নাটোরের কাচাগোল্লা
লিখেছেন লিখেছেন মিশেল ওবামা বলছি ২০ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:১৪:৪১ সকাল
দেশে যে ক'টি সুস্বাদু মিষ্টি জাতীয় খাবারের বেশ নামযশ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম নাটোরের কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার কারনে নাটোরকে এক নামে চেনে মানুষ। একবার যে নাটোরের কাঁচাগোলার স্বাদ নিয়েছে তাকে এ সুস্বাদু মিষ্টি খেতে বার বার টানবে। আর যাই হোক কাঁচাগোল্লা সারা দেশেই বিখ্যাত মিষ্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
নাটোরের কাঁচাগোল্লা নাটোরের বনলতা সেনের মতোই আলোচিত, আদৃত। বাঙালি ভোজনপ্রিয়, অতিথি আপ্যায়নেও এর জুড়ি নেই।
কাঁচাগোল্লা গোল নয়, লম্বা নয়, আবার কাঁচাও নয়। তবুও নাম তার কাঁচাগোল্লা। এ নামেই পরিচিতি দেশ-বিদেশে। আনুমানিক আড়াইশ' বছর আগেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। তবে ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে।
কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনী। নিতান্ত দায়ে পড়েই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দু'মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনের জন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেননি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তা-ভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর আগে ছানাকে কিছুই করতে হয়না অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়। কাঁচা ছানা রসে ডোবানো হয়েছে বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছিলো কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এতে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে শুরু করেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা। ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া, প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় রাজা-জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারে পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সে সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, এই জন্য দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি।
তবে কেউ নাটোরে বাসের ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে প্রতারিত হবেন না। নাটোর শহরে ঢোকার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় ফেরিওয়ালাদের উপদ্রব।
এ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে, আমাদের সাথে এক বয়স্ক দম্পতি আসছিলেন বগুড়া থেকে। ভদ্রলোক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কাঁচাগোল্লা কিনবেন না, আর ভদ্রমহিলা ছাড়বেন না। শেষ-মেষ কিনেই ফেললেন। ফেরিওয়ালা নেমে যাওয়ার পর আনেকেই বলতে লাগলো, যে এটা আসল কাঁচাগোল্লা নয়, এর কোয়ালিটি খুব খরাপ ইত্যাদি ইত্যাদি...। তখন ভদ্রলোক উনার ওয়াইফের সাথে বাসের মধ্যেই সে কি তুমুল ঝগড়া। কাহিনীটা মনে হলে আজও খুব হাসি পায়...।
যাই হোক, যদি কেউ কাঁচাগোল্লা কিনতে চান, জয় কালীবাড়ি দ্বারিক ভান্ডার থেকে কিনতে পারেন। ওরা আজও কোয়ালিটি অনেকটাই ধরে রেখেছে। নাটোরের আর একটা দোকানের মিষ্টি আমার মত মিষ্টি বিরাগী মানুষও না খেয়ে থাকতে পারি না সেটা হলো, মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি। নাটোরে কেউ এলে টেস্ট করতে ভুলবেন না যেন, নাটোরের কাঁচাগোল্লা আর মৌচাকের মিষ্টি...
বিষয়: বিবিধ
৩৩০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন