হেফাজতে ইসলাম, হেফাজতে ইনসানিয়াত তথা বিবেক ও মানবতা
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ০৪ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:৩৮:৫০ বিকাল
ব্লগারদের ধর্মবিষয়ক আপত্তিকর লেখাকে কেন্দ্র করে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু কার্যপরম্পরায় এমনটি হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, এদেশের মানুষজন ধর্মপ্রাণ। নিজের জীবন ধারনের স্বাভাবিক কোনো উপায় না থাকলেও মসজিদ-মাদরাসা-খানকায় দান-খয়রাতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। অবাক করার মতো বিষয় হল অযৌক্তিক কোনো কর্মকাণ্ডের বেলায় বিবেকের অনুপস্থিতি। প্রথমত বুদ্ধিজীবী খ্যাত অভিজাত মানুষদের কথাই ধরি। সব ক্ষেত্রেই আমাদের এ-সব বুদ্ধিজীবী নানা বক্তব্য দিয়ে নিজের বিবেকের জানান দেন। কিন্তু ব্লগে যে-ভাবে নবি-রাসুলের চরিত্র নিয়ে নেতিবাচকতার চর্চা অতীতেও হয়েছে, এবারও হল, এর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়াটা সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ছিল না। কেউ কেউ সামান্য কিছু বলেছেন বটে, তবে সেটা টীকাটিপ্পনি হিসাবে। অথচ ধর্ম-অবমাননাকর লেখালেখি বিষয়ে তারা পূর্বে যৌক্তিক এবং জোরালো কোনো ভূমিকা নিলে এমন অবস্থা তৈরি হত না।
তাদের পক্ষ থেকে, বা অবিশ্বাসী কারো পক্ষ থেকে হয়ত বলা হবে, ধর্ম একটি বায়বীয় বিষয়। ধরতে-ছুঁইতে যা পাওয়া যায় না, এ নিয়ে কেউ কিছু লিখলেই গুরুত্ব দিতে হবে কেন? ধর্মকে যারা এতোটাই বায়বীয় মনে করেন, তাদের মনে রাখা উচিত, দেশের সাধারণ জনতা অন্তত এ-বিষয়ে তাদের মতো নন। এসব বুদ্ধিজীবীদের মতানুসারে তাই সাধারণ জনগণ পিছিয়ে-পড়া নির্বোধ প্রকৃতির। তাই যদি হয়, তাহলে নির্বোধ লোকদের ক্ষেপিয়ে লাভটা কী? দেশের অন্ধতা দূর করার ব্যাপারে তারা কতটা সক্রিয়? দৈনিক পত্রিকায় আর টেলিভিশনে বিবৃতি-টকশোর মাধ্যমে চায়ের কাপে ঝড় তোলা যায়, মনের অন্ধকার দূর করা যায় না। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ যে বুদ্ধিবৃত্তিক আভিজাত্যের খোড়লে বন্দি হয়ে থাকেন, তাতে আমজনতা কেন, সাধারণ শিক্ষিত মানুষজনও তাদের মনস্বিতার ছোঁয়া পান না। কারণ, সাধারণ জনতার কাছে যেতে হলে যে বীর্য ও সাহস লাগে, তা এখনকার কোনো বুদ্ধিজীবীর মাঝেই নেই।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে আলেম-ওলামার কথা, যারা নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের রক্ষক হিসাবে ভেবে স্বস্তি পান। বটে, ব্লগের কারণে এদেশে বা পৃথিবীর সর্বত্রই নীতি-নৈতিকতার কোনো বন্ধন না মেনে যাচ্ছেতাই লেখা হচ্ছে। উপরন্তু নিশ্চিত কোনো কোনো লেখায় নবি ও রাসুলকে অপমান করা হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় কি শুধু নাস্তিক-মুরতাদ বলে গালি দেওয়া, সরকারের কাছে বিচারের জন্য ধরনা দেওয়া? এ-সব উঠতি বয়সী তরুণরা কেন ইসলামের প্রতি, ধর্মের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না- এনিয়ে একবারও কি তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে? শুধু বাদ-প্রতিবাদ, মিটিং-মিছিল এবং বিচার-মামলা দিয়ে কোনো মনকে তৃপ্ত করা যায় না, তুষ্ট করা যায় না, মুখ বন্ধ করা যায় না।
ধর্ম যেহেতু অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি আস্থা স্থাপন এবং এর নির্দেশনাগুলো কখনো কখনো আপাত যুক্তির বাইরেই থাকে, তাই এ নিয়ে যুক্তিপ্রবণ তরুণদের আপত্তি থাকতেই পারে। আলেম-উলামার যদি যোগ্যতা, দক্ষতা ও জ্ঞান-গরিমা থেকে থাকে, তাহলে যে-পথ দিয়ে তরুণের মনে ধর্মবিষয়ে বিতৃষ্ণা জেগেছে এবং জাগছে; প্রশ্নের উদয় হয়েছে এবং হচ্ছে, সে পথ দিয়ে এবং সে-উপায়েই তারা এর অপনোদন করুক। আর না হয়, এখন যা কিছু হচ্ছে এবং হবেও, সবই বালির বাঁধে পরিণত হবে। মুসলিম শাসনামলে- সে আব্বাসি হোক, উমাইয়া হোক বা তুরস্কভিত্তিক খেলাফত হোক- ধর্ম-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। ঔপনিবেশিক আমলে এবং এর পরবর্তী অধিকাংশ স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রেও ধর্ম-অবমাননা হয়েছে। এর বিচারও হয়েছে। কিন্তু এসব বিচারের প্রক্রিয়া ধর্ম-অবমাননাকে রোধ করতে পারে নি। কারণ, প্রতিটি সময়েই অনুভূতি-আহত ধর্মাবলম্বীরা আইনের রশি দিয়ে ধর্মকে হেফাজত করা চেষ্টা করেছেন। কথিত আঘাতকারীদের মনজয়ের চেষ্টা হয় নি। এবারেও তাই হচ্ছে।
ধর্মকে আঘাত করে বাংলা ব্লগে যা লেখা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু এর প্রতিকার করতে গিয়ে বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হল তা কি আরো দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে না বা দেবে না? যে-সব তরুণ ব্লগার বুঝে হোক, না-বুঝে হোক, ধর্মবিষয়ে আপত্তিকর লেখা লিখেছেন, তারা তো আমাদেরই মতো মানুষ, আমাদেরই সমাজের অংশ, আমাদেরই ভাই-বেরাদর। ধর্মরক্ষক কোনো মাওলানা বা তাদের কোনো গোষ্ঠী কি সে-সব ব্লাগরদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কখনো মিশতে পারেন না? হৃদয় দিয়ে মিশে তাদের মাঝে ধর্মের উদারতা ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না? এই যে এখন তাদের ধরপাকড় চলছে, দাওয়াতি আচরণ হিসাবে তাদের প্রতি কি সহানুভূতির কোনো বাণী প্রদান বা আচরণ করা যেত না?
আসলে অন্ধকার তাড়াতে গিয়ে বারবার আমরা লাঠি নিয়ে দৌড়ে যাই, আলো জ্বালাবার কথা ভুলে যাই। আর এজন্যই অন্ধকার পূর্বের মতোই রয়ে যায়, ক্ষেত্রে বিশেষে নানা আড়ালে পড়ে তা আরো ঘনিভূত হয়।
বিষয়: রাজনীতি
১০০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন