হেফাজতের রঙের খেলা
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৭ জুলাই, ২০১৩, ০১:৩৯:৪৪ দুপুর
প্রাণপণ চেষ্টার পরও গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হল; শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির ডিগবাজি-প্রবণ নতজানু নেতার সমর্থন সত্ত্বেও বড় রকমের হার হল; তরিকত ফেডারেশন এবং ইসলামী ঐক্যজোট (মিসবাহুর রহমানের গ্রুপ) পক্ষ্যে অবস্থান নেওয়ার পরও চরম ভরাডুবি হল। এর দায় কার? সদা হাস্যোজ্বল নেতা আজমত উল্লাহর? আওয়ামী লীগসহ এর নানা অঙ্গ সংগঠনের পরম্পরাগত অপরাধী কার্যক্রম? নাকি ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের সংবেদনশীল অনুভূতি, যাকে আওয়ামী লীগ কখনো বুঝতে না পারে নি এবং পারে না; বরং বরাবর একে নিয়ে ঠাট্টা-মসকরা করার দুর্মতি দেখায়?
পাশ্চাত্য দেশে মানব-জীবনে অস্বাভাবিক চাহিদা নিবারণের উপায় ‘সমকামিতা’ও মানবিকতার আওতাভুক্ত! এ নিয়ে আন্দোলনও মানুষের সহানুভূতি পায়। আমাদের দেশে ধর্মের নামে যে কোনো রকমের আবেদন-নিবেদন হয়ে যায় একান্ত মধ্যযুগীয় বর্বরতা! আর তাই এদেরকে ঠ্যাঙানোর জন্য একদিকে মাঠে নেমে পড়ে ধর্ম ও ধার্মিক সম্পর্কে অনবহিত শেকড়ছিন্ন নাগরিক তরুণ-সমাজ, অন্যদিকে আদাজল খেয়ে নামেন পরজীবী অভিজাত বুদ্ধিনিপুণ ব্যবসায়ীরা; উপরন্তু অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার উস্তাদ সুযোগসন্ধানী সাংবাদিক-সমাজ; আর মতান্ধ, বাস্তবতাবিবর্জিত অসহিষ্ণু আওয়ামী কর্মী-সমর্থকরা তো আছেই। সবাই মিলে সত্যের মাথা খেয়ে ধর্ম নিয়ে বালখিল্যতার একশেষ পরিচয় দিয়েই তারপর তারা ক্ষান্ত হয়। ততক্ষণে বা ততদিনে দেশটার এক নাকাল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ভূঁইফোঁড় হেফাজতকে বিএনপি-জামায়াতের কোলে লাতি দিয়ে কে ফেলে দিল? যে-সব অর্বাচিন বা স্বার্থান্ধ সুমহান ব্যক্তিবর্গ হেফাজতকে জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডার তল্পিবাহক বলে মুখে সুখ পায়, তারা কি জানে, হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের দূরত্বটা কোথায় এবং কেন? ইসলাম ইসলাম বলে দুটি দলই মুখে ফেনা তুললেও কেন তাদের যৌক্তিক ও স্বাভাবিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি এবং উঠবেও না, সেই তলানির সংবাদ কি তারা কখনো নিয়েছে? নেয় নি। নেওয়ার কোনো দায়বোধ নেই। জামায়াতের মাথায় যে টুপি, তা হেফাজতের মাথায় দেখে তারা নেচে উঠলো। টুপি যেহেতু একই রকম, সুতরাং এরা নিশ্চিত জামায়াত-শিবিরের গোপন এজেন্ডার দালাল। মিডিয়ার বাজারে এ কথা বলে সুখ পাওয়া যায়, চামচাদের বাহবাও মেলে। কিন্তু ভোটের বাজারে মিডিয়া ও মুখের সুখের জন্য যে খেসারত দিতে হয়, তা পূরণ করার আর কোনো উপায়ই থাকে না।
না, আমি হেফাজতের সকল দাবির পক্ষে না, বা কোনো দাবিরই পক্ষে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে কেউ যদি অযৌক্তিক দাবি নিয়ে আসে, এবং অসহিষ্ণু (?) আচরণ করে, এ জন্য কি এদের রাস্তায় পিটয়ে গণতন্ত্রের পাঠ দিতে হবে? দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে গাড়ি ভেঙে, আগুন ধরিয়ে, কুরআন জ্বালিয়ে তাদের নামে প্রচার করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়? মানুষজন বিশ্বাস করে? ভোটাররা কি এত কাঁচা? যে-মাটিতে একজন আওয়ামী ক্যাডারের জন্ম, যে চাউলের ভাত একজন আওয়ামী ক্যাডার খান, যে সব পঞ্চেন্দ্রীয় ও ষষ্ঠেন্দ্রীয় দিয়ে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন, অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাঙেন, সমাজের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জড়ান, ঠিক একই উপায় ও প্রক্রিয়ায় দেশের অন্য সব নাগরিক তথা ভোটাররাও জড়ায়। কিন্তু আওয়ামী লোকজন ও এর সমর্থক মিডিয়া-গোষ্ঠী কাকের মতো চোখ বন্ধ করে খাদ্যবস্তু আড়াল করার সময় ভাবে, অন্যরাও বোধ হয় চোখ বন্ধ করে আছে! এই সব আত্মম্ভরী নির্বোধ আওয়ামী লীগারদের কারণেই বারবার নৌকায় ফুটো হয়। সমস্যা হল, এদের প্রতি আঙুল তুলে কথা বললে এরা আঙুল কেটে দেওয়ার হুমকি দেয়। ক্ষেত্রেবিশেষে আঙুল কাটতে গিয়ে শুধু আঙুল নয়, হাতটাই কেটে ফেলে দেয়। জীবন-নাশ করে ক্ষান্ত হয়।
এমসি কলেজের হোস্টেল জ্বালিয়ে দিয়ে, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে, পরস্পরকে হত্যা করে যে বুকের পাটা প্রকাশ করল, উপরন্তু এক বিশ্বজিৎকে হত্যার জন্য সোনার ছেলে ছাত্রলীগ যে সুনামের হার গলায় পড়ল, তাতে পার্টির কোনোই মাথা ব্যথা নেই। তাদের দায়বোধ উছলে উঠল আততায়ী কর্তৃক নিহত ব্লগার রাজিবের বেলায়। তাকে শহিদ না বললে, দৌড়ে প্রধানমন্ত্রী তার বাসায় না গেলে আওয়ামী ইতিহাস ম্লান হয়ে পড়ে। তাই মান রক্ষার জন্য তার বাসায় প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত হন! সাগর-রুনির মতো সাংবাদিক দম্পতির হত্যার কোনোই কুল-কিনারা হয় না, কিন্তু হত্যার সামান্য পরেই রাজিব হত্যার ক্লু বেরিয়ে পড়ে। আততায়ীরা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাীকারুক্তি দেয়! মানুষজন এগুলো বিশ্বাস করে প্রাণভরে, আর শুধু হাসে স্বস্থির নিঃশ্বাসে! যাক, তাহলে বলির পাটা পাওয়া গেল!
অর্বাচিন হেফাজত প্রথম লংমার্চ করে দ্বিতীয় কর্মসূচীতে এসে গুবলেট পাকিয়ে ফেলে, এ জন্য সব দায় কি হেফাজতের সদকা-খাওয়া নেতাদের? কুরবানি চামড়া-খাওয়া এতিম-মিসকিনদের? জামায়াত-বিএনপির একান্ত ষড়যন্ত্রের? আওয়ামী লীগ এখানে ধোয়া তুলসি পাতা? রয়ে-সয়ে তাদেরকে ঐ রাতেই আল্লামার শফির উপস্থিতিতে দোয়ার ব্যবস্থা করে সমাপ্তির সুযোগ দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? পূর্বের দিন তাদেরকে নানা ফ্রন্টে ব্যতিব্যস্ত রেখে, আহত-নিহত করে, ঢাকার কোথাও জমায়েতের সুযোগ না দিয়ে, মতিঝিলে অবশেষে অনুমতি দিয়ে, মূল নেতাকে উপস্থিত না করিয়ে, রাতের অন্ধকারে চার দিকের বাতি নিবিয়ে, মিডিয়া বন্ধ করে, লাখ-দেড়লাখের মতো গুলি ব্যবহার করে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে বলা হল দশ মিনিটে তারা স্থান ত্যাগ করেছে এবং নজিরবিহীন অসহিংসভাবে!
মতিঝিলের সেই রাতের জমায়েতে কেউ মরে নি? কোনো রক্ত ঝরে নি? আওয়ামী লীগের মতে, এমন প্রশ্নই উঠে না। কারণ, রাতের অন্ধকারে আওয়ামী পুলিশ ও গুণ্ডপাণ্ডারা টুপি-পাঞ্জাবি-পরা মোল্লা-মাওলানাদের জামাই আদর দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। তাহলে কাভার্ড ভ্যান দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে হল কেন? রাস্তাটাকে পানি দিয়ে ধুইতে হল কেন? অবাক ব্যাপার, যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি ঐতিহাসিক অনাকাক্সিক্ষত কালো রাত্রির মাধ্যমে, সেই আওয়ামী লীগই রাতের অন্ধকারে কালো রকমের ব্যবস্থা নিল কোন যুক্তিতে? যে-পার্টির নেতা সংঘবদ্ধ খুনিচক্রের হাতে অন্যায় ভাবে প্রাণ দিলেন, সেই পার্টির মানুষজন অন্যকে কীভাবে এভাবে নিপীড়ন করতে পারে? যে নারীর পিতা-মাতা, ভাই-ভ্রাতা নিষ্ঠুরভাবে শহিদ হলেন, তিনি কীভাবে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর হতে পারেন, নিষ্ঠুর একটি আচরণের পক্ষে ঠাট্টা করতে পারেন? যেখানে সুদূর মফস্বল থেকে আসা কিশোর-তরুণ ভয়ঙ্কর স্মৃতি মাথায় নিয়ে ভারমুক্ত হওয়ার পথ খুঁজছে, সেখানে দেশের একমাত্র শীর্ষ অভিভাবক কীভাবে বলতে পারেন, হেফাজত সে-দিন রঙ নিয়ে খেলা করেছে? হ্যাঁ, রঙের খেলা-ই বটে। এই রঙের খেলায়ই হারতে হল আওয়ামী লীগকে। তবে অন্য কারো রঙ নয়, সে রঙ হল হেফাজতের, আর খেলাটা হল একমাত্র আওয়ামী লীগের।
জয় বাংলা।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন