বোশেখি পান্তা আর কিছু অসংলগ্ন সংলাপ...
লিখেছেন লিখেছেন যোবায়ের মোমিন ১৫ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:৩২:৫৮ দুপুর
গতকাল ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বোশেখ। পান্তা আর ইলিস ছাড়া বোশেখপুরোই অসম্পূর্ণ। সবাই খুব মজা করে গরম ভাতে পানি ঢেলে বানানো পান্তা আর চড়চড়েভাজা ইলিস খেয়ে বাঙালী হয়ে গেলেন। ছোটবেলায় শুনতাম, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরামাছ। ইলিশ জাতীয় মাছ। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতির সাথে পান্তা কোথা থেকে আসলো তা কেউজানলে একটু জানাবেন।
আচ্ছা, এমন কেউ কি আমার এই নোট পড়ছেন যিনি জীবনে পহেলা বোশেখে কেবল আনন্দকরে নয়, সাধারণ দিনে খাবার নষ্ট হবে বলে অথবা গরম ভাতের অভাবে অথবা খাবারের অভাবেদিনের পর দিন পান্তা খেয়েছেন?
প্রশ্নটা খুব সেকেলে হয়ে গেলো? কিছু মনে করবেন না, আমি সেকেলে মানুষ,প্রতিক্রিয়াশীল।
১৯৯৭ সালের মার্চের পহেলা দিন আমি হেফজখানায় ভর্তি হই। বয়স এখনো ১০ হয়নিতখনো। বোর্ডিং-এ থাকতে হবে। মাসিক খরচ মোট ৩০০ টাকা। ১০ টাকা দামের ২০ কেজি চালেরদাম ২০০ টাকা। বাজার খরচ প্রতিদিন ৩ টাকা করে ৩০ দিনে ৯০ টাকা। আর বাকি ১০ টাকাবুয়ার বেতন। আর সিট ভাড়া? এখানে সিট ভাড়া লাগেনা। সবাই ঘুমায় হেফজখানার ফ্লোরে,জায়গা না কুলালে মসজিদ তো আছেই। ৩ টাকা প্রতিদিন বাজার খরচ মানে বুঝেছেন তো? ধরুনআমার বোর্ডিং-এ যদি ২০ জন থাকি তবে সেদিন মোট বাজার খরচ দেয়া হবে ৬০ টাকা। সেই ৬০টাকা দিয়ে কেনা হবে ২০ জন মানুষের জন্য ২ বেলার মাছ তরকারি আর তা রান্না করার জন্যমাল মশলা। আর হ্যা, সকালের পান্তা খাবারলবণটাও কিন্তু এই ৬০ টাকার মধ্যে। ভাবছেন মাত্র ৬০ টাকায় কী করে হত ২০ জনের সববাজার? আমি নিজে অনেক দিন বাজারে গিয়েছি। রাতের জন্য কেনা হত ৫০০ গ্রাম ছোলার ডাল।৮/১০ টাকায় রাতের তরকারি সারা। আর বাকি টাকায় ২ কেজি আলু, ৩ কেজি বেগুন আর লবণমরিচ পেয়াজ হয়েই যেত।
হেফজখানার এই ছেলেগুলো দুপুরে খেত নিরামিষ, রাতে খেত ছোলার ডাল দিয়ে, আরসকালে ১০ টাকা কেজি চালের পান্তা, অবশ্য মাঝে মাঝে লবণ নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। আরহ্যা, আমার মত বড়লোক যারা ছিল তারা পাশের দোকান থেকে ১ টাকার চিনি কিনে এনে সকালেরপান্তাকে সুস্বাদু করে তুলত। (বড়লোক মানে কিন্তু বড়লোক না, চিনি কেনার সামর্থ্যযাদের আছে তারাই বড়লোক) ২ টাকার লবণ দিয়ে ২ বেলা রান্নার পর সকালে পান্তা খাবারজন্য আর কতটুকু লবণই বা অবশিষ্ট থাকে! ১০টাকা দামের চালের কথা সবাই শুনেছেন। সেই চালের ভাত কেউ খেয়েছেন কখনো? আর সেই ভাতযদি রাতে পানি দিয়ে রাখা হয় তার পান্তা কেমন হবে একবার কল্পনা করে নিবেন।
হুজুররা অনেক খায়, অন্যের বাড়ি খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি বানায়, এমন কথা ভেবেছেনকখনো? না ভাবলে শুনেছেন কখনো? এই যদি হয় একটি ছেলের সারাদিনের খাবার মেন্যু, তাহলেসে কেন অপেক্ষা করবে না একটি শুক্রবারের জন্য যেদিন মাদরাসায় একটি দাওয়াত আসবে?
ছোটবেলায় টন্সিলাইটিসের সমস্যা ছিল। ঠাণ্ডা পান্তা খেলে গলা ব্যাথা হতো। আমিমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবাকে বললাম। বাবা বললেন, ওখানে সবাই পান্তা খেয়েইথাকে। তোমার বাবার সামর্থ্য আছে বলে তুমি সবার সামনে অন্য কিছু খাবে তা হবে না।সবার সাথে মিলে থাকতে শিখতে হবে। অবশ্য শেষের দিকে আমার অসুস্থতার কাছে বাবার এজিদ হার মেনেছিল। চিড়ি ভিজিয়ে চিনি দিয়ে খেয়েছি শেষ ক’বছর।
হেফজখানায় আমার সহপাঠীদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল হতদরিদ্র পরিবারের। বাবা মারাগেছে। মা অন্যের বাড়ি কাজ করে এমন। অথবা বাবা রিক্সা চালান। ছেলেকে “আল্লাহ্ররাস্তায়” দিয়ে দিয়েছেন। স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেকে বাবা হেফজখানায় দিয়েছেন এমনসংখ্যা বেশ কম। এটি আমি আমাদের সেই হেফজখানার কথা বলছি। আজকাল অনেক হেফজখানা বাআধুনিক মাদরাসা হয়েছে সেখানে সন্তানকে পড়াতে গেলে বাবামাকে রীতিমত বড়লোক হতে হয়।আর মাদারাসা সম্পর্কে মানুষের ধারণাও বেশ ইতিবাচকভাবে পাল্টেছে।
আবার পান্তা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গরীব মানুষ যাদের “নুন আনতে পান্তা ফুরায়”তারা কষ্টের পয়সায় কেনা চালের ভাত নষ্ট করতে চান না। অথবা সকালে ভোঁরে রান্না করতেদেরী হবে তাই রাতের পান্তা খেয়েই কৃষক মাঠে চলে যান। আজ যে রাস্তার ফুটপাতে টোকাইবালক বালিকা ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে সে রাস্তার পাশেই শতশত টাকায় আমরা বাঙালিরাপান্তা খেয়ে বাঙালিয়ানা দেখাই। যেটি গরিবেরা করে দারিদ্রের তাড়নায় আমাদের কাছে তা উৎসব! এটি কি তাদের দারিদ্রের প্রতি আমাদের উপহাস নাকিঅন্য কিছু? সুধীজনের কাছে জিজ্ঞাসা রইল। মাছে ভাতে বাঙালী জানি, পান্তা ভাতে বাঙালী,এটি নিশ্চয় আপনি বলবেন না।।
পূর্বে আমার ফেসবুকে প্রকাশিত।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন