তারাবিহ নামাজে রাকায়াত সংখ্যা নিয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাসান আল বান্নার যুগান্তকারী ফতওয়া ।

লিখেছেন লিখেছেন প্রশান্ত আত্মা ২৯ জুন, ২০১৪, ১০:২১:২৮ সকাল

‘তারাবিহ বিশ রাকাতই?’ ‘না, রাসুল (সাঃ) থেকে আট রাকাতই প্রমাণিত।’ ‘হযরত ওমরের (রা.) সময়ে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বিশ রাকাত জামায়াতের সাথে আদায় করেছেন। তাহলে তারা কি ভুল করেছেন?’ ‘বিশের দলিল প্রমাণ দুর্বল। আমরা আমাদের মুরব্বীদেরকে আট রাকাতই পড়তে দেখেছি।’ ‘আটের দলিল দুর্বল। আমরা তো বিশই পড়ে আসছি।



কায়রো থেকে দূরে কোন এক গ্রামের মসজিদে এশার নামাযের পর মুসল্লিদের মাঝে আলোচনা চলছে। এই আলোচনা ঝগড়া ফাসাদে রূপ নেয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু তার আগেই একজন অপরিচিত সুদর্শন চেহারার আগন্তুক- যাকে দেখলে ঈমান ও আমলের বাস্তব নমুনা বলে মনে হয়- এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতেন। পরদেশীর আওয়াজ এতই গরুগম্ভীর ছিল যে, সবাই তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হয়। তিনি উচ্চ আওয়াজে বলতে থাকেন, ‘হে আমার ভায়েরা! তারাবিহর ব্যাপারে আপনাদের তর্ক-বিতর্ক আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনে আসছি। মসজিদে হট্টগোল ও হৈ চৈ করা মসজিদের মর্যাদার পরিপন্থী। আর আপনাদের তর্ক-বিতর্ক ঝগড়া ও লড়াইয়ে রূপ নিতে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তা বিশৃঙ্খলার রূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে। আপনারা যদি আমার দুইটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন তাহলে মনে হয় সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। আপনারা কি এ ব্যাপারে আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবেন?’

মসজিদের বিভিন্ন দিক থেকে এক সাথে আওয়াজ ওঠে, ‘জী, জী, বলুন! সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’ আগন্তুক লোকদের দৃষ্টি নিজের দিকে আকৃষ্ট করে বলেন, ‘প্রশ্ন হলো, তারাবিহর শরিয়তী বিধান কি? অর্থাৎ এটা ফরজ না নফল?’ সমস্বরে সবাই বলে ওঠেন, এটা নফল, এটা নফল। ‘খুব ভাল কথা! আচ্ছা, বলুন তো দেখি, ইসলামে মুসলমানদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার ব্যাপারে কি নির্দেশ রয়েছে, অর্থাৎ এটা ফরজ না নফল? লোকজন জবাব দেয়, এটা ফরজ, এটা ফরজ।

‘হে আমার ভাইয়রা! নফল হলো সেই কাজ, যদি কখনো কোন কারণে তা পরিত্যাগ করা হয় তাহলে মানুষ গোনাহগার হবে না। আর ফরজ হলো ঐ কাজ, যা পরিত্যাগ করলে বা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ গোনাহগার হয়। আমি কি সঠিক কথা বলেছি?’ সমবেত জনতা এক সাথে জওয়াব দেয়, সম্পূর্ণ সঠিক কথা। ‘আল্লাহর রশিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না’- আল্লাহপাকের এ বাণী আমাদেরকে তার রশি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয় এবং বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করে। তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়ার মাধ্যমে মুসলমানদের সাহস ও শক্তি কমে যাবে এবং তাদের প্রভাব বিনষ্ট হয়ে যাবে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা ঝগড়া বিবাদ করো না। তাহলে তোমরা ব্যর্থ হবে এবং তোমাদের শক্তি ও মানমর্যাদা কমে যাবে।’

তারাবিহ হচ্ছে নফল আর মুসলমানদের ঐক্য হচ্ছে ফরজ। এখন আপনারা বলুন, যে ব্যক্তি একটি নফল প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে সে ব্যক্তি দ্বীন ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণকামী নাকি শত্রু?’ সমবেত জনতা এক বাক্যে বলে উঠে ‘শত্রু! শত্রু!’ ‘আপনাদের শত্রু আপনাদের ঐক্য চায় নাকি অনৈক্য চায়?’ ‘অনৈক্য।’ ‘আপনারা ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি রাসুল (সাঃ) এর উম্মতের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে চায় সে ব্যক্তিকে (সাঃ)এর সঠিক অনুসারী বলা যাবে নাকি শত্রুর চর বলে অভিহিত করতে হবে?’ একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি রাসুল আকরামের (সা.) অনুসারী নয়, বরং সে শত্রুর চর।’ ‘যদি কোনো ব্যক্তি এ ধরনের কাজ করে তাহলে আপনাদের দায়িত্ব তাকে প্রতিহত করা নাকি তার সাথে সহযোগিতা করা?’ ‘আমরা তাকে প্রতিহত করবো।’ ‘আমাদের কাছে আট রাকাত বা বিশ রাকাতের সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত নাকি মুসলমানদের ঐক্য?’ ‘ঐক্য, ঐক্য।’

‘হে আমার ভাইয়েরা! আপনারা যদি ঐক্য চান তাহলে আপনাদের ত্যাগ ও কোরবানী করতে হবে। আপনারা কি এ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত?’ ‘আমরা সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।’ ‘কোরবানী শুধু এতটুকুই করতে হবে যে, আপনারা যে ইমাম কিংবা নিজের বিশ্লেষণের প্রতি সন্তুষ্টি ও আস্থা সৃষ্টি হবে আপনি সেটাই কার্যকর করবেন এবং অন্যদেরকে কোরআন ও সুন্নাহর দলিল দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু অন্যকেও তার নিজস্ব পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী চলতে দিতে হবে। কেননা, প্রত্যেক মুসলমানই নিজের বিশ্লেষণের স্বপক্ষে কোরআন হাদীস থেকেই দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকেন। কেউই তওরাত বা ইঞ্জিল থেকে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেন না। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ভিন্নতা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।’

‘মসলা মাসায়েলের শাখা প্রশাখায় যিনি যেটাকে উত্তম মনে করবেন তিনি সেটাই আমল করবেন। দ্বীনের মৌলিক বিষয় ও সর্বসম্মত বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাবেন। আপনাদের শত্রু ইংরেজ অথবা ইহুদীরা আপনাদের বুকে গুলি চালানোর সময় পার্থক্য করবে না যে, কে শাফেয়ী আর কে হানাফী, কে আট রাকাত তারাবিহ পড়ে আর কে বিশ রাকাত তারাবিহ পড়ে। তাদের দৃষ্টিতে কালেমা পাঠ করা সব মুসলমানই শত্রু। তাদের সাফল্য এটাই যে, তারা আপনাদেরকে পরস্পরের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত রাখতে পেরেছে। এ জন্য আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, শাখা প্রশাখার ঝগড়া পরিহার করে কুফরী ও জালেম শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং নিজদেরকে খাঁটি মুসলমান বানানো।’

মুসাফিরের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর লোকজন উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার সাথে হাত মিলাতে থাকে। গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি- যার পোশাক পরিচ্ছদ ও চেহারা দেখে বিত্তশালী ও সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে হয়- তিনি সামনে এগিয়ে এসে মুসাফিরকে জিজ্ঞেস করেন, আমি আপনার কথায় খুবই মুগ্ধ হয়েছি। আপনি অনুগ্রহপূর্বক যদি আপনার পরিচয় দিতেন তাহলে খুবই ভালো হতো। ‘আমার নাম হাসানুল বান্না, কায়রোতে থাকি।’ আগন্তুক তার কাছে দাঁড়ানো সঙ্গীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আর ইনি আমার বন্ধু আহমদ সুকরী, ইখওয়ানুল মুসলেমুনের জেনারেল সেক্রেটারি। বিত্তবান ব্যক্তি বলেন, আমি আপনার নাম শুনেছি এবং আজ দেখার সুযোগ হলো। আপনি এখানে কার বাড়িতে অতিথি হয়েছেন? ‘আমরা আল্লাহর অতিথি। ইখওয়ানুল মুসলেমুনের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়েছি।’ ‘তাহলে আজ রাতে আমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করুন।’

(হাসান আল বান্নার এ ঘটনাটি priyoboi.com থেকে নেওয়া)

রমজান মাস এলেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তারাবীহ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত তা নিয়ে এক বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একটা নফল ইবাদতের জন্য নিজেদের মধ্যে ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা। ইমাম হাসান আল বান্নার এ ঘটনাটি পড়ার পর থেকে এসব ব্যাপারে আমি সর্বদা নীরব থাকি আর নীরব থাকাটাই কল্যাণকর।তারাবীহ নামাজ নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে ‘তারাবিহ হচ্ছে নফল আর মুসলমানদের ঐক্য হচ্ছে ফরজ’ ইমাম হাসান আল বান্নার এই কথাটি স্মরণে রাখা প্রয়োজন।একটি নফলের জন্য ফরজকে জলাঞ্জলি দেওয়া উচিত নয়।

প্রতিবছর রমজান মাসে এই পোস্টটা দেয়।কারন এরূপ অযথা বিতর্ক এড়ানোর জন্য হাসান আল বান্নার কথাগুলি সত্যিই অসাধারণ।

রহমত,মাগফেরাত আর নাজাতের মাস রমজান সমাগত।তারাবিহ’র রাকআত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক যেন আমাদের মাঝে ফেতানা ফাসাদের সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।মহান আল্লাহ এই রমজানে আমাদের সকল সব ভুল-ত্রুটিগুলি ক্ষমা করে আমাদের সবাইকে কাঙ্খিত হেদায়াতের আলোর দিশা দিন।আমীন।

বিষয়: বিবিধ

২৬৪৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

239909
২৯ জুন ২০১৪ সকাল ১০:৩৯
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : ভালো লাগলো অন্নেক ধন্যবাদ।
Good Luck Good Luck Good Luck পিলাচ।
239921
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:১০
জীবন রাহমান লিখেছেন : সময়োপযোগী একটি পোষ্ট। খুব ভাল লাগলো। অনেক ধন্যবাদ
239925
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:২৩
মদীনার আলো লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
239926
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:২৪
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ
239927
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:২৪
দ্য স্লেভ লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ,দারুন বিষয় বলেছেন
239939
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৪৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
আমরা সবসময়ই অপ্রয়োজনিয় বিষয় নিয়েই বিতর্ক করি আর ঐক্য নষ্ট করি।
239949
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ০১:৪০
আমি মুসাফির লিখেছেন : এই পোষ্ট বার বার দেয়া প্রয়োজন কারণ প্রতিবঝরই নতুন লোক যোগ হয় যারা এ বিষয়ে জানে না তাই তাদের জানার সুযোগ হয় এবং আমরা যার জানি তারেও একটু ঝালই হয়।

239958
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ০২:৪০
মুিজব িবন আদম লিখেছেন : খুবই দরকারী লেখা। কবে যে বিশ্ব মুসলিম একত্রিত হতে পারবে???
239970
২৯ জুন ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : It is a very important post. Jajakalla khairan
১০
239976
২৯ জুন ২০১৪ বিকাল ০৪:২২
আনিছুর রহমান লিখেছেন : তারাবির নামাজ কি নফল নাকি সুন্নাত?
৩০ জুন ২০১৪ রাত ১২:২২
186331
মাটিরলাঠি লিখেছেন : হাসান আল বান্নার ফাতওয়া ও পোষ্টের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে যদি বিতর্ক না করি, তাহলে বলিঃ "সকল প্রকার সুন্নাত নামাজই নফল নামাজ।"
১১
240025
২৯ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১২
বড়মামা লিখেছেন : সুন্দর ভালো লগলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
১২
240026
২৯ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১৪
বড়মামা লিখেছেন : সুন্দর ভালো লগলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
১৩
240322
৩০ জুন ২০১৪ বিকাল ০৪:২৮
মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন লিখেছেন : ভাই, আপনার প্রেরণামূলক এ লেখাটা বেশ ভালো লাগল। আরো ভালো লাগত যদি তথ্য শতভাগ সঠিক হতো। সারাজীবন জেনে এসেছি, তারাবিহ নামাজ সুন্নতে মুয়াক্বাদাহ। আর আপনি বললেন নফল। কোনটি ঠিক?

প্রশ্ন হলো, তারাবিহর শরিয়তী বিধান কি? অর্থাৎ এটা ফরজ না নফল?’ সমস্বরে সবাই বলে ওঠেন, এটা নফল, এটা নফল।

১৪
242901
০৮ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৯
মুহাম্মদ_২ লিখেছেন : মাটিরলাঠি: "সকল প্রকার সুন্নাত নামাজই নফল নামাজ।" ঠিক।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File