প্রেসিডেন্ট পদক প্রসঙ্গে কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন মিতবাক ০৬ মার্চ, ২০১৩, ০৩:৩৯:০০ দুপুর
ছোট একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। এক মা তার আদরের সন্তানকে প্রশ্ন করলেন, বাবা তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও। ছেলে নির্লীপ্ত ভংগিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বড় হয়ে মানুষ পেটাতে চাই। মা প্রথমে হতচকিত হলেন, অতঃপর ব্যথিত কন্ঠে ছেলেকে বললেন, বাবা কেনো তোমার এই ইচ্ছা? ছেলে এবার গম্ভির কন্ঠে মাকে বলল- মা, পত্রিকায় দেখলাম বিরোধী দলীয় চীফ হুইপকে যে পুলিশ প্রকাশ্যে রাস্তায় পিটিয়েছিলো তাকে প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এই পুরষ্কার পুলিশ বাহিনীর মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত। মা, তুমি কি চাওনা আমিও প্রেসিডেন্ট পদক পাই? তোমার মুখ উজ্বল করি? মা এবার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর ত্রস্ত্র পায়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। গল্পটি কিছুদিন পূর্বে বললেও রূপকথা বলে মনে হত। কোন সভ্য সমাজে এটা ঘটতে পারে এমনটাও কেউ ধারণা করতে পারত না। কিন্তু এই রূপকথাকেই বাস্তবে রূপদান করে দেখালো ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নচারী বর্তমান সরকার। বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক-কে রাজপথে সকলের সামনে বিবস্ত্র করে পিটিয়ে আহত করেছিলেন পুলিশের উপকমিশনার(ডিসি) হারুণ-অর-রশিদ। দেশ বিদেশে ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলো সেই ঘটনা। কিন্তু সরকার সেসময় তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহন করেনি। বরং তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিলো। সর্বশেষ তাকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক দেয়া হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি বললেন তাকে পদক দেয়ার জন্য বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পেটানোর ঘটনাও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তার পুরষ্কার পাওয়াটা প্রমান করে সরকার এই ঘটনাকে তার পুরষ্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা হিসেবেই বিবেচনা করেছে। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি বললেন তিনি মিডিয়ার সামনে এই কথা বলে ‘সাহসী’ কাজ করেছেন। সত্যিই বিচিত্র এই দেশ। ভবিষ্যতে যদি সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করা হয় কোন দেশে মানুষ পেটালে প্রেসিডেন্ট পদক পাওয়া যায়? তাহলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবেনা।
বর্তমান আওয়ামী সরকার জাতিকে অনেক নতুন নতুন সঙ্গা শেখাচ্ছেন। সাবেক যোগযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন দূর্নিতীর অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করলে তাকে বলা হল ‘দেশ প্রেমিক’। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি সকল ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে বালক সূলভ কথা বলে নিজেকে দাবি করলো ‘সাহসী’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যারা তরুণ প্রজন্ম, ভবিষ্যতে দেশের সেবা করার জন্য প্রতিশ্রুতিশীল, আমরা কী এসব সঙ্গা-অভিধা শিখে নিজেদের মধ্যে ধারণ করবো? যেখানে দূর্নিতী করলে বলা হচ্ছে ‘দেশ প্রেমিক’, পাগলের মত কথা বললে হয়ে যাচ্ছে ‘সাহসী’? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি একজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী লোক। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের কাছে এধরণের মূর্খের মত কথা আমাদের আতংকিত করে। আমরা বরাবরই দেখতে পাচ্ছি এদেশের রাজনিতীবিদরা আমাদের তরুণদের সামনে কোন আদর্শ হতে পারছেন না। পারছেন না তাদের উপড় অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে। তারা ক্ষমতা স্থায়ী করেত উন্মত্তের মত আচরণ শুরু করেছেন। মূলতঃ জনগনের সম্মিলিত প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য সরকারকে করা হয়েছিলো জনগনের প্রতিনিধী। আর এই কাজ করার জন্য তাদের হাতে দেয়া হয়েছিলো কিছু নির্বাহী ক্ষমতা। যাতে তারা জনগনের স্বার্থের পরিপন্থী কোন দুষ্টচক্রকে মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু সরকার নিজেই এখন হয়ে গেছে দুষ্টচক্র- জনগনের প্রতিদ্বন্দী। ফলে সে জনগনকে মোকাবেলা করতে ব্যবহার করছে জনগনেরই করের টাকায় লালিত-পালিত পুলিশ বাহিনীকে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত আন্দোলন, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মুজুরির জন্য আন্দোলন- প্রতিটি জায়গায়ই পুলিশের হামলা। তাহলে কিভাবে বুঝব সরকার বা পুলিশ জনগনের বন্ধু? বরং পুলিশ হয়ে উঠেছে আজ ক্ষমতাবানদের প্রতিপত্তি রক্ষায় নিয়োজিত লাঠিয়াল বাহিনী। জনগনকে লাঠিপেঠা করা তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পরিনত হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের পুলিশ এক ধরণের মানসিক রোগে আক্রান্ত। সে মানুষকে পিটিয়ে এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ পায়। কারণ প্রায় সময়ই দেখা যায় বিনা উসকানিতে নিরপরাধ ব্যক্তির উপরও তারা হামলা করে। একবার দুইজন ফটো সাংবাদিককে পেটানোর সময় পুলিশ দম্ভভরে বলেছিলো, সাংবাদিক মারলে কিছু হয়না। কাউকে মারার সময় সে ভুলে যায়, সে একজন মানুষ এবং যাকে মারছে সেও একজন মানুষ। আমি পুলিশকে একতরফা দোষ দিতে চাই না। কারণ সে অনেকটা সরকারের নির্দেষেই কাজ করে। তবুও অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের বাড়াবাড়ি ভিষনভাবে লক্ষনীয়। এক্ষেত্রে তার দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে পেটানো সেই অসুস্থ মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এই রোগটার উৎস খুজতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে অনুসন্ধান করতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগন যখন জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার আসনে বসেন, তখন তারা এটাকে দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করেন না। তারা এটাকে ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করেণ। তারা নিজেদেরকে সাধারণ মানুষের কাতার হতে উচুতে ভাবতে পছন্দ করেণ। সমাজ তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়, এটা ভেবে তারা আত্বপ্রসাদ লাভ করেন। এভাবেই ক্ষমতার মোহ তাদের পেয়ে বসে। এই ‘ক্ষমতার মোহ’ একটি মারাত্বক আসক্তি। একটি মানসিক রোগ। এই আসক্তি যাদেরকে পেয়ে বসে তারা ক্ষমতা রক্ষায় উন্মত্ত হয়ে যান। তারা ভুলে যান সকল নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক আচার-কানুন। ফলে তারা উদ্ভট সব কথা বার্তা বলা শুরু করেন। আমদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির এই রকম নিজেকে সাহসী দাবি করা- ক্ষমতার মোহে উদ্ভট আচরণ নয় কি? এই রোগ এখন সরকারের সকল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অনেক হই চই হচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি এভাবে পুলিশের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়, তাদেরকে পুরষ্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করে, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমবে না বাড়বে বৈকি। আজ তারা যে ধারা শুরু করে দিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতে তাদেরকেও একই ফাদে পড়ঁতে হতে পারে। অন্যের জন্য ফাঁদ পাতলে সেই ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হয়।
বিষয়: বিবিধ
১১৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন