা করতে চাই এতে করে বিনিয়োগের মাধ্যমে সে সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে সক্ষমতায় রূপান্তরিত করার চাইতে সেগুলোকে আমরা দূরে ঠেলে দেই – এ করলে নতুন আর কি হবে উন্নত যন্ত্র ধার করে ব আমদানী করে গোলামী করা ছাড়া?
মূল বিষয়ের সঙ্গে মন্তব্যের সম্পর্ক নিরূপণ সম্ভব হচ্ছে না নেটওয়ার্কের দূর্বলতায়। পড়ার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ রইল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন