ভাষা আন্দোলন ও পিছনে পড়ে থাকা কিছু ইতিহাস!

লিখেছেন লিখেছেন প্রশান্ত আত্মা ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১২:৫২:১৫ দুপুর

মাতৃভাষায় কথা বলায় যে তৃপ্তি তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়।অবশ্য এখন তো আমরা বাংলার সাথে হিন্দি কিংবা ইংরেজিকেকে মিশিয়ে বাংলাকে এক শংকর ভাষায় পরিণত করেছি!ভাষা বিকৃতিও নাকি আধুনিকতা!!সালাম বরকতেরা বেঁচে থাকলে আমাদের নিজ ভাষা থেকে হিন্দি কিংবা ইংরেজির প্রতি অনুরাগ দেখে খুব কষ্ট পেতেন।যারা বাংলাতে জন্মেও বাংলা ভাষার তুলনায় হিন্দি কিংবা ইংরেজি বলাতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাদের উদ্দেশেই মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন,"যেজন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি।"যাইহোক বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে কিছু বিষয়ের অবতারনা করার জন্য এই লিখা।যে সত্য ইহিহাসকে জ্ঞানপাপী ইতিহাস বিকৃতকারীরা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এ ব্যাপারে অন্ধকারেই থেকে যায়।



বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী প্রথম উত্থাপিত হয় ১৯০১ সালে।তখন রংপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষক সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়ার আহবান জানান।১৯১৮ সালে বিশ্ব ভারতীয় এক সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উপমহাদেশের সাধারণ ভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবী জানান।তখন তার এ দাবীর বিরুধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।বাংলা ভাষার কারণে নোবেল প্রাইজ পেলেন অথচ এই রবীন্দ্রনাথই মহাত্মা গান্ধীকে বলেছিল,“ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মধ্য ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে একমাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষা করা সম্ভব।”হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার তার প্রস্তাবের তীব্র বিরুধিতা করে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন,”শুধু ভারত কেন সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।“

৫২ তে এসে ভাষা আন্দোলনের দাবী তীব্রতর হয়।ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেকে নির্লজ্জভাবে আলেম-উলামা ও ইসলামী সংগঠনগুলিকে উর্দুপন্থী হিসাবে প্রচার করে।জ্ঞানপাপী ইতিহাস বিকৃতকারীরা নাটক,সিনেমায় এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করে যে হুজুর, মোল্লা মানেই উর্দুপ্রেমি !! অথচ ’৫২’র ভাষা আন্দোলনকে ওলামায়ে কেরাম সমর্থন আরও জোরদার করতে ভূমিকা পালন করেছিল।জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ব্যানারে হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ) এ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন।তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সংবিধানের এক ধারায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান।শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) তখন সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দান আমাদের ন্যায্য অধিকার তা মানতেই হবে।‘উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুর রহিমও ভাষা আন্দনলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিতর্কিত কোন মন্তব্য না করতে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদূদীকে সতর্ক করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু করেছিল ইসলামী আদর্শবাদি সংগঠন ‘‘তমদ্দুন মজলিস’



বাংলা ভাষা আন্দোলনের আরেকটা ইতিহাস বিকৃতি আমাদের জন্য বেশ লজ্জাকর।একজন ভাষা সৈনিক গোলাম আযমকে নিয়েও আমরা বিকৃত ইতিহাস প্রচার করছি।সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হল গোলাম আযম ভাষা সৈনিক এ দাবীর বিরুধিতাকারিরা যুক্তি তর্কে হেরে গিয়ে এক পর্যায়ে বলে “গোলাম আযম বাংলা ভাষার দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছেন সত্য তবে মন থেকে দেননি!!!!!”



ভাষা সৈনিক ও ডাকসুর সাবেক জিএস, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর সাবেক আমীর গোলাম আযম। ভাষা সৈনিক গোলাম আজম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একদল ছাত্র নিয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে পিকেটিং করার সময় সদলবলে গ্রেফতার হন এবং তেজগাঁও থানায় বেড়া-বিহীন টিনের ঘরে সাত দিন রোদ বৃষ্টিতে অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগেছেন।

১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকায় সফররত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে গোলাম আযম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক দাবী সম্বলিত ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করেন।

উল্লেখ্য,১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ঢাকসু) জি.এস. ছিলেন। ১৯৫২ সালে মার্চের ৬ তারিখে রংপুরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়ে একমাস রংপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি যাতে পালন করতে না পারেন তার জন্য ১৯৫৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং দু’মাস পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে কারান্তরীণ অবস্থায় রংপুর কারমাইকেল কলেজের চাকুরী থেকে তাকে অব্যহতি দেয়া হয়।

গভর্নিংবডির পক্ষ থেকে জেলে তাকে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয় যে, বার বার গ্রেফতার হওয়ায় ছাত্রদের লেখা পড়ার ক্ষতি হয় বলে কলেজে তাকে আর প্রয়োজন নেই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে তিনি চাকরী হারান,বার বার কারারুদ্ধ হন।

আগামীকাল হয়ত অনেক ধুমধামের সাথে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হবে।ফুলে ফুলে ভরিয়ে তোলা হবে শহীদ মিনার।কিন্তু না আমি ফুল দিতে যাবনা তবে দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে তাদের জন্য দোয়া করব।



আগামীকাল হয়ত অনেক জীবিত ভাষা সৈনিকেরা ভালবাসা আর সংবর্ধনায় সিক্ত হবেন কিন্তু ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী গোলাম আযম কারাগারের অন্ধ কক্ষে হয়ত ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্মৃতিগুলি খুঁজে ফিরেই তৃপ্ত থাকতে হবে।আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মজলুম ভাষা সৈনিককে।আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুন এবং তার জন্য ন্যায়বিচারের ফায়সালা করে দিন।

তথ্যসূত্রঃ

১.মাসিক মদীনা, ডিসেম্বর-২০০৮

২.ভাষা আন্দোলনের ডায়রী-মোস্তফা কামাল

৩.বাংলা সাহিত্যের ধারা- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

৪.বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

৫.সাপ্তাহিক লিখনি

৬.বিভিন্ন পত্র পত্রিকা

৭.http://ghulamazam.info

বিষয়: বিবিধ

৪০০৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

179787
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : তথ্য ও যক্তিপুর্ন এই চমৎকার পোষ্টটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিকৃত ইতিহাস আর বিকৃত উৎসব এর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলন এর মুল স্পিরিট। খালি পায়ে শহিদ মিনারে যাওয়া আর ঘরে এসে হিন্দি গান শুনাই এখন ভাষা আন্দোলন।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:২৭
132812
প্রশান্ত আত্মা লিখেছেন : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
179791
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:২৪
হতভাগা লিখেছেন : গোলাম আজমকে হাইলাইট করার জন্য এই পোস্ট ।

Very poor technique!
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:২৯
132813
প্রশান্ত আত্মা লিখেছেন : সত্য সবসময়ই সত্য।সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে যদি কেও হাইলাইট হয় তবে আর কি করা!

ধন্যবাদ..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File