জাফর ইকবাল স্যারের ‘মিথ্যা বলার অধিকার’ বনাম সত্য ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষমতা
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২১ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৪৯:০৯ সকাল
জাফর ইকবাল স্যার আমার প্রণম্যদের একজন। সহজ শব্দের গাঁথুনি এবং সরল সরল বাক্যের মাধ্যমে তিনি যে স্পষ্ট বার্তা দেন, তা আমাকে সব সময়ই উদ্দীপ্ত করে। সম্প্রতি ‘সত্য বলার অধিকার’ শিরোনামে বিডি নিউজে প্রকাশিত তাঁর একটি লেখা চোখে পড়েছে। (http://opinion.bdnews24.com/bangla/2013/08/15/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0/#comment-28755) সেটি পড়ার পর মনে যে সব প্রশ্নের উদয় হয়, তা-ই এখানে তুলে ধরছি।
আমাদের দেশে, তৃতীয় বর্গের নানা দেশে, হরেক রকমের মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠনগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আচার-আচরণের মূল্যায়ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আবার তথাকথিত পিছিয়ে-পড়া এই দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে মানবিক উপাদানে সজ্জিত করার সুমহান প্রয়াসও জারি রাখে। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের জীবন-পদ্ধতি অসাধারণ। সাধারণ মানুষ নিচু তলার, আর অধিকার-রক্ষার এই সবযন্ত্রগুলোর প্রধান প্রধান কর্তাদের বাস উপর তলায়, বলা ভাল, ঈশ্বরের কাছাকাছি। তবুও মানবতা-রক্ষার এই সব মহৎ-মহান ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কারণ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো শুভ কর্মে তারা নিয়োজিত! কিন্তু মোষের খাবার তো খুব সামান্য নয়, সে এক যজ্ঞ বটে। তাহলে কীভাবে এর সমাধান ঘটে?
জাফর ইকবাল স্যার সে ধরনের কোনো প্রশ্ন তুলেন নি। এত গোড়ার কথায় গেলে বান্ধবহারা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তার আশে-পাশের যে-সব মানবতার ধ্বজাধারী, দেশে-বিদেশে ব্যবসা-সফল নানা সংস্থা-সংগঠন রয়েছে, তাদের কাপড় খসে পড়বে। এতে তাঁর মান-সম্মানও হুমকির মুখে পড়বে। তিনি শুধু একটি বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তা হল মিথ্যা বলার প্রথা-প্রবণতা, অভ্যাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে। মানে, কোনো এক মোষের সাম্প্রতিক আচরণ নিয়ে, যা প্রকারান্তরে তার মতামতের বিরুদ্ধে গেছে। কারণ, তার মতে অধিকার নামক একটি সংস্থা ৬ই মের শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে যে-সব তথ্য প্রকাশ করেছে, তা মিথ্যার নামান্তর। তার এই অভিমতের বিরোধিতা করছি না, এর সম্ভাবনাও নাকচ করছি না। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি তার বর্তমান অবস্থানকে, জামায়াত-হেফাজত-বিরোধী অবস্থানকে অতিক্রম করে সত্য উদ্ঘাটনের উদ্যোগ নিলে আরো ভাল হত।
জামায়াত-শিবির দেশের জন্মলগ্নের শত্রু। এ শত্রুতা এখনো অব্যাহত। যে পার্টি একটি দেশের জন্মমুহূর্তের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল এবং বিতৃষ্ণ, সে দেশে বাস করে তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর কোনো মানে নেই। উপরন্তু এটি ধর্মভিত্তিক দল, যা অপর সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে তা অনাকাক্সিক্ষত। আবার হেফাজত যদিও রাজনৈতিক দল নয়, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডগুলো থেকে কোনো এক রাজনৈতিক পক্ষ ফায়েদা লুটছে, লুটে চলেছে। উপরন্তু তাদের মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা অনেকটা সেকেলে, সময়ের সঙ্গে যা কোনোভাবেই যায় না। তাই এদের প্রতিও সমর্থন না-থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এমন কি, যৌক্তিক কোনো সংগঠন ও সংস্থার দাবি-দাওয়ার প্রতিও যদি কারো সমর্থন না থাকে, তাও অন্যায় কিছু নয়। কারণ, গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের চাওয়া-পাওয়া ও দাবি-দাওয়ার রকমফের হতেই পারে। প্রশ্ন হল, অপছর্ন্দে মতামত বা দলকে মোকাবেলা করার উপায় কি? বিবেকী অবস্থানকে অতিক্রম করে একান্ত ঘৃণ্য, বিরোধী অবস্থানকে আঁকড়ে ধরে বৌদ্ধিক চাতুর্য্যরে মাধ্যমে নিজের মতামতের পক্ষে সাফাই গাওয়া? নাকি মানুষের প্রতি, পরমতের প্রতি নমিত হওয়া এবং বিরোধী দল ও মতামতকে মোকাবেলা করতে গিয়েও নিজের মানবিক অবস্থানটাকে সংহত করা?
৬ই মের ঘটনায় সরকারের কৃতিত্ব মুহূর্তেই (!) শাপলা চত্বর জনশূন্য করে ফেলা। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে (সরকারের দাবি মতে) এত বড় জনতার সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার নজির নেই। এখানে সরকারের দাবি হল, এ ছিল রক্তপাতহীন অভিযান। অধিকার নামক সংগঠনটি সরকারের এই দাবিতে বাগড়া দিয়ে বলে দিল তা রক্তপাতহীন নয়, নিহতের সংখ্যা হাজার হাজারও নয় ( যা হেফাজত ও এর সমর্থকদের দাবি)। (বাংলাঃ http://odhikar.org/wp-content/uploads/2013/06/Fact-finding_Hefazate-Islam_Bangla.pdf ইংলিশঃ http://odhikar.org/wp-content/uploads/2013/06/Fact-finding_Hefazate-Islam_English.pdf) মাত্র ষাট বা একষট্টি-বাষট্টি! সরকার অধিকারের কাছে তথ্য চাইলে অধিকার তা দিতে অস্বীকার করে নি। (http://odhikar.org/wp-content/uploads/2013/07/Reply-to-the-Information-Minister_Bangla.pdf) কিছু শর্ত, মাত্র তিনটি শর্ত বেধে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে, আইনি ব্যবস্থার দেশে সে শর্ত অযৌক্তিকও নয়, বরং তা আইনি শাসনের জন্য সহায়ক মাত্র। কিন্তু শক্তিমত্তার এই দেশে সরকার ভিন্ন অন্য কেউ শর্ত দেওয়ার কে? জলে বসে কুমীরের সঙ্গে লড়াই? আর যাই কোথা? পরিণামে অধিকারের অধিকর্তার জেল! আর হ্যাঁ, জাফর ইকবাল স্যার এইখানে সরকারের আচরণের সাফাই গাইলেন। তার মানে কি তিনি সরকারের তল্পিবাহক? না, তা নয়। বরং তিনি যেহেতু হেফাজতকে ঘেন্না করেন, অধিকার এমন কোনো আচরণ করবে কেন, যা তার ঘেন্নার বিরুদ্ধে যায়? তার মতে, অধিকারের এবং সকল মিডিয়ার উচিত ছিল সরকারি অভিযানের খুঁটিনাটি প্রচার না করে ৫ই মে কুরআনে যে অগ্নি-সংযোগ করা হয়েছে, তা বড় আকারে তুলে ধরা! তাঁর এই কুরআন-প্রেম সত্যি মুগ্ধ করার মতো। কারণ, এর মাধ্যমে হেফাজত ও জামায়াত-শিবিরের প্রতি মানুষের ঘেন্নার উদ্ভব ঘটত, তাঁর সমর্থন বাড়ত।
আর ঘৃণ্য-ঘৃণিত জামায়াত-শিবির-হেফাজতকে এতটাই ঘৃণা করতে হবে যে, তারা যখন পাপের তুলনায় অধিক শাস্তির শিকার হবে, তখনো নীরব থাকতে হবে, সমর্থন দিতে হবে। লঘু পাপের গুরুদণ্ড অন্য কোথাও অযৌক্তিক হলেও এখানে যৌক্তিক। কারণ, যারা ঘৃণ্য-ঘৃণিত, তাদের কোনো অধিকার নেই। মানবিকতা তাদের প্রাপ্য নয়, গণতান্ত্রিক কোনো আচরণ তাদের জন্য নয়। আর তাই জামায়াত-শিবির-হেফাজতের অন্ধ মোহে মোহিত হয়ে শয়ে শয়ে অবুঝ কিশোর-তরুণরা প্রাণ দিলেও জাফর ইকবাল স্যারের হৃদয় কম্পিত হয় না। তাঁর করুণা শুধু অন্য জাতের মানুষদের জন্য তুলে রাখা।
মনে আছে, বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০-এর ফাইনালে ফরাসি খেলোয়াড় জিদানে গরুর মতো ইতালি এক খেলোয়াড়কে গুঁতিয়ে দিলে জিদানে সর্বপ্রথম ক্ষমা প্রার্থনা করেন শিশুদের কাছে। তিনি বুদ্ধিজীবী নন, জাত খেলোয়ড়; কিন্তু বিবেকহীন নন। সরকার মহোদয় মিডিয়া বন্ধ করে, বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, শক্তিপ্রয়োগ না করে (?) মুহূর্তে শাপলা চত্বরকে মানব-শূন্য করার পরও শিশু-কিশোরদের ব্যাপারে একটি মানবিক বক্তব্য পৌঁছানোর প্রয়োজন অনুভব করে নি। আমাদের শিশু-কিশোর-অন্তপ্রাণ জাফর ইকবাল স্যারদেরও এ বিষয়ে কোনো সুমতি হয় নি। হবে কেন? ওরা যে জামায়াত-শিবির-হেফাজত সমর্থক!
দেশব্যাপী হাজার হাজার মানুষ হত্যার গুজব-সংবাদ ছড়ালেও এ বিষয়ে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য নিরপেক্ষ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি (যা ছিল অধিকারের তথ্য-আদান-প্রদানের শর্র্ত) রাজনৈতিক মহল থেকে আসলেও মানব-প্রেমিক জাফর ইকবাল স্যারদের কাছ থেকে আসে নি। সরকারের প্রতি তার আস্থা অছে, এ জন্য নয়; বরং এতে করে তার ঘৃণিত জামায়াত-শিবির-হেফাজতকেই আশকারা দেওয়া হয়। স্বাধীন দেশে, আইনি শাসনের দেশে এ ধরনের আশকারা অযৌক্তিক। তাই তিনি নিরন্তর জামায়াত-শিবির-হেফাজতকে ধাবড়ানির পক্ষে ওকালতি করে যাচ্ছেন। কারণ, তিনি সকল রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধেই সরব; এ তাঁর একান্ত অধিকার, অন্য কারো নয়। রবি ঠাকুরও বলেন:
অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে
বিষয়: বিবিধ
১৮০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন