বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ-অস্তিত্ব, ভারত এবং অপরাপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৪:৪৯:৩২ বিকাল



একাত্তর সালের পর এবারে এসে ভারত বাংলাদেশ বিষয়ে সরাসরি মাঠে খেলতে শুরু করেছে। এই খেলার শেষ কোথায়, তা বলা না গেলেও এতটুকু বোঝা যায় যে, ভারতের পিছপা হবার মতো কোনো কারণ নেই। তার এই শক্তির রহস্য কোথায়, তা আলোচনায় স্পষ্ট হবে। এর পূর্বে এখানে আমরা কিছু চেহারাকে চিনে নিতে পারি: (ক) স্বাধীনতা অর্জনকারী আওয়ামী ঘরানার রথী-মহরথী, তারা এখন দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি ভ্রক্ষেপ না করে একান্ত ক্ষমতা হাতিয়ে নেওয়া ও রাখার জন্য মাতাল হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতাপ্রেমী এ ধারার বুদ্ধিজীবীরা এখন শুধু জামাত-শিবির মোকাবেলায় ব্যস্ত। ভারতের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপকে তারা স্বাধীনতার জন্য কোনো হুমকি বা অবমাননা মনে করছেন না। (খ) বামধারার রথী-মহারথী, যারা এতদিন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য মুখে কই ফুটালেও এই মুহূর্তে তাদের মুখের তাতানো ভাবটা অজানা কারণে ভোতা হয়ে গেছে। ভোতা হয়ে গেছে বললে ভুল হবে; বলা ভাল, এখন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার ও একে শানানোর প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ মহা হুঙ্কারে সেই তত্ত্বের প্রসব করেও চলেছেন! (গ) বিএনপি ও জামায়াত ঘরানা, তারা তো সব সময়ই ভারত-বিরোধী অবস্থানে অন্তত মৌখিকভাবে হলেও। কিন্তু ইদানিং এরাও কেমন যেন ভারত-বিরোধী বক্তব্য প্রদানে নেতিয়ে পড়া আচরণ করছে! কারো সন্দেহ হতেই পারে যে, এদের এরূপ ভারত-বিরোধিতা রাজনৈতিক বিলাসিতা বা সুযোগসন্ধানী কি-না?

এবার তাহলে সেই কারণটা খোলাসা করা যাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনিবার্য একটি ইতিহাস আছে। সে ইতিহাসের পক্ষ-বিপক্ষও আছে। তারপরও সব কিছু ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মহলে একটি পতাকার মালিক। কিন্তু এই পতাকার শত্রু-মিত্র কারা? কীভাবে তা বিশ্ব-দরবারে সমুন্নত থাকবে? তা নিয়ে কিন্তু কোনো মহলেরই কর্মসূচি নেই। তবে পতাকাটি বহন করে নিজের আখের গোছানোর ধান্ধা প্রায় সবারই আছে। আমার মনে হয়, দেশ উন্নয়ন ও নিজের আখের গোছানোর নিরিখেই শত্রু-মিত্র এবং বাংলাদেশের পরিপার্শ্ব এবং আন্তর্জাতিক মহলকে চিনে নিতে পারি এবং সেই নিরিখেই ভবিষ্যতের পথচলা হতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিন্তু মসৃণ কোনো পথে হয় নি। এর জন্য কঠিন ও কঠোর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আবার স্বাধীনতালাভের পরও এই চলার পথ মসৃণ ছিল না। কারণ, তখনকার দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া সদ্যোজাত এবং প্রবীণ যে কোনো রাষ্ট্রকে নিয়েই ঝুল টানাটানির মরণ খেলায় ব্যস্ত হয়ে যেত। বাংলাদেশ তাই শুরু থেকেই এই টানাটানির পিচ্ছিল পথে পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান ছিল আমেরিকান ব্লকের এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তখন রাশিয়া ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। তাই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ভারত এবং রাশিয়ান ব্লকের অনেক কিছুকেই সমীহ করে চলতে হয়েছে। কিন্তু তখন খোদ শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ব্লকের কড়াকড়ি সহজেই মিইয়ে যেত। তাই তিনি স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ভারতের অনুমতি না নিয়ে ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে আমেরিকার তল্পিবাহক মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্বকীয় বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হন। ভারতসহ রাশিয়ান ব্লক এই আচরণে তখন হতচকিয়ে যায়!

দুর্ভাগ্যজনক হল, সদ্যোজাত একটি দেশে আমেরিকার অসহযোগিতা এবং ভারত ও রাশিয়ার কূটকৌশলে তিনি সফলতা প্রদর্শন করতে পারেন নি। এ বিষয়ে তার দল, অনুচর-সহচর এবং মন্ত্রী-আমাত্যবর্গের ভূমিকাও কম নয়। তারা বঙ্গবন্ধুর সামনে যতটা দেশপ্রেমের ভেক ধরতে পারতেন, এর কানাকড়িও যদি তাদের মনে ও আচরণে থাকত, তাহলে দেশের অবস্থা এমন হত না এবং বঙ্গবন্ধুকেও করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হত না।

বঙ্গবন্ধুর যখন সপরিবারে নিধন করা চলে তখনও কিন্তু দুই পরাশক্তির টানাটানি খেলায় ভারত বাংলাদেশ বিষয়ে ততটা সুবিধা করে উঠতে পারে নি। এভাবেই ঠেকে ঠেকে আমাদের পথচলা, এবং তা নব্বুইয়ের স্বেরাচারী শাসনের শেষপর্যন্ত। এরপর যখন তথাকথিত গণতান্ত্রিক মহা সড়কে পা রাখা, তখন কিন্তু রাশিয়ার দিন শেষ এবং এক আমেরিকার বিকট ও দানবিক উপস্থিতি শুরু। ভারত তখনও আমেরিকার বিপরীত মেরুতে কখনো সরবে, কখনো নীরবে নিজের পথ করে চলেছে। হ্যাঁ, ততদিনে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পুরো পাকিস্তান তালেবান মানসিকতার বা কট্টর ধর্মাশ্রিত মানুষদেও প্রবল উপস্থিতিতে গিজগিজ করতে শুরু করেছে। আফগানিস্তানে রাশিয়া-বিরোধী যুদ্ধে ভারতের অবস্থান সঙ্গত কারণেই ছিল রাশিয়ার পক্ষে এবং পাক-মার্কিনের বিপক্ষে। তবে তাদের সর্বান্তকরণের সতর্কতা ছিল কাশ্মিরে যেন এর কোনো প্রয়োগ না ঘটে। হ্যাঁ, সচেতন মানুষদেরও অবশ্যই অজানা নেই যে, আফগানিস্তানের পর পর কাশ্মির জ্বলন্ত আগ্নেয় গিগির মতো টগবগ করছিল। ইতোমধ্যে শুরু হয় আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আর বুরহান উদ্দিন রব্বানির তুমুল সংঘাত। এই সংঘাতে আমেরিকার খানিকটা মোহভঙ্গ হয়। বেচারা এতো তেল খরচ করল সামান্য কিছু পাওয়ার জন্য। এখন পাবে তো দূরের কথা, যারা দেবে তাদের চাহিদা-ই প্রচুর। উপরন্তু যে শত্রুকে বধ করার জন্য এই দীর্ঘ যুদ্ধ আর অশেষ ইন্ধন, সেই শত্রু তো সমাধি-ঢাকা পড়েছে। তখন কি আর করা? সুতরাং নানা ভাবে এই দুই গ্রুপকে আত্মশক্তি ক্ষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে আমেরিকা। আফগানিস্তানের মুজাহিদ নেতৃত্ব তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে। এভাবেই রক্তাক্ত পথে তালেবানের উত্থান এবং বিদায়। ভারত এই ফাঁকে নিজেকে আরো গুছিয়ে নেয়। কিন্তু ততদিনে তালেবানের দন্তনখর আপন জটর তথা পাকিস্তানেই শিকড় গজাতে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে উৎপাত দেখা দিলে পাকিস্তানেই তা রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে দ্বিধা করে না, বরং গর্ববোধ করে। ভারত এখানে নিজের পথ খুঁজে পায়। এরপরে উপমহাদেশে ভারতকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ততদিনে আমেরকিার সঙ্গে তাদের পরমাণুসহ সামরিক-বেসামরিক নানা রকমের চুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে এসে ইজরাইলের সঙ্গেও এদের বন্ধুতা তৈরি হয়। পাকিস্তান কখনো সেনাদের খায়েশ পূরণে, কখনো আমেরিকার তল্পিতল্পা বহলে ফতুর হয়ে পড়ে। এর অভ্যন্তরে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং তেহরিকে তালেবানের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড গোদের ওপর বিষপোড়ার মতো। এ হলো সীমানার ও-পারের কথা।

এবার আসি এ-পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও এর স্বাধীন চলাফেরা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। পাকিস্তান এখানে সুবিধা করে উঠতে পারবে না, তা তাদেরও জানা। কিন্তু একে ব্যবহার করে ভারতকে বিরক্ত-অনিষ্ট করার পথ থেকে তারা সরে আসে নি, আসবেও না এবং তা সম্ভবও না। কারণ, ভারতের রাজনীতিও পাকিস্তান-পীড়ক। পাকিস্তানের ভেতরে এবং বাইরে নানাভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়, যেন তা ভারতের অনিষ্টের প্রতি মনোযোগী হবার অবকাশ না পায়। আর হ্যাঁ, এজন্যই বাংলাদেশের নির্বাচনে আইএসআই-য়ের জড়িত হওয়ার নানা কাহিনি শুনতে পাওয়া যায়। পাকিস্তান যদি নিজের স্বার্থ বা ন্যূনতম পক্ষে ভারতকে ব্যতিব্যস্ত করার মানসিকতায় বাংলাদেশে অর্থব্যয় করে, তাহলে ভারত বসে বসে আঙুল চুষবে, এমন নুসখা দিয়ে যারা তৃপ্তি পান, তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু স্বাধীন কোনো দেশ যেন অন্য দেশের অভ্যন্তরে নাক না গলায়, এমন তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী, তাদেরকে অবশ্যই মানতে হবে যে, আমাদের স্বাধীন ধারা বজায় থাকা উচিত এবং অবশ্যই নিজের ঘর গোছানোটা অধিক দরকারি।

এতো গেল ভারতের পাকিস্তান-বিষয়ক কূটনীতি ও এর পাল্টা ব্যবস্থার বিষয় এবং একই সঙ্গে আমাদেরকে ক্রীড়নকের ভূমিকায় রাখার প্রচেষ্টার কথা। ভারতের অভ্যন্তরেও নানা উৎপাত আছে। ভারত এনিয়ে এক সময় ভীষণ পর্যদস্ত ছিল। এর কোনো কোনোটির যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। কিন্তু ভারত এখানে নিজস্ব পলিসি ও পদ্ধতিতে এগুতে চায়, এগিয়ে যায়। কাশ্মির যেহেতু পাকিস্তান সংলগ্ন, তাই এখানে এর উল্লেখ না করলেও হয়। যদিও দেওবন্দ হয়ে অনেক বাংলাদেশি কাশ্মিরের মুজাহিদিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে ভারতের অভিযোগ। কিন্তু বাংলাদেশের চারপাশে যে কয়টি অগ্নিগর্ভ ভারতীয় রাজ্য রয়েছে, এ সব রাজ্যের পরিস্থিতি মোকাবেলার স্বার্থেও ভারতকে কৌশলী হতে হয়। তাছাড়া ভারতের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশ যেন অধিক সুবিধা না পায় বা একে যেন যেনতেন ভাবে ভারতীয় কলোনি (?) বানানো যায়, সে চেষ্টাও কিন্তু ভারত শুরু থেকেই করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। উপরন্তু ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগর চমৎকার একটি অবস্থান ধরে আছে। চিনকে নজরদারি বা চাপের মুখে রাখার জন্য এই বাংলার গুরুত্ব ভারত ও আমেরিকা উভয়ের কাছে সমান। এ প্রসঙ্গেই মায়ানমারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মায়ানমার দীর্ঘদিন যাবৎ পৃথিবী বিচ্ছিন্ন হয়েও এক চিনের ছত্রছায়ায় এবং ভারতের নীরবতায় সদর্পে পা চালিয়েছে। আজ চলছে এই মায়ানমারকে চিনের আওতা থেকে খসিয়ে নেওয়ার ইন্দো-মার্কিন শক্তির যৌথ ও সমন্বিত খেলা! আর তাই মায়ানমার যখন গণতন্ত্রের দিকে পথ চলতে শুরু করে তখন জারদারি উড়ে গিয়ে অন সান সুচির সঙ্গে মোলাকাত করে নিজেদের দোস্তিভাব দেখিয়ে ভারতের প্রতি একটি সতর্ক বার্তা পৌঁছে দেন। আর এই সূত্রেই কিন্তু আমেরিকা এখন রোহিঙ্গা মুসলিম ইস্যুকে সামনে নিয়ে এগুতে চায়। কারণ, এদেরকে ব্যবহার করে আমেরিকার একটি বড় রকমের চিন্তা কাজ করছে, যা আন্তর্জাতিক নানা জার্নালে ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

আবার পৃধিবীব্যাপী নজরদারির জন্য ইদানিং আমেরিকার ফোনে আড়ি পাতার প্রবণতা প্রকাশ পেলেও প্রায় প্রভাববিস্তারী প্রতিটি দেশেরই নিজেদের অভ্যন্তরে এবং বাইরে গোয়েন্দা তৎপরতা রয়েছে। যেমন আমেরিকার সিআইএ; পাকিস্তানের আইএসআই; ভারতের র’; ইজরাইলের মোসাদ; ইরানের সাভাক এবং রাশিয়ার কেজিবি ইত্যাদি। চিন ব্যবসাক্ষেত্রে সময় ও মনোযোগ দিলেও এসব কাজে তাদের অংশগ্রহণ নেই, এ ধরনের প্রবণতার আভাসও পাওয়া যায় না। আর একথা তো সর্বজন বিদিত যে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে মোসাদের তৎপরতা রয়েছে। বাংলাদেশে কেজিবি বা সাভাকের কোনো সদস্য না থাকলেও র’ ও আইএসআই বা সিআইএ-র যে এজেন্ট রয়েছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু কাদের তৎপরতা ও কর্মক্ষমতা অধিক সক্রিয়, বাস্তবতালগ্ন এবং অবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলেছে, তা অনেকেরই জানা। তবে দুঃখজনক হলেও এটি সত্য কথা যে, বাংলাদেশ অপর দেশের নানা তৎপরতায় আজ পর্যুদস্ত। অবশ্য দূর নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত দিয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায় কিন্তু বিজয় নিশ্চিত হয় না। যার নিকট উপস্থিতি রয়েছে এবং সক্রিয়তাও অন্যদের তুলনায় বেশি, তার কার্যকারিতার মাত্রাও হবে বেশি। আর এটাই হল তার পিছপা না হওয়ার রহস্য।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে পার্শ্ববর্তী বা পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের আচরণের একটি খতিয়ান তুলে ধরে যায়। পাকিস্তানের কথা এখানে পৃথকভাবে আর না বললেও হয়। কারণ ৪৭-এর পর অভ্যন্তরীণ ও বর্হিবিশ্ব বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের অধোঃগতি এখন আর কারো অজানা নয়। এর কারণ যেমন মূলত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, তেমনই ভারতের কূটচালের অবদানও এখানে কম নয়। তাই বলা যায়, ভারত এখানে বিজয়ী। এছাড়া যদি ভুটানের কথা ধরি, তাহলে দেখা যায়, সেখানকার মানুষ আন্তর্জাতিক জরিপে সব চেয়ে বেশি সুখি। অথচ তাদের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই। প্যারামিলিশিয়া টাইপের একটি পুলিশ আছে, যা সংখ্যায় অতি নগন্য। এখানে ভারতীয় কারেন্সিই প্রধান। ভুটান সর্ব বিষয়ে ভারতের উপরই নির্ভর করে থাকে। এজন্য ভুটান ঠকে আছে কি-না, তা শুধু ভুটানবাসীই বলতে পারবে। কিন্তু এখানে ভারতের উপস্থিতি কারো জন্যই পীড়াদায়ক নয়। নেপালে ভাারত-বিরোধী একটা চেতনা ছিল এবং এখনও আছে। মাওবাদী নামে একটি গ্রুপ, কারো কারো মতে চিনের অর্থায়নে, এখানো নানা তৎপরতা জারি রাখছে। প্রবল আন্দোলনের মুখে নেপালের সাংবিধানিক পরিবর্তনও আসে। খসে পড়ে রাজতন্ত্রের লেজ। এরপর বহু প্রতীক্ষিত গণতন্ত্রের পথ চলা শুরু। কিন্তু ভারত-নির্ভরতা, ভারতের হস্তক্ষেপের মাত্র কমেছে কি? কমে নি, বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের কৌশলও পাল্টে গেছে। শ্রীলঙ্কার একটি স্বাধীন সত্তা আছে। এরা নিজেদের যোগ্যতায় অন্তত গণশিক্ষায় ভারতের তুলনায় এগিয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে এরা কখনোই ভারতের স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করে না। ভারত ঠিক সেভাবেই শ্রীলঙ্কাকে নানাভাবে ম্যানেজ করে চলে। তামিলদের বিরুদ্ধে ব্যাপক একটা গণহত্যা পরিচালনা করেও শ্রীলঙ্কান সরকার ভারতের কড়া কোনো ধমকের মুখোমুখি হয় নি। যদিও তামিলনাড়–র ভোট রক্ষার জন্য মুখরোচক বাণী-বিবৃতি প্রদান করেছে মাত্র। আর মালদ্বীপের যে সরকারই আসুক, ভারতের স্বার্থকে ক্ষুণœ করার কোনো সাহস নেই। সেটা ভারতীয় কূটনীতির অবদান যেমন, তেমনই সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও। এখানে শুধু বাকি রয়ে যায় বাংলাদেশর কথা। এবার পাঠক নিজেই ধারণা করুন ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় এবং বিনষ্টিতে বাংলাদেশের কী ভূমিকা রয়েছে: সে ভৌগোলিক অবস্থান, আদর্শগত চেতনা, রাজনৈতিক পলিসি এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নানা বিষয়ে। এসব বিষয়ে যদি ভারত নিজের স্বার্থরক্ষা করতে চায়, এমন কি বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণœ করে হলেও, তখন নিরপেক্ষভাবে কী বলা যায়? এবং আমরা যারা দেশপ্রেমের কথা বলি, ভারত-বিরোধিতার কথা বলি, তাদের অবস্থান ও কার্যক্রম কী হওয়া উচিত?

ভৌগোলিক অবস্থান বা মুক্তবাজার অর্থনীতির সুযোগ ও খনিজ সম্পদের বাণিজ্য করার জন্য বাংলাদেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সকল শক্তিরই উৎসাহ আছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এরা যে হুট করে নানা মতামত পেশ করে থাকেন, তা কিন্তু এ মানসিকতার জন্যই। কিন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ জনতার কোনো বিবাদে এরা সরাসরি জড়াবে না, সে হোক আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা চিন। বরং কৌশলগত নিরাপদ অবস্থানে থেকে নিজের স্বার্থরক্ষায় ব্রত হবে। ভারত নিজেকে প্রবলভাবে জড়িয়েও আন্তর্জাতিক বৃহৎ পরিসরে পার পেয়ে যাবে। কারণ, তাদের কূটনৈতিক জাল তুলনামূলকভাবে অনেক বিস্তৃত। আবার সুদূর অতীত থেকে ভারতীয় বংশো™ভূত মানুষ নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। এরা বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন। বাংলাদেশ বিষয়ে গুটি চালনার সময় তাদের পূর্ব পুরুষের দেশের স্বার্থকে ক্ষুণœ না করেই এগুতে চাইবে। কিন্তু বাংলাদেশকে তাহলে কীভাবে সামনে চলা উচিত? আর কীভাবেই বা দেশের সার্বভৌমত্ব ও মৌলিকতা ধারে রাখা যায়।

স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মৌলিকতা ধরে রাখার জন্য এখানে কিউবার কথা বলা যায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকার নাকের ডগায় বসে সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তেও কীভাবে নিজের স্বকীয়তা-স্বাধীনতা রক্ষা করেছে, তা আমাদের পাঠের আওতায় আসতে পারে। সিআইএ একাধিকবার কিউবার আমেরিকাবিরোধী রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি। রাশিয়ার পতনের পরও আমেরিকা কিউবার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি। আমেরিকা করতে চায় নি, তা নয়। আসলে বাস্তবতাঘনিষ্ট ফিদেলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনহিতকর কাজের সামনে আমেরিকার সবকিছু, সকল মিশন ব্যর্থ হয়ে পড়ে। ফিদেল শুধু কথার কারবারি ছিলেন না, একে মানুষের মাঝে চাড়িয়ে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতেও জানতেন। কানাডার সঙ্গেও আমেরিকার দহরম-মহরম সম্পর্ক নেই। কিন্তু এজন্য বিশাল মানচিত্রের দেশ কানাডাকে আমেরিকা নিজের ইচ্ছেমতো পথ বাতলে দেবার সাহস বা দুর্মতি দেখায় না। কেন? কারণ কানাডার রাষ্্রীয় কার্যক্রম দিশহিতে যেভাবে নিযুক্ত, তাতে জনগণ তৃপ্ত এবং আমেরিকার দালালি বা শত্রতায় সময় নষ্ট করার কোনো মানসিকতা তৈরি হয় না, সে মানসিকতাও তাদের নেই।

বাংলাদেশেও যারা দেশপ্রেমের ফেরি করেন অথবা ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাজারজাতকরণে নানা বক্তব্য মনোরম বাক্সে ভরে বিলি করেন, তাদের মনে রাখা উচিত শত্রতাভাব বা বৈরিভাবই নিজের সুরক্ষা দেয় না, যেমন বন্ধুতাভাবও নিরাপত্তা ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের ন্যূনতম কোনো কড়ার নয়। এর জন্য জাতিকে ভেতরগতভাবে শক্তিশালী হতে হয়। চেতনা হল একটি বায়ুবীয় বিষয়। এর বাস্তবায়ন ঘটে সমাজ-জীবনের নানা পরতে। দেশপ্রেম বা ভারত-বিরোধী চেতনা যতটা মুখের বুলিতে আবর্তিত হয়, তা যদি কার্যক্ষেত্রে এবং বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার আংশিক অবকাশ পেত, তাহলে আজ পঙ্কজ-সুজাতা কেন, এদের দাদাদেরও এমনতর ভূমিকায় নামার সাহস হত না। আমাদের দৈন্য আছে, দারিদ্র্য আছে। সে দারিদ্র্য যতটা না বিত্তের, তার চেয়েও বেশি চিত্তের। চিত্তের এ দারিদ্র্য দূর করে বাস্তবিক কার্যক্রমের বেলায় সরব ও সক্রিয় হতে না পারলে অপরের ‘ভাবী’ হয়েই থাকতে হবে অবিরাম, যাকে নিয়ে খেলবার সাধ জাগে সকল বিত্তবানের মনেই।

বিষয়: রাজনীতি

১৬০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File