মওদুদির মূল্যায়ন: স্থান-কাল-পাত্রের প্রভেদ
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৪:৪৯:৪৫ বিকাল
আবুল আলা মওদুদির জন্ম অখণ্ড ভারতে তথা ব্রিটিশ ভারতে, ভারত বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন। পাকিস্তানের জন্মের পূর্ব থেকেই তিনি ইসলামি বিষয়ে লেখালেখিতে জড়িয়ে ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার এই লেখালেখি আরো জোর পায়। কারণ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা-ই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক প্রবণতায়। কিন্তু ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মাশ্রিত দল মসৃণ পথে এগিয়ে যেতে পারে নি। সব চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল, দলটি এখনো পাকিস্তানে প্রান্তিকতার মাত্রা পেরুতে পারে নি। তবে মওদুদি নিজের এই লেখালেখির বরাতেই মুসলিমবিশ্বসহ পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। যদিও তার এই পরিচিতি সর্বত্র ইতিবাচক নয়।
তিনি যখন ব্রিটিশ ভারতে ইসলামি জাগরণমূলক লেখাগুলো লিখতে থাকেন, তখন তৎকালীন ভারতের প্রায় শীর্ষস্থানীয় প্রবীণ এবং উদ্যমী তরুণ আলেমদের সংস্পর্শ ও আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন তিনি। পরে নানা বিষয়ে মতের অমিল হতে থাকলে তারা সরে পড়েন, তার সমালোচনায় অবতীর্ণ হন। সেই থেকে তার সমালোচনার শুরু। ততদিনে তার ভক্ত-অনুরক্তের একটি দল তৈরি হয়ে গেছে, আর এর সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। এখন মুসলিমবিশ্বে এবং পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেমন তার গুণমুগ্ধ মানুষ রয়েছে, তেমনই তার নিন্দুক ও সমালোচকও বিদ্যমান।
আর তাই যে-কোনো মানুষেরই সমালোচনা ও ভক্তিমূলক দু-রকমের পরিচিতিই থাকতে পারে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। ‘যত মত, তত পথ’- যেহেতু একটি জাগতিক বাস্তবতা, তার বেলায়ও এর প্রমাণ আছে এবং অবশ্যই জ্যান্তভাবে। এখানে, ক্ষুদ্র পরিসরে তার সমালোচনা ও গুণমুগ্ধতার একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে।
তার সমকালে বা মওদুদির লেখালেখি ও জামায়াতে-ইসলামি প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে যে-সব তরুণ আলেম এতে যোগ দিয়েছিলেন, জীবনের অন্তিম পর্বে সে-সব আলেম তার থেকে দূরে, অনেক দূরে। তাদের ভাষায়, ইমানের স্বার্থে, বিবেকের স্বার্থে মওদুদির ভুল-ভ্রান্তির বিষয়ে মুসলিম জনতাকে সচেতন করতে কলম হাতে তুলে নেন তারা। এদের মাঝে মাওলানা মনজুর নোমানি ও আবুল হাসান অলি নদভি আমাদের দেশে বেশ পরিচিত। মাওলানা ইসরার আহমদ, আবদুল গাফফার নদভি এবং আমিন আহসান ইসলাহি ভারত-পাকিস্তানে মোটামুটি পরিচিত। তাদের লেখালেখির আদ্যোপান্ত আন্তরিক ও দরদমাখা। তাদের লেখার বা সমালোচনার কোনো প্রান্তেই মওদুদির প্রতি নিন্দামূলক অশালীন ও দাম্ভিক বাক্য-ব্যবহার নেই।
মওদুদির পাশে আসেন নি, সে প্রশ্নও আসে না, কিন্তু তার চিন্তাধারা বিষয়ে সচেতন ছিলেন ভারতের আজাদি আন্দোলনের অন্যতম নেতা, দেওবন্দের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয়তার রূপরেখা কী হবে, এমন একটি বিষয়ে মাওলানা মাদানি কলম ধরলে মনপুত না হওয়ায় মওদুদি তার জবাব লেখেন এবং তীব্র ভাষায়। আর তখনই মওদুদি মাদানির দৃষ্টি কাড়েন। মওলানা মাদানি তখন থেকেই নিয়মিত মওদুদির বই-পত্র পড়ে তার ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে নিজে সচেতন হন এবং অন্যদের সতর্ক করতে থাকেন। মাওলানা মাদানি কাদিয়ানিসহ ভারতের অপরাপর নানা ফিরকা সম্পর্কে লিখলেও এক মওদুদি সম্পর্কেই একাধিক বই লিখেছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, এর কোনোটাতেই কোনো অশালীনতা নেই। ধর্মের প্রতি যে তার অকুণ্ঠ সমর্পণ, তা মাদানির লেখা প্রতিটি সমালোচনা গ্রন্থেই ধরা আছে।
আরববিশ্বে পরিচিত শাইখুল হাদিস জাকারিয়া কান্দালভিও মওদুদির মতবাদ বিষয়ে কলম ধরেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কতটা আন্তরিক, তা পৃষ্ঠার পরতে পরতে জড়ানো আছে এবং যে-কোনো ইমানদারকে তা মোহিত করবে। পাকিস্তানের আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরিও মওদুদির মতবাদ বিষয় একটি বই লিখেন, আরবি ভাষায়; আরবীয় মুসলিম, আলেম-ওলেমা ও শাইখ-মাশায়েখদের উদ্দেশ্যে, মওদুদির ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে তাদের সচেতন করার লক্ষ্যে। তার বইটি আরবিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। এর উর্দু পাঠ ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কারো কারো কাছে থাকতে পারে। এর বর্ণনাভঙ্গি কখনো কখনো নিরেট সচেতনতা ও সমালোচনার পথ অতিক্রম করে ব্যক্তিক দোষচর্চার চোরাগলিতে ঢুকে পড়েছে! এটাই সূচনা কি-না জানি না, তবে এরপর থেকে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মওদুদি-সমালোচনার নামে বিপুল নিন্দার ঝড় ওঠে।
অবশ্য মাওলানা বিন্নোরির বয়োকনিষ্ঠ মাওলানা মুফতি তাকি উসমানিও মওদুদির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণকে সমালোচনা করে চমৎকার বই লিখেছেন। কিন্তু কোথাও নিন্দাবাক্য, অশালীনতা ও অতিরঞ্জনের প্রভাব নেই। কারণ, ইতিহাস ও ধর্মপরিসর তো মওদুদির একার জমিদারি তালুক নয় যে, তিনি যা বলবেন, তাই পরম সত্য এবং একান্ত অকাট্য। বরং এর সদর দরোজায় প্রবেশ করে নানা কোণে আলো ফেলার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু অধিকার থাকলেই তো হবে না, প্রবেশের করার যোগ্যতা তো থাকা লাগবে। তা নেই বলেই দেখি, তার ইতিহাস-বোধ ও ধর্মবোধকে সমালোচনা করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ অর্বাচীনদের অপশব্দ ও খিস্তি-খেউড়ের প্রবল বান!
না, আবুল আলা মওদুদি ধোয়া তুলসি পাতা নন। সে হওয়ার মতো যোগ্যতা নবি-রাসুল ব্যতীত আর কারোরই নেই। তাই কার এমন বুকের পাটা আছে যে, নিরেট নিষ্কলুষতার দাবি করতে পারে? মওদুদি নিজেও করেন নি। কিন্তু মুসলিমবিশ্বের সবচে বড় ট্রাজেডি হল ভক্তবৃন্দের বাড়াবাড়ি। এই সব অন্ধ ভক্ত বা অতি ভক্তদের কারণে অনেক রকমের ভুল বোঝাবুঝির সূচনা হয়। শুধু এ কারণে অনেকে ডুবেও মরেন। অবশ্য এখনো মওদুদিকে মরতে হয় নি, হবেও না। কারণ, নিজ ভূগোলের বাইরে, আরববিশ্ব ও ইউরোপে তাকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। বের হয়ে আসছে ধর্ম ও ইতিহাস-বিষয়ে তার ব্যাখ্যার স্বকীয়তা-সারনির্যাসসহ ঊনতা-অতিরঞ্জনের তথ্য-উপাত্য ও বিশ্লেষণী বৈশিষ্ট্যের নানা উপাদান।
ইতিহাস বিষয়ে ভারতের রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদেরও নানা মতবাদ রয়েছে। কিন্তু তিনি আলোচনার বাইরে। কারণ, ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনীতির তিনি উদ্গাতা নন, প্রবক্তাও নন। মওদুদি আবার উভয় বিষয়ে জোরকণ্ঠ। তাই ধর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেমন তার সমালোচনা রয়েছে, রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট বিষয়েও তার সমালোচনা বিদ্যমান। তা থাকতেই পারে এবং থাকা উচিতও। কিন্তু অবাক কাণ্ড হল সমালোচনার সূত্র ধরেই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে তার ধর্মীয় প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। অর্থাৎ একই ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতিপক্ষ! আর তাই একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শূল, অন্যদিকে ধর্মীয় প্রতিপক্ষের শূল, উপরন্তু পেছন থেকে জড়িয়ে আছে ভক্তদের আবেগের শূল। এই ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে শুধু ভারত উপমহাদেশে তিনি অবিরাম ঝুলছেন এবং ঝুলছেন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝামঝি!
অপরদিকে ইসলামের সূতিকাগার মধ্যপ্রাচ্যে তার গুণ-কীর্তনের মহা সমারোহ। যে নাহদা আজ তিউনিসিয়ার মসনদে সমাসীন, তাদের নেতা-কর্মীর লেখায় মওদুদির নির্মোহ শ্লাঘা। যে ব্রাদারহুড মিশরসহ আরববিশ্ব ও রাজনীতির গোলকধামকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, তার নেতা-কর্মী ও ভক্তবৃন্দের মাঝেও মওদুদির গ্রহণযোগ্যতা চোখে পড়ার মতো। সালাফিদের শীর্ষনেতা শাইখ আবদুল্লাহ বিন বাজও কিন্তু মওদুদির গুটিকয় শব্দ ও বাক্যবিষয়ে আপত্তি জানালেও সামগ্রিকভাবে তার বিপক্ষে অবস্থান নেন নি। আরববিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে তার সম্পর্কে নানা রকমের বই লেখা হচ্ছে। পাঠকপ্রিয়তাও পাচ্ছে, যা মওদুদি বিষয়ে আরবীয় পাঠকদের কৌতূহলের প্রতীক। আধুনিক জাগরণে মওদুদির অপরিহার্যতা স্বীকার করেও তাদের দৃষ্টি মওদুদির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। তাকে নিয়ে তারা ভবিষ্যৎ-পানে চোখ মেলছেন, পথ খুঁজছেন।
ইউরোপের নানা বিশ্ববিদ্যালয়েও মওদুদির রাজনৈতিক মতবাদ ও ধর্মীয় দর্শন নিয়ে নানা রকমের গবেষণা হচ্ছে। এই সব গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ নিজেদের আলোক-সন্ধান করছে। কিন্তু আমাদের দেশে, এই বাংলাদেশে মওদুদিকে নিয়ে এক মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ছাড়া আর কেউ নির্মোহতার পরিচয় দিতে পারেন নি। তিনিও মওদুদির সমালোচনা করেছেন, যদিও অনেকের মতে, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর কারো কারো মতে, তা মাওলানা ফরিদপুরীর রচনা নয়। এমনতর কথা অবশ্য ব্রাদারহুডের নেতা হাসান আল-হুদাইবি সম্পর্কেও প্রচলিত যে, তিনি নিজে সাইয়েদ কুতুব ও মওদুদি সম্পর্কে কিছু লিখেন নি; অন্যরা লিখে তার নামে চালিয়ে দিয়েছেন। সে যাই হোক, তাদের আলোচনা-পর্যালোচনার পথরেখা অত্যন্ত অমলিন, সরল এবং দরদমাখা।
সমালোচনা একটি সতেজ জিনিস এবং তা সুস্থতার লক্ষণ। মওদুদিরও সমালোচনা চলতে পারে এবং হতেই হবে। কিন্তু সমালোচনা যেন শুধু ব্যক্তিক সমালোচনা ও আঘাত-প্রত্যাঘাতের টানাটানিতে পরিণত না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। যারা মওদুদির একান্ত ভক্ত, তাদের উচিত ভক্তির পরাকাষ্টা অন্য কারো ওপর চাপিয়ে না দেওয়া। যেমন তার সমালোচক ও নিন্দুকের উচিত পর্যালোচনা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে শালীনতা, ধর্মীয় মান ও সীমারেখা বজায় রাখা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
২৩১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন