আত্মহত্যা এবং অন্যান্য...

লিখেছেন লিখেছেন আকরাম ৩০ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:৩৮:১৫ দুপুর



স্বেচ্ছায় নিজ জীবনাবসানের নামই আত্মহত্যা। আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা। কোন প্রাণীর নিজেকে নিজেই হত্যা করাকে আমরা আত্মহত্যা বলে থাকি। অনেকের মতে নিজ আত্মাকে হত্যা করার নামান্তর আত্মহত্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুসারে, আত্মহত্যা হলো স্বজ্ঞানে এমন একটি ভয়ানক কাজ করা যা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় এবং ব্যক্তি ঐ কাজের প্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে পূর্ব থেকেই পুরোপুরি অবগত থাকে। আবার নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা আর কষ্ট দিয়ে নিজেকে হত্যার নাম “আত্মহত্যা” বলে

থাকেন অনেকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, আত্মহত্যা একটি অপ্রতিরোধ্য সামাজিক এবং মানসিক ব্যাধি। অনেকেই একে সমস্যার সমাধান মনে করলেও এটি কোন সমস্যার সমাধান নয় বরং সমস্যার কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার প্রচেষ্টা (Attempt to suicide) এবং প্রতি মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে। সারা বিশ্বে বছরে ৮৭৩০০০ লোক আত্মহত্যাজনিত কারণে প্রাণ হারায়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সকল দেশের প্রচলিত আইনেই আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আত্মহত্যা নিয়ে যে পরিসংখ্যান দাঁড় করানো হয়েছে তা থেকে দেখা যায় যে এই ৮ বছরে প্রতিবছর দেশে গড়ে ১০ হাজার ৪শ’ ৮৪ জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ঝিনাইদহ জেলায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা যায় যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের অধিকাংশই মানসিকরোগে আক্রান্ত থাকে।যারা অধিকাংশই পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবের কাছে আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে থাকে। পরিসংখ্যানে আরো পাওয়া যায় যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৮০ ভাগই আত্মহত্যার পূর্বাভাস দিয়েছে কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে কেউ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। মানুষ যখন হতাশায় আক্রান্ত হয় এবং সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার আর কোন পথ খুজে না পায়, চারপাশে কাউকে আপন করে না পায় তখনই কেবল এই পথ বেছে নেয়।আত্মহত্যার পূর্বে ব্যক্তি নানাভাবে সিগন্যাল দেয় একটু লক্ষ্য করলেই তাকে বাচানো সম্ভব।

আত্মহত্যা একটি মানসিক সমস্যা হলেও সম্পূর্ণরূপে নয়, তবে হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করে মন। যখন একজন মানুষ তার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যে কোন পথ খোলা পায়না, তখন তা হতাশার তৈরী করে। আর এই হতাশা তার ভিতরের aggressive ভাবটাকে বাড়িয়ে দেয় তখন যদি কেউ যুক্তি দিয়ে তাকে না বোঝায় যে তার সমস্যার সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

মানসিকভাবে আত্মহত্যাকে যেভাবে দেখা হয়ঃ

মানুষের ভিতর গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক দুটি স্বত্তা কাজ করে। তবে সবার ব্যক্তিত্ব সমান নয় বলে সাধারনত কোন একটা সত্তা ব্যক্তির মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে কখনও পরিবেশগত বা মানসিকগত কারণে এই বৈশিষ্ট্য একটা আরেকটার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকতে পারে।

মানুষের ক্রোধ যখন তার ভিতরটাকে কুড়ে কুড়ে খায় তখনই সে সাধারণত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে এই সময় তার পেছনে আশাহীনতা, হতাশা, অপরাধবোধ, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি সক্রিয় থাকে। তখন সে জীবনটাকে অর্থহীন মনে করে, তাই সে পেতে চায় জীবন থেকে মুক্তি। তবে অনেক মনোবিজ্ঞানী এর পিছনে “Bipolar Disorder” -কে দায়ী করেন। তাদের মতে যারা বিষন্নতা এবং একই সাথে হর্ষোম্মতায় পালাক্রমে ভোগেন তাদের মধ্যেই এই প্রবণতা অধিক হারে দেখা যায়। Neurochemist -দের মতে Serotonin (যা বিপাক ক্রিয়ার একটি উপজাত) -এর সাথে আত্মহত্যার একট গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ব্রেইনে অস্ত্রোপাচার করে এই Serotonin -এর ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। অপর কিছু সংখ্যক গবেষণায় দেখা গেছে যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করতে চায় তারা সাধারণত সমস্যা সমাধানের ব্যপারে অন্যান্যদের চেয়ে বেশি rigid এবং চিন্তাধারায় তারা কম নমনীয় থাকেন। ফলে তারা সমাধানের বিকল্প উপায়গুলো সহজে তাদের চোখে পড়েনা।

জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। ১০ শতাংশ সিজোফ্রেনিক রোগী আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৪০ শতাংশ রোগী অসুস্থ থাকা অবস্থায় অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে যাদের বিষণ্ণতার উপসর্গ থাকে, তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। অনেক সিজোফ্রেনিক রোগী ‘গায়েবী আওয়াজ’ শোনে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে ‘Auditory Hallusination’ বলা হয়। অনেকে শোনে, কেউ তাকে উপদেশ বা আদেশ দিচ্ছে আত্মহত্যা করতে। অনেক রোগীই এই ‘গায়েবী’ আদেশটি অবশ্য পালনীয় হিসেবে গণ্য করে। অনেক সিজোফ্রেনিক রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক সন্দেহ ও ভয় থাকে, যা তাকে পর্যায়ক্রমে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, একাকী করে রাখে, যাতে রোগী এক সময় আত্মহত্যা করে। আবার কোন কোন রোগী সুস্থ হওয়ার পর্যায়েও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। কারণ, এ সময়টায় অনেকের রোগটি সম্পর্কে ধারণা হয়, ফলে নিজেদের অন্যদের চেয়ে আলাদা ও অস্বাভাবিক মনে করে।

সবচেয়ে যে কারনে বেশী মানুষ আত্মহত্যা করে তার নাম বিষন্নতা।বিষণ্ণতা মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ এবং ধ্বংসাত্মক একটি রোগ। কারণ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি জীবন চলার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং কোনো কোনো রোগী অবলীলায় আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে এবং কখনো কখনো সফল হয়। তাই আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো বিষণ্ণতা রোগটি পৃথিবীতে এক নম্বর ‘কিলার ডিজিজ’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। যেকোনো লোক যেকোনো সময়ে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে শতকরা ১০০ ভাগ রোগীই ভালো হয়ে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা। সাধারণত দু’ভাবে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা করে আর একটি হলো তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা তাড়নায় ইমপালসিভ আত্মহত্যা। পরিকল্পনাকারীদের মনে প্রথমে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে, ইচ্ছার পর পরিকল্পনা করে সে, তার পর আত্মহত্যার জন্য attempt গ্রহণ করে। বড় ধরনের বিষণ্ণতা রোগের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা।

আত্মহত্যা সম্পর্কে ধর্মে যা আছেঃ

ইসলাম ধর্মঃ ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিনামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। সূরা নিসা ২৯-৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে উহা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য।”

হাদিসে বলা হয়েছে-

ক) সাহাবা আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ঐভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে।

খ) যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ঐভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে।

গ) যে কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।

ঘ) রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে।

ঙ) হযরত জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।

চ) জাবের বিন সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ রাসূল (সঃ) এর নিকট এমন এক ব্যক্তির লাশ আনা হলো যে লোহার ফলা দ্বারা আত্মহত্যা করেছে, রাসূল (সঃ) তার জানাযার নামায পড়ান নি। (বুখারী ও মুসিলম)

ছ) আত্মহত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারাম। জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ নবী (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন; একজন ব্যক্তি জখম হলে সে অধৈর্য হয়ে আত্মহত্যা করে, এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা বলেন; আমার বান্দাহ আমার নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই নিজের জীবনের ব্যাপার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম। (বুখারী)

জ) ব্যক্তি যে বস্তু দ্বারা আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামে তাকে সেই বস্তু দ্বারা শাস্তি দেওয়া হবে। কেউ বিষ পান করে মারা গেলে তাকে জাহান্নামে বিষ পানের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে। অর্থাৎ উক্ত বস্তু তার হাতে দেওয়া হবে, ব্যক্তি বার বার ঐ বস্তু দ্বারা আত্মহত্যা করতে থাকবে। ছাবিত বিন যাহ্হাক (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম (সঃ) বলেন; যে ব্যক্তি কোন লৌহ অস্ত্রাঘাতে আত্মহত্যা করবে তাকে সেই লৌহ অস্ত্র দিয়েই জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। অর্থাৎ যেভাবে লৌহ অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, ঠিক সেভাবে সে জাহান্নামে আত্মহত্যা করতে থাকবে। ( বুখারী)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি শ্বাসরোধ (গলায় ফাঁস দিয়ে) করে আত্মহত্যা করবে, যে জাহান্নামে এভাবেই আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামে এভাবেই আত্মহত্যা করতে থাকবে।(বুখারী)”

ঝ) কোন মুমিন ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করা অথবা কোন মুমিনকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হত্যা করার সমান পাপ।

ছাবিত বিন যাহ্হাক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সঃ) বলেছেন “যে ব্যক্তি যে বস্তু দ্বারা দুনিয়ায় আত্মহত্যা করবে তাকে কিয়ামতের দিবসে সেই বস্তু দ্বারাই শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তিকে অভিসম্পাদ করলো সে যেন তাকে হত্যা করে ফেললো, আর যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তিকে মিথ্যা অপবাদ দিলো সেও যেন তাকে হত্যা করে ফেললো। (বুখারী)”

খৃষ্ট ধর্মঃ খৃষ্টান ধর্মে বাইবেল অনুযায়ী, আত্মহত্যা নিশ্চিত করে না যে একজন ব্যক্তি স্বর্গে প্রবেশের অধিকার পাবে কি না৷ যদি কোনো অসংরক্ষিত ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, তবে সে শুধুমাত্র নরকের দিকে নিজের যাত্রা “ত্বরান্বিত” করা ছাড়া আর কিছুই করল না৷ যদিও, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করল সে প্রভূ খ্রীষ্টকে নিজের মুক্তিদাতা হিসেবে অস্বীকার করেছে বলেই নরকে যাবে, আত্মহত্যা করার জন্য নয়৷ যে খ্রীষ্টান আত্মহত্যা করে তার সম্পর্কে বাইবেলে বলা হয়েছে, বাইবেল আমাদের শেখায়, যে মুহূর্ত থেকে আমরা প্রভূ খ্রীষ্টকে বিশ্বাস করতে শুরু করবো, আমরা শাশ্বত জীবন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাব (জন্ 3:16)৷ বাইবেল অনুযায়ী, খ্রীষ্টানরা দ্বিধাহীনভাবে জানে যে তারা শাশ্বত জীবনের অধিকারী (1 জন্ 5:13)৷ কোনো কিছুই একজন খ্রীষ্টানকে ঈশ্বরের ভালোবাসা পাওয়ার থেকে বিরত রাখতে পারে না (রোমানস্ 8:38-39)৷

আত্মহত্যা হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে একটি ভয়ানক পাপ৷ বাইবেল অনুযায়ী, আত্মহত্যা হল খুন; এইটি সবসময়েই ভুল৷ কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে খ্রীষ্টান বলে দাবি করা সত্ত্বেও আত্মহত্যা করে তবে তার বিশ্বাসের উৎকর্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগবে৷

ষষ্ঠ শতকে খ্রিস্টধর্মে আত্মহত্যাকে খুন হিসেবে উল্লেখ করে নিজেকে হত্যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারীর শেষকৃত্য না করার জন্য। ষষ্ঠ শতকে খ্রিস্টানের গির্জা আত্মহত্যাকে অনৈতিক ও খুন হিসেবে চিহ্নিত করে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়; এমনকি ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত এই ধর্মের অনুসারী কেউ আত্মহত্যা করলে তার শেষকৃত্য পর্যন্ত করত না।

সনাতন ধর্মঃ সনাতন ধর্মে পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে, রামের মৃত্যুর পর অযোধ্যায় গণহারে আত্মহত্যা করে মানুষ। কিন্তু মহাভারতে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অনাহারে আত্মহত্যার চিন্তা করলে যুধিষ্ঠিরকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পরিকল্পনা বাতিলের পরামর্শ দেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্থাৎ হিন্দুধর্মেও আত্মহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মঃ গৌতম বুদ্ধের “অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ” এই মতবাদ মতে নিজ জীবন বা অন্য কোন জীব হত্যাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আবার অনেকের মতে বৌদ্ধ ধর্মে (সদ্ধধর্ম) যদিও আত্মহত্যায় উৎসাহিত করা হয় না, তবে এই ধর্মে আত্মহত্যাকে একেবারে নিষিদ্ধও করা হয়নি।

এমনকি ইহুদিরাও আত্মহত্যাকে পাপকর্ম বলেই মনে করে।

আত্মহত্যা সম্পর্কে আইন যা বলেঃ

আইনের চোখেও আত্মহত্যার প্রচেষ্টাগ্রহণকারী একজন অপরাধী। আত্মহত্যার পর যেমন থানায় খবর দিতে হয়, তেমনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও থানায় খবর জানানোর কথা বলা হয়েছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও আইনটির প্রয়োগ নেই দেশে। সচেতন নয় মানুষ, সচেতন নয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। পেনাল কোড ৩০৯ ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করিবার উদ্যোগ করে এবং অনুরূপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদন্ডে- যাহার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ড বা উভয়বিধ দন্ডে দণ্ডিত হইবে। অর্থাৎ আইন নিজের জীবন হরণের চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং এ কারণে যে তার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করার অধিকার তার নেই। কারণ এতে অপরাধ সংঘটন করে নিজেকে রেহাই দিতে উদগ্রীব হবে। এতে অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। গবেষণায় আরও দেখা যায়, যে পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আর আত্মহত্যা প্রবন মানুষ তারও ১০ গুণ বেশী। তবে আত্মহত্যার চেষ্টার পর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি নিজেই হিনমন্ন্যতায় ভুগে। আর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা মানুষের অনেক কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা থাকে। তখন তাকে এসব আইনে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠালে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়তে হয়। এ সময় তাদের পরিবার পরিজনরাও বাঁধা দেন। তবে আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর ধরণ বুঝে এ ধরনের মামলা হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে প্রচলিত দন্ডবিধির (পেনাল কোড) ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যা প্ররোচনার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে অনুরূপ আত্মহত্যা অনুষ্ঠানে সহায়তাকারী ব্যক্তির ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। ৩০৫ ধারায় বলা হয়েছে, শিশু বা পাগল বা মাতাল ব্যক্তির আত্মহত্যার প্ররোচনাদানকারীকে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা যাবে

আত্মহত্যা সম্পর্কিত কিছু তথ্যঃ

১- মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে তিনগুন আত্মহত্যার চেষ্টা করে কিন্তু মরেনা। আর আত্মহত্যার হার মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশি(তবে বর্তমানে মেয়েদের আত্মহত্যার হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে)

২- যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা সাধারণত দ্বিতীয়বার আর সে মুখী হয়না।

৩- যুবক বয়সে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করে কিন্তু সফল বেশি হয় বয়ষ্করা।

৪- যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বিশ মিনিটে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও দেখা যায় তারা প্রতি দুইশ জনে একজন সফল হয়।

৫- বসন্ত ও শীতকালে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়।

৬- আত্মহত্যার চেষ্টার আগে যারা দার্শনিক কথা লিখে যায় তারা মূলত মরেনা কিন্তু যারা স্বাভাবিক খবর লিখে যায় তারা মরে।

৭- গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার বিবিরণী মানুষকে আত্মহত্যার জন্যে প্ররোচিত করে।

৮- সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে মানুষ গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়ার পর পরই নিজেই আবার বাঁচার চেষ্টা করে। তবে মজার ব্যপার হলো গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়া মাত্রই মানুষের গলার নিম্নাঙ্গ সমূহ অকার্যকর হয়ে যায়। বিধায় সে মানসিকভাবে বাঁচার জন্য ইচ্ছা বা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সেটা আর নিজের দ্বারা সম্ভব হয় না। তবে অন্য কোন মানুষের সামান্য সাহায্য পেলেই অর্থাৎ অন্য কোন মাধ্যমে সে পায়ে সামান্য শক্তি পেলেই মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়। এরকম আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ আর কখনো আত্মহত্যা করতে যায় না।

৯- একইভাবে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে বিষপান করার পর মৃত্যুযন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বাচার চেষ্টা করে, সে চেষ্টা সকলের ক্ষেত্রে সফল হয় না।

১০- আত্মহত্যাকারীদের হার সবচেয়ে বেশি বিশ্বের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতাসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে

মনে রাখতে হবেঃ

=> আত্মহত্যা মানে, আইন লঙ্ঘন করা, অপরাধ করা।

=> আত্মহত্যা মানে, ধর্মীয় অনুশাসন অবজ্ঞা করা।

=> আত্মহত্যা মানে সমাজে পচনশীল ক্ষত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া।

=> আত্মহত্যা কখনো প্রতিবাদের অস্ত্র কিংবা ভাষা হতে পারে না। আত্মহত্যার ইচ্ছা, আগ্রহ জয় করতে পারা মানেই একটি সুন্দর জীবনের নতুন করে সূচনা। জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাপুরুষতা।

=> আত্মহত্যা মানে অন্যায়ের সাথে আপোষ করা।

=> আত্মহত্যা মানে খুব সহজে হার মানা।

মা-বাবা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমাদের জন্ম দেন, অনেক কষ্ট করে মা তার সন্তানকে ১০ মাস গর্ভে ধারণ করেন, সে সময়টা যে কি পরিমান কষ্টের সেটা মা-বাবা না হলে বোঝা যায় না। সন্তান প্রসবের সময় মা ২২ টি হাড় ভাঙ্গার সমান ব্যাথা সহ্য করে সন্তানকে জন্ম দেন। তার ঋণ আমরা হয়তো কখনোই পূরণ করতে পারবো না, কিন্তু সে যে আমানত আমাদের কাছে দিয়েছেন তা হল আমাদের জীবন। সেটার যথাযথ খেয়াল রাখা আমাদেরই দায়িত্ব, সেটিকে খুন করা না।

কৃতজ্ঞতাঃ ভূতাত্মা

আরো বিস্তারিতঃ http://ptohelp.blogspot.se

বিষয়: বিবিধ

৩৭৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File