হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি ও মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের বার্তা

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৪ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৪৩:৫১ রাত

হুঁট করে উঠে আসা হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি নিয়ে যে সমস্যার তৈরি হল, তা দূরবর্তী একটি প্রভাব তৈরি করবে, যা আওয়ামী লীগের জন্য খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এ কর্মসূচির অভ্যন্তরে সুযোগসন্ধ্যানী কেউ কেউ নানা অজুহাতে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির পায়তারা যে করে নি বা করবে না, তা না। কিন্তু পায়তারার অজুহাতে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের বারবার শর্ত প্রদানের প্রক্রিয়াটা এটা প্রমাণ করে দিল যে, সরকার তাদের প্রতি খুব একটা ইতিবাচক নয়।

যে সরকার ভুঁইফোড় শহুরে তরুণদের গণজাগরণ মঞ্চের জন্য সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে: চার স্তরের নিরাপত্তা দিতে পারে; যেনতেন নয়, একেবারে বিরানির ব্যবস্থা করতে পারে; জল ও মল-বিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে; একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকলেও কোনো টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করে না; সরকারি নেতারা পর্যন্ত সেখানে গিয়ে সংহতি প্রকাশের চেষ্টা করেছেন, অন্যদেরকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেই সরকারই যখন তৃণমূলে সমর্থনপুষ্ট একটি অরাজনৈতিক সংগঠনকে শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করে দূরে ঠেলে দেয়, তখন মানুষের মনে সন্দেহের দানা বাধা নিতান্ত স্বাভাবিক।

তরিকত ফেডারেশনসহ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এবং চরমোনাইর পীর সাহেব যদি নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে পারেন, তাহলে হেফাজতে ইসলামকে বাধা প্রদানের কোনো মানে হয় না। এই বাধা প্রদানের মাধ্যমে হেফাজতের সমর্থকদেরকে বিরোধী অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হল, প্রকারন্তরে যা জামায়াতকেই শক্তিশালী করতে পারে বা করবে। সরকার হয়ত ভাবতে পারে, পীর সাহেবের যে বৃহৎ সমর্থন রয়েছে, ইতিমধ্যে হেফাজতের বিরুদ্ধে প্যাডসর্বস্ব কিছু ইসলামী দল ও পার্টিও বক্তব্য দিয়েছে, তারাই সরকারকে পরবর্তী নির্বাচনের বৈতরণী পারের নিশ্চয়তা দেবে, তাহলে ভুল হবে। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেই বৃহত্তর কওমিদের সম্পর্ক। গত নির্বাচনের বিজয়ে সে-সব বেসরকারি কওমি মাদরসার আলেম-ওলামার পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা আওয়ামী লীগের ভোট-বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। এবার চাপের মুখে সে-সব বেসরকারি কওমির আলেম-ওলামা আবারও ঐক্যবদ্ধ হবার অবকাশ পেল।

বারবার বলা হচ্ছে, অভিযোগ করা হচ্ছে, হেফাজতের কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবির ও আঠারো দলীয় জোটের ইন্ধন আছে। থাকতে পারে। কিন্তু সে ইন্ধনকে ইতিবাচকভাবেও নস্যাৎ করা যেত। সরকারের দায় যেহেতু বৃহৎ, তাই সরকার এখানে উভয় কুল রক্ষার পদক্ষেপ নিলেও আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে ভিন্ন রকম অবস্থান তৈরি করতে পারত। শেষ মুহূর্তে এসেও আওয়ামী লীগ কর্তৃক হেফাজতকে কার্যকরভাবে সহায়তার পরিবেশ তৈরি করলে, সাপও মরত, লাঠিটাও অক্ষত থাকত। কিন্তু সরকারের অদূরদর্শিতায় লাঠিটা অক্ষত থাকলেও সাপটা বোধহয় মরবে না!

আওয়ামী লীগ এবং এর নানা অঙ্গ সংগঠন হেফাজতকে কৌশলগতভাবে সাহায্য করলে হেফাজতের কর্মসূচি যেমন সফল হতো, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ত। যদি অওয়ামী লীগ এ ঘোষণা দিত যে, প্রত্যেক জেলা থেকে যে বাসগুলো লংমার্চের উদ্দেশ্যে ঢাকা যাবে, এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ না থাকলেও নেতাদের সঙ্গ দেবে। কিংবা পথে পথে নিরাপত্তা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে আওয়ামী লীগ অথবা ঢাকায় প্রবেশের পর লংমার্চের নেতৃত্ব পর্যায়ের আলেমদের সঙ্গে সঙ্গেই তারা থাকবেন, তাহলে যে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা নস্যাৎ হয়ে যেত এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কোনো রকমের দ্বন্দ্ব তৈরি হত না, দূরত্ব তৈরি হত না। মাঠ পর্যায়ের আলেমদের মাঝে যখন এ বার্তা পৌঁছাতো যে, আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মবিরোধী নয়, আলেমবিদ্বেষী নয়, নাস্তিকবান্ধব নয়, তখন বিএনপি কোনোভাবেই এদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারত না এবং এখানেই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটত।

হেফাজতের লংমার্চের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার একেবারে শেষপর্যায়ে যখন সরকারের পকেটস্থ সংগঠন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম হরতালের ডাক দিল, তখন মাঠপর্যায়ে সাধারণ জনতার কাছে এমন বার্তা পৌছে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যে, আওয়ামী লীগই তা করতে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করেছে। কারণ, এ সমস্ত সংগঠনের নিজস্ব কোনো খুঁটির জোর নেই। এগুলো সবসময়ই আওয়ামী লীগের পায়ে ভর করে থাকে এবং আওয়ামী লীগের সম্মতি ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সামান্য মুরোদও এদের নেই।

ব্লগাররা সরকারেরই সমর্থক। এরা কখনোই বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেবে না। কিন্তু এই ব্লগারদের দৌড় শাহবাগ পর্যন্তই। যারা হরতাল ডেকেছে, তাদের দৌড়ও এই শাহবাগ ও মিডিয়াপাড়া পর্যন্তই। মফস্বল পর্যায়ে হেফাজতের মোল্লা-মৌলবীরাই মোড়ল, এদের কথাই বিশ্বাসযোগ্য। তাই বলা ভাল, এখানে এসে সরকার শ্যাম-কুল দুই রক্ষা করতে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মনে হচ্ছে, সরকার কুল হারাবে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না, শ্যাম শুধু মধুর কথাই বলতে পারবে, মিডিয়া মাতাতে পারবে; কার্যকরভাবে জনতাকে আকর্ষণ করতে পারবে না। জনতার সঙ্গে শ্যামের সম্পর্ক নিতান্ত নগণ্য।

আমরা যারা সব-সময়েই শান্তির প্রত্যাশী, সরকারের দিশেহারা ভাব দেখে বিমর্ষ হতে পারি। বিমর্ষ হয়ে পরবর্তী ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারি। তবে আপাত সবার জন্যই শুভ কামনা।

বিষয়: রাজনীতি

১০৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File