ক্ষুধার্ত নগরী এবং হরতাল (গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন মামুন আহমেদ ২৫ মার্চ, ২০১৩, ১০:৩০:৩২ সকাল

সেদিনের আকাশ ছিল অনেকটা মেঘলা। উত্তরা থেকে বাসে করে গুলিস্তান এসে নামতে না নামতে টিপ টপ বৃষ্টির ফোঁটা এসে মাথার চুল, পরিধেয় কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। গন্তব্য গুলিস্তান টু সুরিটোলা। বাহন বলতে তিন চাকার রিক্সাই একমাত্র ভরসা। তার পরও বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। কারণ বাসা পর্যন্ত রিক্সা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া বৃষ্টিতে ভিজতে খারাপ লাগেনা। তাই পা-চক্র যানে করে বাসার দিকে রওনা দিলাম।সব ক্লান্তি ভুলে অত্যাধিক আনন্দের সাথে হেটে যাচ্ছি। আজ আমার কোন ক্লান্তি নেই, কোন দুঃখ নেই! সব কোলাহল ছাড়িয়ে রুমঝুম বৃষ্টি আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে আনন্দের মহাস্রতে। আমিও আজ অনেক হ্যাপি। প্রত্যেক মানুষের জীবনের সাথে হ্যাপি শব্দের তাৎপর্য দেয়ালে পোস্টার লাগানো আঠার মত জড়িত। আঠার কার্যক্ষমতা কমে গেলে পোস্টার খসে পড়ে। আবার কেউ কেউ তেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। ঠিক তেমনি মানুষের জীবনে সুখের স্তায়িত্ত অনেক কম। কেউ মানুক আর না মানুক মানুষের অনেক দুঃখ। মানুষ সুখি হতে চায়, দুঃখ পেতে চায়না। হয়ত সুখ পালিয়ে দুঃখকে সামনে ঠেলে দেয়। মানুষ আসলেই অনেক দুঃখী।

বৃষ্টি তার আপন মহিমায় সুর বিছিয়ে আমাকে বেষ্টন করে রাখে। আমি মহা আনন্দে বাসার দিকে এগিয়ে যাছি। সুরিটোলা স্কুলের সামনে আসার পর আমার সব আনন্দ বৃষ্টির পানির মত ড্রেনের তলায় আশ্রয় খুঁজে নেয়। এক বৃদ্ধা মহিলা। হয়ত আমার মায়ের বয়সি হবে। স্কুলের দেয়ালের এক পাশে কার্নিশের নিচে বসে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা ছাপিয়ে তার চোখের জল যেন আমাকে বেশি ভিজেয়ে দিচ্ছে! অনেক বেশি! ভেজা শরীর যেন আরও ভিজে একাকার হল। তবে এই জলে আমার শরীর যতটা না ভিজেছে তার বেশি পুড়েছে। আমি ভিজতে ভালবাসি তবে পুড়ে যেতে নয়। আমি জলে ভিজতে চাই তবে চোখের জলে নয়। বৃদ্ধা মহিলার হাতে শুকনো পোড়া এক খণ্ড রুটিও দেখতে পাচ্ছি। সারাদিনের উপোষ মেটাবার সে কি নিদারুন ব্যর্থ প্রয়াস। আমি সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। পারিনি মহিলাকে নিজের মা ভেবে বাসায় নিয়ে আসতে। আসলে কেউই পারে না। তার পরও কেউ কেউ নিজেকে মানব দরদী ভেবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মিথ্যে অভিনয় করি। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করি সামান্য কয়েকটা কম্বল কিছু মানুষের মাঝে ভিতরণ করার দৃশ্য। তাও আবার শীত যখন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে ঠিক তখন। বড় অদ্ভুত ক্ষুধার্ত মানুষের নিরন্তর মুখাভিনয়। মানুষ ক্ষুধার্ত প্রাণী বটে। আমিও মানুষের কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু আমার মানবিক সহানুভূতি বলতে কিছু আছে কিনা তাতে বিস্তর সন্দেহ থাকতে পারে। সন্দেহের বাইরে কেউ থাকতে পারে না। মানুষের অত ক্ষমতা নেই, চাইলেই সে সন্দেহের সীমানা অতিক্রম করতে পারে না। আমি নিজেই নিজেকে সন্দেহ করি। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি মানুষ না .......!!

সময়ের কারেন্ট জালে জড়িয়ে চলতে চলতে জীবনের অনেক পথ পিছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু জীবনের ক্ষুধা বরাবর ১০০ হাত সামনেই আছে। চাইলেও তাকে পিছনে ফেলতে পারিনা। বছরের পর বছর চলে গেছে। জীবনের ডায়েরি যেন আগের মতই খালি পড়ে আছে। এটাই জীবনের বাস্তবতা। আবেগ দিয়ে বাস্তবতাকে দামা চাপা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কেন মিথ্যে সান্তনার আশ্রয় খুঁজি? আমি বুঝিনা কিছু! আমার সব স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই আছে। এখনও স্বপ্ন নিয়ে ফেরি করি। যেতে হবে বটতলার হাটে। ওখানে অনেক স্বপ্ন বিকোয়। চলতে চলতে সুরিটোলার সামনে এসে পড়েছি। আর একটু এগোলেই গুলিস্থান। তার পর সচিবালয় হয়ে রমনা যাওয়ার পথ। কি অদ্ভুত নিয়তি! ছয় বছর আগে যেখানে এক বৃদ্ধার চোখের জলে ভিজেছিলাম, ঠিক একই স্থানে আজ নিজ চোখের জলে ভিজলাম! রাজধানীতে হরতাল চলছে। তাই অপিস বন্ধ। মেসের বিছানায় ঘুমাতে ঘুমাতে ঘুমের প্রতি অরুচি জন্মেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার নিয়তি সেটা অস্বীকার করে বসল। রুম থেকে টেনে বের করল। যেতে বলল রমনায়। সেখানে কেয়া নামের আমার মেয়ে বন্ধুটিও আসবে। আমার মত মানুষের প্রেমিকা থাকেনা কিংবা থাকতে নেই। তাই কেয়া আমার শুধুই একজন মেয়ে বন্ধু। সে আমাকে অসম্ভব ভালবাসে। কেয়ার মুখে এমনটিই শূনে অভ্যস্থ। তাই মাঝে মাঝে আমিও তাকে বলি আই লাভ ইউ ছো মাচ! একথা শূনে ওর চোখমুখ আনন্দে ভরে ওঠে। ওর হাস্যজ্জল মুখটি দেখে আমার মাঝেও শিহরণ জাগে।

আগামী কাল কেয়ার জন্মদিন। তাকে ভাল এবং দামী একটা উপহার দিতে হবে। আমার একজন মাত্র বন্ধু। তাকে যে ভালবাসি তার প্রমাণ দিতে হবে। এমাসের ফাস্ট উইকের ১ম দুই দিন ছিল হরতাল। অফিস থেকে ১ তারিখে বেতন দিয়ে থাকে। হরতালের কারণে বেতন তুলতে পারিনি। বাড়ীতে মা আছেন। তার জন্য টাকা পাঠাতে দেরি হয়েছে। ৩ তারিখে কেয়াকে নিয়ে চাইনিজে যাওয়ার কথা, যেতে পারিনি। হরতাল যেন জীবনের সব কিছুই কেড়ে নিতে চায়! নিউ মার্কেট গিয়ে কেয়ার জন্য একটা শাল কিনবো। মেয়ে একটা বটে, শালের প্রতি যথেষ্ট দুর্বল! আজ ওকে শালটা দিয়ে চমকে দেব। ইডেনে থার্ড ইয়ারে বাংলা নিয়ে পড়ে। ভারি লাজুক মেয়ে। আমি ওর হলে যেতে পারিনা। সকলের সামনে তাকে লজ্জা পেতে দেখে আমারও খারাপ লাগে। রমনাতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখন রমনাতেই যাচ্ছি। সাথে নিয়ে যাচ্ছি কেয়ার প্রিয় শাল। প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়েই যাবো। পলটন মোড়ে এসে পড়লাম মহা বিপদে! প্রতিবাদী মানুষের উপর পুলিশের লাঠি চার্জ চলছে। আমার মত নিরীহ মানুষদেরও মুক্তি নেই। দুচারটা লাঠির বাড়ি খেতেও আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। কেয়াকে কথা দিয়েছিলাম দেখা করবো। ওর জন্য কিনেছিলাম সস্তার মধ্যে একটা শাল। শালার পুলিশ দিল সব মাটি করে। সামান্য বেতনের টাকায় থানা থেকে মুক্তি পাচ্ছিলাম না। ধার কর্য করে বিশ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু জীবনটাকে বুড়িগঙ্গার জলে ডুবিয়ে দিল। কেয়াকে কিছুই বলতে পারিনি। বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে। তার সামনে যাওয়ার মত হিম্মত আমার কাছে নেই। তার পরও দুঃসাহস দেখিয়ে ফোন দিলাম। কেয়ার কণ্ঠস্বর আগের থেকে অনেক ভারী মনে হল। কি হয়েছে তোমার? আমি জানতে চাইলাম। ওর উত্তর শূনে আমি পাথরের মত নির্বাক হয়ে যাই। মাত্র এক স্পতাহের ভিতরে জীবনের সব রং ধূসর হয়ে গেছে। কেয়ার বাবা অসুস্থ ছিল। তাই বাবাকে দেখতে বাড়ি যায়। একপ্রকার জোর করেই তাকে পাত্রস্থ করা হয়। ছেলে দুবাই ফেরত। বড় বাজারে বড় একটা ডিপার্টমেনটাল স্টোর দিয়েছে। সারাদিন অনেক বেচাকেনা হয়। ভাল টাকা প্রফিট হয়। এমন ছেলেকে জামাই বানাতে পেরে কেয়ার বাবাও অনেক খুশি।

রনি আমার ভাল বন্ধু। আমরা একই ম্যাসে থাকি। আমি যখন জেলে ছিলাম ওই তখন আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। সুদের টাকা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়েছে। সুদ ছাড়া কেউ টাকা দেয়না। হরতালের কারণে প্রায়ই অফিস বন্ধ থাকে। ঠিক সময়ে বেতন তুলতে পারছিনা। টাকা নিয়েই রনির সাথে আমার ভীষণ ঝগড়া বাধে। ও রুম ছেড়ে চলে যায়। অন্য ম্যাসে গিয়ে ওঠে। আমি এখন কি করবো? রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে থাকি। বাড়িওয়ালা ভাড়া নিতে আসে। তাকে বুঝাতে ব্যর্থ হই যে আমার কাছে টাকা নেই। তার সাফ কথা- ''এক সপ্তাহ সময় দিলাম এর মধ্যে টাকা দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।'' বাসা ছেড়ে যাবো কোথায়? না বাসা ছাড়তে পারবোনা। যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতেই হবে! নেমে পড়লাম রাস্তায়। যাবো উত্তরা। সেখানে আমার বড় বোনের বাসা। সেই এখন আমার শেষ ভরসা! বোনের একমাত্র মেয়ে শিখার হার্টে লিক ধরা পড়েছে। খুবই ভয়ংকর কথা! দ্রুত ওপেন সার্জারি করাতে হবে। নয়ত জীবন নাসের সাম্ভাবনা আছে। খালি হাতে ব্যাক করলাম। গুলিস্তান আসতে না আসতে শুরু হল বৃষ্টির কান্না। আকাশের কান্নার কাছে আমার হৃদয়ের হাহাকার কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কাক ভেজা হয়ে ম্যাসের দিকে যাচ্ছি। সুরিটোলা স্কুলের সামনে এসে আমার পা দুইটি যেন আর চলতে চায়না। মনে পড়ে দীর্ঘ ছয় বছর আগের কথা। সেই বৃদ্ধা মহিলার ক্রন্দনরত মুখয়ব ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে। তার হাতে ছিল শুকনো, পোড়া এক টুকরা রুটি। সেদিন ছিল হরতালের দিন। আজ হরতাল চলছে। জীবনের রিস্ক নিয়েই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। ক্ষুধার কাছে কোন বাধাই বাধা নয়।

বিষয়: বিবিধ

১৩১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File