কওমি ওলামায়ে কিরাম: প্রতিক্রিয়াশীলতাই যাদের অস্তিত্বের ঘোষক

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২১ মে, ২০১৩, ০৬:১৪:৪৭ সন্ধ্যা



১। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেওবন্দি ওলামায়ে কেরামের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা বা তাদের পূর্বসূরীদের ভাবনায় সৃজনশীলতার তুলনায় প্রতিক্রিয়াশীলতাই অধিক সক্রিয় ছিল। তাই দেখা যায়, যখন মোগল সাম্রাজ্য একে একে অস্ত যায়, তাদের কোনো আওয়াজ নেই। ইংরেজ-কর্তৃক ভারতবর্ষ পুরো গ্রাস হওয়ার পরই তাদের সম্বিৎ ফিরে আসে, তারা ইংরেজ-বিরোধী ফতোয়া ছাড়েন। যদি তাদের কল্পনায় সৃজনশীলতা কাজ করতো, তাহলে তৎকালীন সম্রাট ও জমিদারদেকে পূর্ব থেকেই সচেতন রাখতেন, নিজেরা তাদের রক্ষার জন্য আন্দোলন করতেন। তা হয় নি। মহীশুরের পতনের সময় কোনো আলেম টিপুর পক্ষ নিয়ে জিহাদ করে শহীদ হয়েছেন, অন্তত পক্ষে জেহাদ করেছেন, কেউ বলতে পারবে না। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইংরেজদের হাতে পারজিত হলেন; বাহাদুর শাহ জাফর নির্বাসিত হলেন, তার দুই পুত্রকে ইংরেজ সেনারা জবাই করে মুণ্ডু পিতার কাছে নজরানা হিসাবে পাঠালেও তখন কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা আলেম এ বিষয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বা প্রতিবাদ করেছেন, শোনা যায় নি। তারা দাঁড়ালেন ইংরেজের গ্রাস চূড়ান্ত হওয়ার পর। যাকে বলা যেতে পারে, এ হল ইংরেজ-গ্রাসের প্রতিক্রিয়া। দেওবন্দি ওলামায়ে কেরাম এই প্রতিক্রিয়ায় বেশি অবদান রেখেছেন। তবে যা-ই হোক, সেই সময়ে তাদের এই প্রতিক্রিয়া ছিল অশুভের বিরুদ্ধে, যদিও সেটা সময় পার হওয়ার পর, তাই সেটা প্রশংসনীয়। কিন্তু স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে আলেম-সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একদল আলেম অখণ্ড ভারতের পক্ষে, অন্য দল পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

২। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম বাংলা ভাষাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন। তাদের অনেকেরই মতে, এ হল হিন্দুদের ভাষা, হিন্দুয়ানি ভাষা! বাংলা ভাষাকে আপন করে নিয়ে একে সমৃদ্ধ করার কোনো ব্রত এঁরা নেন নি। শোনা যায়, সুলায়মান নদবির মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও তখন উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতির জন্য এখানে আসেন এবং বক্তব্য দেন। তিনি ব্যাপক প্রতিবাদ ও গণ-অসন্তোষের মুখে পাকিস্তান ত্যাগ করেন। অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম এতেই থেমে থাকেন নি, তারা উর্দু ভাষার পক্ষে গণ-স্বাক্ষরের আয়োজন করেন! তখনই ভাষার জন্য সালাম-রফিক-জব্বার শহিদ হন। অর্থাৎ মেধার জোরে, চেষ্টার ঔকান্তিকতায় হিন্দু সমাজ বা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ মাতৃভাষা বাংলায় যে সৃজনশীলতা ধারা তৈরি করেছে, তা দেখে তাদের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এই প্রতিক্রিয়া থেকেই ভাষার প্রতি তারা বিরূপ হয়ে পড়েন। সৃজনশীলতার বিরুদ্ধে সৃজনশীলতা নিয়ে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি, সেই মানসকিতা ও যোগ্যতা তাদের ছিল না।

৩। আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক নানা তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের কার্যত কোনো অভিযোগ ছিল না। আইয়ুব খান যে-ভাবে হাদিয়া উপঢৌকন দিয়ে তাদের বশে রাখেন, তাতে তাদের যেমন তৃপ্তি ছিল, তেমনই ভোগেরও একটি উপায় খোলা ছিল। ইসলামের স্বপ্ন নিয়ে গড়া দেশে তারা স্বপ্ন পূরণের কোনো চেষ্টা না করে নাক ডেকে ঘুমান। কিন্তু যখন প্রচলিত ফিকহি মতাদর্শের বাইরে গিয়ে আইয়ুব খান পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেন, তখনই এঁরা ক্ষেপে ওঠেন। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের সৃজনশীল প্রবণতার মাধ্যমে পারিবারিক উত্তরাধিকারের বিষয়টির ফায়সালাকরণে তাদের কোনো উদ্যোগ ছিল না, কিন্তু যে-ই আইয়ুব খান কতিপয় বিকল্প মতামতের ভিত্তিতে আইন সংস্কার করেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়ায় সব নড়ে ওঠে। অবশ্য সে-সব আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়া কিছুই প্রসব করতে পারে নি।

৪। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনে বাংলার মানুষ শোষিত-বঞ্চিত হলেও এদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। কারণ, এখানে তাদের স্বার্থে কোনো আঘাত লাগে নি। তারা পাক শাসকদের শুকনো প্রতিশ্রুতি আর মোটা অঙ্কের হাদিয়া-তোহফার বিনিময়ে দেশীয় স্বার্থের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। বরং শেখ মুজিব যখন এ বিষয়ে সোচ্চার হন, স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেন, তারা তখন এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। পুরো একাত্তরের সময়টাতে তাদের ভূমিকা একান্ত নীরবতার, ক্ষেত্রবিশেষে সরবতার- যা আপত্তিকর। একাত্তরে এঁরা যদি ন্যায়ের ভূমিকা পালন করতেন, সক্রিয় হতেন, তাহলে দেশের এত ক্ষতি হত না।

৫। স্বাধীনতার সময়ে যেহেতু তাদের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না, তাই স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন এঁরা নীরব থাকেন। কিন্তু দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে আবার ক্ষেপে ওঠেন। তড়িগড়ি করে বঙ্গবন্ধু দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে পাঠান। কিন্তু নির্বাসিত এই কবির নানা কবিতা বাংলাদেশের পত্রিকাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। মোল্লা-মাওলানারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। দীর্ঘদিন নীরব থেকে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইনকিলাবি ভুল সংবাদে আবারও নড়ে-চড়ে ওঠেন আলেম-সমাজ। আবার যখন বিজেপি কর্তৃক ভাঙা সম্পন্ন হয়, তখনও এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এদেশের অনেক মন্দির ভাঙার নেতৃত্ব দেন।

৬। গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে খালেদার প্রথম শাসনামলে এঁরা তাসলিমা নাসরিন ও মুরতাদ-বিরোধী আন্দোলনে সরব হয়ে উঠেন। আলেম-ওলামা নীরব হয়ে গেলেও সেই নাস্তিক-মুরতাদ কিন্তু থেমে নেই, ছিল না; তারা এখনও সরব এবং সক্রিয়। একই সময়ে এঁরা এনজিও-বিরোধী আন্দোলনেও মেতে উঠেছিলেন। প্রায় এক-দেড় দশকের ব্যবধানে এনজিওগুলো দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এদের একজন নোবলে বিজয়ী, আরেকজন স্যার; অন্যান্যরাও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নানা অভিধায় ও পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন। কিন্তু আমাদের মোল্লা-মাওলানারা সৃজনশীলতার নিরিখে সৌদি আরবের ফয়সাল পুরস্কারটাও জিততে পারেন নি।

৭। নারী-অধিকার নীতিমালা, শিক্ষানীতি ইত্যাদি বিষয়েও তাদের প্রবল প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তো প্রতিক্রিয়াই। এর মাধ্যমে সৃজনী কর্ম সম্পাদিত হয় না, হবেও না। গঠনমূলক ও সৃজনশীলতা-বিমুখ লোকজন প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়েই তৃপ্ত থাকে। এ তৃপ্তি-অর্জনের ধারাবহিকতায় হয়ত সামনে আরো প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখতে হবে। নাস্তিক-মুরতাদদের ব্লগের বিরুদ্ধেও ক্ষেপে উঠেন তারা। কিন্তু যেই নাস্তিক-মুরতাদরা মূলত সৃজনশীল এবং সক্রিয়, তাদেরকে সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে মোল্লা মৌলবিরা নির্ঘাত নীরব হয়ে যাবে। হয়ত আবারও নতুন কোনো ঘটনায় তারা জেগে উঠবে, আমরা নড়ে উঠবো। এই যা! এই বাইরে কিছু নয়।

বিষয়: বিবিধ

১২২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File