জীবন চলছে কানামাছি স্টাইলে

লিখেছেন লিখেছেন মামুন আহমেদ ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:৪৩:৩৩ বিকাল

কোন একটা বয়স ছিল যখন খেইর (আমাদের স্থানীয় শব্দ ) খেলতাম! তখন ছিল কাঁচা বয়স। সমবয়সী সব ছেলে মেয়ে একসাথে খেলতাম এই খেইর। এই খেলার একটা রুলস ছিল, ক্ষণে ক্ষণে রুলস পরিবর্তন করতাম। তবে রুলস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গায়ের জোরের প্রভাব ছিল অত্যাধিক। খেলাটা আসলে সংসার খেলার মত ছিল! সংসার হচ্ছে বিশাল একটা খেলা ঘর। প্রতিনিয়ত যে যার মত নিজস্ব পজিশন থেকে সংসার খেলা পরিচালনা করে থাকে। আমরা ছেলেরা আমাদের চাচাতো বোন কিংবা পাড়াতো বোনদেরকে বউ বানিয়ে সংসার কর্ম চালিয়ে যেতাম। বাড়ীর উঠোন অথবা আঙিনাই ছিল এই সংসারের তীর্থভূমি। বাড়ীর আশে পাশের ঝোপঝাড় থেকে বকিলা (একধরণের উদ্ভিদ) দিয়ে তরকারি রান্না করতো আমাদের বউগুলো। বকিলার আকারের উপর নির্ভর করে গরু, মহিষ , ছাগল, বেড়া বলে চালিয়ে দেওয়া হত। শুকনা মাটি গুঁড়া করে চাল, ভাত করা হত। আমরা যুদ্ধে যেতাম, মাছ ধরতাম, পাখি শিকারে বের হতাম। আমাদের বউগুলো আমাদের জন্য রান্না করে অপেক্ষা করত। আমরা ফিরে আসলে তাদের মুখে হাসি দেখা যেত। তবে প্রতিদিন আমাদের বউ পরিবর্তন হত। কারণ আমাদের ভিতরে একধরণের শিশুসুলভ সারল্য ছিল যখন তখন আমাদের মানসিক সিদ্ধান্ত বা আনন্দের আপডেট হয়ে যেত। প্রতিদিন বিকালে এবং ছুটির দিনে সারাবেলা আমরা এই খেলা নিয়ে মগ্ন থাকতাম। এজন্য মায়ের বকুনিও ঝুটত।

আমরা তখন সবকিছুতে আমাদের আবেগকে প্রধান্য দিতাম। আমরাই আমাদের অভিবাবক ও পারিবারিক মেম্বার ছিলাম। কখনও মেজাজ খারাপ হলে খেলার সব সামগ্রী ভেঙ্গে তছনছ করে দিতাম। রাগ চলে গেলে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার খেলায় আত্মনিয়োগ করতাম।

মায়ের বুকের দুধ ছেড়ে ভাত খাওয়া শেখার সাথে সাথে আরও অনেক কিছুই শেখা হয়ে গেছে। অনেক কিছু দেখা হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলার সেই খেইর খেলার অভ্যাস এখনও যেন রয়ে গেছে। পরিবর্তনের মধ্যে গায়ের জোরের সাথে টাকার জোর যুক্ত হয়েছে মাত্র। দাখিল পরীক্ষার পর কলেজে ভর্তি হব। রেজাল্ট মা'শা আল্লাহ ভালই ছিল। ছিল না প্রশংসাপত্র। প্রশংসা পত্রের জন্য মাদরাসা প্রিন্সিপালের কাছে গেলাম। অবশ্য তার কাছে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। কেরানিকে ৫০০ টাকা দিয়ে প্রশংসা পত্র নিতে হবে। কিন্তু ৫০০ টাকা আমার কাছে ছিল ৫০০ কোটি টাকার মত সোনার হরিণ। তাই প্রিন্সিপালের কাছে গেলাম। তিনি আমার কথা না শূনেই, বেয়াদপ চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো- বলে তাড়িয়ে দিল। বাধ্য হয়ে কর্য করে নিতে হল প্রশংসাপত্র। কিন্তু ততদিনে কলেজে ভর্তির ডেট ওভার। ভর্তি হলাম অন্য একটা মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় পড়া যেন মহাপাপে পরিণত হল। সবখানে করুণার পাত্রে রূপান্তরিত হলাম। কোথাও কোন অধিকার নেই। যা পাই সব করুণা ছলে। আরবি পড়াতে গেলে মাসিক বেতন ৩০০ টাকা। বেশি দাবী করলে তামাশার পাত্র হতে হয়। মিলাদ, দোয়ায় দয়ার পাত্র হিসেবে ডাক পরে। পেটের দায়ে এমন ডাকেও সাড়া দিতে বাধ্য হই। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। মসজিদ টু মেস আমার দৈনিক ডিউটি। তারপর আসে ভার্সিটি ভর্তির সুবর্ণ সুযোগ! জীবনে আবার হোঁচট খেতে হয়। মাদরাসার স্টুডেন্টদের জন্য ভার্সিটি ভর্তির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে সীমিত কয়েকটা বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে। আমি মোল্লা সোসাইটির সদস্য। না আছে টাকার জোর, না আছে জ্ঞানের জোর (৩য় জোর) এবং গায়ের জোরতো আগেই হারিয়েছি পুষ্টিহীনতার কারণে। তাহলে বলা যায় বেঁচে থাকার অধিকার আমি হারিয়েছি অনেক আগেই। তারপরও বেঁচে আছি, এটাই হচ্ছে দয়া গ্রহণ করা। স্রষ্টার পৃথিবীতে সৃষ্টির দয়ায় বেঁচে থেকে কি লাভ? এর উত্তর জানা নেই। তাই হয়ত বেঁচে আছি মহাসুখে!

সমাজ যেন আজ উপহাস করছে- মাদরাসায় পড়ে তুই পঙ্গু হয়ে গেছিস! জীবনে তোর আর কিছুই রইল না, সব হারিয়ে আজ তুই নিঃস্ব! বিবেক সেটা মানতে চায় না। প্রতিবাদ করে সে বলতে চায়, সমাজটাকে বদলাতে হবে। বিদ্যার্জন শুধু দুনিয়াবি অথবা পরকালিন নয় হতে হবে উভয় মুখী। সমাজ তার ক্ষমতাবলে বিবেকের আর্তনাদকে ছুড়ে দিল। শুরু করল ষড়যন্ত্র! মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠল, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তির অথবা রাষ্ট্র থেকে সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা। এক্ষেত্রে তারা আজ অনেকটা সফল হয়েছে। ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আজ অনেক ব্লগার বনে গেছে যারা নিজ নিজ অবস্থানে ভয়ংকর মেধাবী এবং দেশের উজ্জল ভবিষ্যৎ। অন্য দিকে মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী মানেই জঙ্গিবাদী অথবা জামায়াত শিবির নয়ত আরও ভয়ংকর প্রাণী দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ! আজ যেন সকলের বিবেক মরে গেছে নয়ত আমার মত পঙ্গু হয়ে গেছে। তারা আজ ক্ষমতার কাছে ধরা দিয়েছে। কারণ তাদের সব ক্ষমতাই অক্ষমতায় ছেয়ে আছে। বিবেক হচ্ছে মানুষের আসল অভিভাবক! বিবেক যখন থাকেনা তখন মানুষ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। আমরাদের অবস্থাও ঠিক তেমন। তবে আমরা বলি, আজকের তরুণ প্রজন্মরাই আগামির অভিভাবক। অথচ তাদেরকে গড়ে তোলা হয় লোভী করে। হয় দুনিয়ালোভী নয় আখেরাতলোভী! মজার ব্যপার হচ্ছে লোভ হল সকল পাপের মা।

কথাগুলো কেমন গুলিয় যাচ্ছে। মাফ করবেন পাঠক!

আমাদের সরকারের দায়িত্বে যারাই আসেন তাদের সকলেরই একটাই যেন লক্ষ্য থাকে, ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভকে চরিতারথ করা। সামরিক শক্তি বলে তারা বিরোধী দলকে ধমিয়ে রাখতে মরিয়া থাকে। অন্যদিকে বিরোধী দল সরকারের যে কোন কাজের বিরোধিতা করেই আত্নতৃপ্তি লাভে অভ্যস্থ। জনগণ তখন ছাগলের ৩ নম্বর বাচ্চার মত এতিম হয়ে যায়। আর এতিমের কাজ হল মানুষের দয়া নিয়ে বেঁচে থাকা। আজ জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর দয়া নিতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে করে! না হলে কি আর বার বার তাদের ফাঁদে পরে কাঁদে? সাধারণ জনগণের সরলতাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলগুলো আজ খেইর খেলে মজা লুটছে। নিজেদের স্বার্থের বিরোধী কিছু হলেই জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে মেতে উঠছে। আর হাছন রাজার গান গাইছে- ''কানাই তুমি খেইর খেলাও ক্যান......''

বিষয়: রাজনীতি

১৩৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File