আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা

লিখেছেন লিখেছেন যযবর ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:০৮:০৬ বিকাল

সেটা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়া একজন সাংবাদিক একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। যাতে তিনি উদ্ধৃতি দেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা একটি কবিতা থেকে :

বন্ধু তোমার উদ্বেগ ছাড়ো

সুতীক্ষè করো চিত্ত,

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি

চিনে নিক দুর্বৃত্ত।

বিষয়টি আমার কাছে বেমানান মনে হয়েছিল। কারণ সুকান্ত এই কবিতা লিখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। যখন জাপান বার্মা (মিয়ানমার) জয় করে এবং এসে যায় ব্রিটিশ বাংলার সীমান্তে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি জাপানকে রুখবার আওয়াজ তোলে। সহযোগিতার হাত বাড়ায় ব্রিটিশ রাজের সাথে। যেটি সেই সময় এ দেশে অনেকেরই মনঃপূত হয়নি। কারণ এ উপমহাদেশ তখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। তাই জাপানের সাথে যুদ্ধকে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরা যুক্তিযুক্ত ছিল না। অন্য দিকে সুভাষ চন্দ্র বসু জাপানের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী, যার ওপর ভারতের এবং বিশেষভাবে বাংলার হিন্দু তরুণ সমাজের ছিল বিশেষ সহানুভূতি। কারণ সুভাষ বসু ছিলেন বাঙালি। যে দৃষ্টিকোণ থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-৪৭) তার কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটি ছিল তখনকার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাচেতনাপ্রসূত। এ সময় ভারতের কমিউনিস্টরা বিবেচিত হচ্ছিলেন ব্রিটিশ রাজের অর্থপুষ্ট স্বদেশ বিরোধী দল হিসেবে। ভারতের কমিউনিস্টরা বলছিলেন, বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক শিবিরে আছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্য শিবিরে আছে ইতালি, জার্মানি ও জাপান। যদি ইতালি, জার্মানি ও জাপান যুদ্ধে জিতে যায়, তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে না। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকার অর্থ হবে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পিছিয়ে যাওয়া। সমাজতন্ত্রের স্বার্থে করতে হবে ব্রিটিশ রাজের সহযোগিতা। ক’দিন আগে আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে আবার আওড়াতে শুনলাম সুকান্তের কবিতাটির ওই ছত্রগুলো। তিনিও পাক বাহিনীর সাথে না জেনে তুলনা করতে চাইলেন যেন জাপানি সৈন্যদের। কারণ সুকান্ত যখন তার কবিতাটি লেখেন, তখন পাকিস্তান বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। সুকান্তের কাছে দুর্বৃত্ত ছিল জাপানি সৈন্যরা। সুকান্তের ‘বোধন’ নামে একটি কবিতা আছে। এতে তিনি বলেছেনÑ

এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি

নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;

কোথাও নেইকো পার

মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘনঘন বন্যার

আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,

এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,

ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,

হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।

সুকান্ত কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রামের মতবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার চিন্তায় আবার প্রভাব বিস্তার করেছিল মহামানববাদ, যা বলতে চায় মানব ইতিহাস পরিচালিত হচ্ছে, মহামানব দিয়ে। যারা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যারা সাধারণ মানুষের মতো নয়। এই মহামানববাদ অনুসারে হিটলার ও মুসোলিনিকে তাদের দেশের মানুষ মনে করত মহামানব (Superman)। যেটি মার্কসীয় চিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রশ্ন হলো, সুকান্ত কাদের মনে করেছিলেন মহামানব। সুকান্তের কাছে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে মনে হতে পেরেছিল একজন মহামানব। তিনি ‘জিন্নার প্রতি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যাতে তিনি বলেন :

যুযুধান দেশকে আজ নির্বিরোধ

কুচক্রান্ত ছড়ায় রাত্রিচারী

মিথ্যার মদে ভুলবে না নির্বোধ

দিনরাত্রি যে বিদ্যুৎ সঞ্চারী।

তপস্যা শেষ, ভাঙ্গো আজ মৌনতা,

দুর্গের দ্বার খোল বিনিদ্র দ্বারী,

শত্রুরা মূঢ়, সম্ভাষে স্বাধীনতা,

আমরা জয়ের সাগরে জমাবো পাড়ি,

আজকে এদেশ শুনেছে যে ব্রত কথা

সোনার খাঁচার সাথে তাইতো আড়ি।

আমাদের দেশে অনেক বামপন্থী জানেন না যে, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪০-এর দশকে তদানীন্তন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন, যা সুকান্তকে অনুপ্রাণিত করেছিল ‘জিন্নার প্রতি’ কবিতাটি লিখতে। আজ এ দেশের কমিউনিস্টরা পাকিস্তান আন্দোলনকে চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন হিসেবে। কিন্তু অতীতে তাদের পূর্বসূরিরা সেটি করতে চাননি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে এ ঘটনাটি মনে রাখা প্রাসঙ্গিক। কারণ একদল বাম চিন্তক পালন করছেন বর্তমান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা। আমরা জানি, কমিউনিস্টরা উদার গণতন্ত্রকে বলতে চান বুর্জুয়া গণতন্ত্র। তারা উদার গণতন্ত্রে আস্থাশীল নন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টির মূলে আছে এই চিন্তার প্রভাব। কার্ল মার্কস ঠিক গণতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন না। তিনি ব্রিটেনে যে চার্চিস্ট আন্দোলন হয়েছিল, তাকে করেছিলেন সমর্থন। বিলাতের মুক্ত পরিবেশে কার্ল মার্কসের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ক্যাপিটাল-এর মতো গ্রন্থ রচনা। তিনি ইংল্যান্ডে কাটান তার জীবনের সুদীর্ঘ সময়। এবং মারা যান লন্ডন শহরে। বিলাতের গণতন্ত্রকে বিশেষভাবে বড়লোকের (বুর্জুয়া) গণতন্ত্র বলে সমালোচনা করেছেন লেনিন; কার্ল মার্কস নন। আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা, যারা শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করছেন, তারা হলেন মূলত লেনিনবাদী। আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে এদের চিন্তা দিয়ে। এটি খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও এরা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছেন লেনিনবাদী চিন্তাচেতনাকে। আমরা জানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিকের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে রাশিয়া ছিল সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী। এখন রুশরা চাচ্ছেন তাদের দেশে উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। লেনিনবাদ তার নিজের দেশেই আজ হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে অনাদ্রিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লেনিনবাদী চিন্তা বাংলাদেশে পেতে পারছে বিশেষ মর্যাদা। আর তা সৃষ্টি করতে পারছে উদার গণতন্ত্রের সঙ্কট।

সুকান্ত এখন জীবিত থাকলে তার মত কী হতে পারত, সেটি জল্পনারই বিষয়। কিন্তু এখানে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাচ্ছি। ১৯৬০-এর দশকে এ উপমহাদেশের কমিউনিস্টরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক ভাগকে বলা হতে থাকে মস্কোপন্থী আর এক ভাগকে বলা হতে থাকে পিকিং (বেইজিং) পন্থী। সুকান্ত হয়তো পিকিংপন্থীদের পক্ষেই যেতেন। কারণ তার পরিবারের অনেকেই যোগ দেন পিকিংপন্থীদের সাথে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় তার আপন ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা, যিনি পরে হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের ও আমাদের দেশের পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। চীনের বিখ্যাত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ঘোষণা করেন, বহিরাক্রমণ থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য গণচীন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নেতা মুহাম্মদ তোয়াহা ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বলেন দুই কুকুরের লড়াই। কেবল যে জামায়াতে ইসলামীর মতো দল সাবেক পকিস্তান ভেঙে যাওয়া চায়নি, তা নয়। বামপন্থীদের একটি অংশ ছিল সাবেক পাকিস্তান ভাঙার বিরোধী। এখানে বলা যেতে পারে, মহাচীন সরকার, শেখ মুজিব বেঁচে থাকাকালে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর চীন বাংলাদেশকে দিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি। চীন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট। ১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে হিমালয় সীমান্তে যুদ্ধ হয়। চীন ও ভারতের মধ্যে এখনো শেষ হয়নি সীমান্ত বিরোধ। চীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো চাচ্ছে তার ভূমিকা রাখতে। চীনের রাষ্ট্রদূত তাই বলছেন, আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে ইচ্ছুক। বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব বেশ স্পষ্টই ধরা পড়ছে। চীন খালেদা জিয়াকে যেভাবে সমর্থন দিচ্ছে, শেখ হাসিনাকে সেভাবে দিচ্ছে না। অন্য দিকে ভারত শেখ হাসিনাকে যেভাবে সমর্থন দিচ্ছে, খালেদা জিয়াকে সেভাবে দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। সেও বর্তমানে নিচ্ছে না শেখ হাসিনার পক্ষ। বাংলাদেশ নিয়ে তারও দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে ভারতের সাথে। আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটকে বিশ্লেষণ করতে হলে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে উপলব্ধিতে রাখা প্রয়োজন।

আমরা আলোচনা করছিলাম সুকান্তকে নিয়ে। সুকান্ত জন্মেছিলেন কলকাতায়, বেলেঘাটা অঞ্চলে। কিন্তু তার পূর্বপুরুষ (দাদু) কলকাতায় গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জ থেকে। সুকান্তের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল গোপালগঞ্জের উনশিয়া গ্রামে। শেখ মুজিব জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। এদের বলা যায় একই অঞ্চলের লোক। হতে পারে সুকান্ত বেঁচে থাকলে লিখতে পারতেন শেখ মুজিব নিয়েও কিছু। তবে ১৯৭১ সালে পিকিংপন্থী জ্যোতি বসু ও তার সাগরেদরা (যার মধ্যে পড়েন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) শেখ মুজিবকে সমালোচনা করেছিলেন সিআইএ-এর চর হিসেবে।

১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ হয় মস্কোপন্থী আর এক ভাগ হয় পিকিংপন্থী। তাজউদ্দীন আহমদ যোগ দেন মস্কোপন্থীদের সাথে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে স্থাপিত হয় মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রাধান্য। এ সময় মস্কোপন্থীদের সাথে ভারতের কংগ্রেস দলের গড়ে ওঠে বিশেষ সখ্য, যার জের চলেছে এখনো। সাবেক মস্কোপন্থীরা এখন চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ এ কারণে হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে ভারতঘেঁষা। বাংলাদেশে এখন আর পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা নেই। পিকিং ঐতিহ্যবাহী কমিউনিস্টরা প্রায় সবাই যোগ দিয়েছেন বিএনপির সাথে। তবে এরা বিএনপির নীতিনির্ধারক নন। পিকিংপন্থীরা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ছিলেন প্রভাবশালী। বিএনপিও বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে প্রভাবশালী দল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বিশেষ সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেছিল ইসরাইলের কাছ থেকে। বর্তমান আওয়ামী লীগও শোনা যায় ইসরাইলের কাছ থেকে নাকি পেতে পারছে বেশ কিছু সাহায্য-সহযোগিতা। ১৯৭১ সালে ইসরাইল চেয়েছিল সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। কারণ ইসরাইল সব সময় চেয়েছে পাকিস্তান বিলুপ্ত হোক। এর কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৪৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। ইসরাইল ১৯৪৯ সালের ১১ মে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। ইসরাইল সদস্যপদ লাভ করেছিল জাতিসঙ্ঘের সাধারণ ভোটের মাধ্যমে। পাকিস্তান এ সময় ইসরাইলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তান সব সময় থেকেছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ ইসরাইলবিরোধী। ইসরাইল ভারতের মতোই প্রচার করছে, বাংলাদেশে হাসিনা সরকার না থাকলে মুসলিম মৌলবাদী শক্তির উদ্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও ইসরাইল একইভাবে প্রচার করছে মুসলিম মৌলবাদভীতি। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এদের মতোই মুসলিম মৌলবাদ ভীতিকে প্রচার করে চলেছে। আমাদের মিডিয়া বিশেষভাবে প্রচার করছে মুসলিম মৌলবাদভীতি। শোনা যাচ্ছে, ইহুদি লবি নাকি অর্থলগ্নি শুরু করেছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন সংস্থায়। ১৯৭১ সালে সব ইহুদি লবি নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকায় করা হয়েছিল পাক বাহিনীর বিপক্ষে প্রচার। ইহুদি প্রচারমাধ্যম তখন ছিল জোরালো। আর এখনো তার প্রচারমাধ্যম যথেষ্ট জোরালো হয়েই আছে। আমাদের দেশের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে হলে ইহুদি ফ্যাক্টরকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশকে তার প্রভাব বলয়ে রাখতে। আর এ জন্যই ভারতের সাথে সৃষ্টি হতে পারছে বাংলাদেশ নিয়ে তার বিরোধ। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেবলই ভোটের রাজনীতির দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে যাচ্ছে, এরকম ভাববার কারণ নেই। যদিও আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতাকে বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছেন ভোটযুদ্ধ দিয়ে। কিন্তু এ বিশ্লেষণ আমার কাছে মনে হচ্ছে খুবই অকিঞ্চিৎকর। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হতে না হতেই দেখা গেল কয়েকটি স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা। হিন্দুরা থানায় পুলিশের সাহায্য চাওয়া সত্ত্বেও পুলিশ যথাসময়ে গিয়ে উপস্থিত হতে পারল না। প্রচার করা হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুনিধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ১৯৭১ সালে যতগুলো যুক্তি দিয়ে ভারত চেয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্য পাঠাতে, তার মধ্যে একটি ছিল হিন্দু রিফিউজিদের দেশে (বাংলাদেশে) ফেরত পাঠানো। অনুরূপ যুক্তি ভারত এখনো দেখাতে চাচ্ছে কি না, আমরা তা জানি না। তবে তেমন অবস্থার সৃষ্টি ভারত করতে যে না পারে, তা নয়। ভারতের সৈন্য বাংলাদেশে এলে আওয়ামী লীগ পেতে পারবে রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ রকমই মনে করছেন অনেক চিন্তক ব্যক্তি।

অনেক কিছুই ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন ক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার দু-তিনজন মন্ত্রী নাকি হলেন জামায়াতপন্থী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোট একচেটিয়াভাবে পেতে। আর এর জন্য তিনি জামায়াতকে দিতে চাচ্ছেন প্রশ্রয়। ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ আসন যদি তিনি লাভ করতে পারেন, তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হতেও পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কেননা ভারতের আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যেতে পারে। আর ভারতে কোনো দলই একক প্রাধান্য অর্জন নাও করতে পারে। ভারতের কেন্দ্রে সে ক্ষেত্রে গঠিত হতে হবে কোয়ালিশন সরকার। আর এ কোয়ালিশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেতে পারেন বিশেষ সুযোগ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটার পথ স্পষ্ট করতে চাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোটারদের নিজ পক্ষে পেয়ে। বিষয়টিকে কেবলই কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পাকিস্তান সফর করার জন্য। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে বিএনপিকে বলছে জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগ করতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যদি জামায়াত প্রভাব বাড়ে, তবে বাংলাদেশে তার প্রভাব এসেই পড়বে। পশ্চিমবঙ্গ পকিস্তান লাগোয়া অঞ্চল নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নওয়াজ শরিফের আমন্ত্রণ তাই অনেকের কাছেই মনে হতে পারছে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকেও রাখতে হবে আমাদের বিবেচনায়

এবনে গোলাম সামাদ

প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

(নয়া দিগন্ত, ১৩/০১/২০১৪)

বিষয়: বিবিধ

১২৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File