যে কথাগুলি আমার জাগতিক সকল অভাব-অনটনকে ভুলিয়ে দেয়!

লিখেছেন লিখেছেন প্রশান্ত আত্মা ০২ মে, ২০১৩, ১১:১৩:৪৩ সকাল



উরওয়া (র) থেকে বর্ণিত। আয়িশা (রা) বলতেন, আল্লাহর শপথ! হে ভাগ্নে! আমরা একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, তারপর আর একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, তারপর আর একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, এভাবে দু’মাসে তিন তিনটা নতুন চাঁদ দেখতাম। অথচ এ দীর্ঘ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কোন ঘরের চুলায় আগুন জ্বলত না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে খালাম্মা! তাহলে আপনারা কি খেয়ে জীবন-যাপন করতেন? তিনি বলেন, দু’টি কালো বস্তু, অর্থাৎ খেজুর ও পানি (পান করে কাটাতাম)। (বুখারী, মুসলিম)

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি একটি দলের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের সামনে তখন তাজা একটি আস্ত বকরী ছিল। তারা তাকে দাওয়াত করলে তিনি তা খেতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন, অথচ তিনি কখনো পেট ভরে যবের রুটিও খেতে পাননি। (বুখারী)

আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুহাম্মদ (সা)-এর ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর পরিবার কোন দিন একনাগাড়ে দু’দিন পেটপুরে যবের রুটিও খেতে পায়নি। (বুখারী, মুসলিম)

সাহল ইবনে সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা) কে মানবজাতির জন্য নবী বানিয়ে পাঠানোর পর থেকে তাঁকে তুলে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কখনো মিহি আটার রুটি দেখেননি। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে কি আপনাদের কাছে চালুনি ছিলো না? তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা) কে মানবজাতির জন্য নবী বানিয়ে পাঠানোর পর থেকে তাঁকে ওফাতের মাধ্যমে উঠিয়ে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কখনো চালুনি দেখেননি। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আপনারা না ঝাড়া যব খেতেন কিরূপে? তিনি বলেন, আমরা তা পিষে তাতে ফুঁ দিতাম, যা কিছু উড়ে যাওয়ার উড়ে যেতো, অতঃপর অবশিষ্ট আটা বা ময়দা পানি মিশিয়ে খামীর বানাতাম। (বুখারী)

নু’মান ইবনে বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তোমাদের নবী (সা) কে দেখেছি, তিনি তাঁর পেট ভরার জন্য রদ্দি খেজুরও পেতেন না। (মুসলিম)

সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমিই ছিলাম আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপকারী সর্বপ্রথম আরব। আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের কাছে বাবলা এবং এই ঝাও গাছের পাতা ছাড়া আর কোন খাদ্যই ছিল না, এমনকি আমাদের লোকেরা ছাগলের বিষ্ঠার ন্যায় পায়খানা করতো, একটা আরেকটার সাথে মিশতো না। (বুখারী, মুসলিম)

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নিজেকে এমন অবস্থায়ও দেখেছি যে, যখন আমি ক্ষুধার তাড়নায় বেহুঁশ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মিম্বার ও আয়িশা (রা)-এর কক্ষের মাঝখানে পড়ে থাকতাম। কেউ কেউ এসে আমাকে পাগল মনে করে আমার ঘাড় পদদলিত করতো। অথচ আমার মধ্যে পাগলামি ছিল না, বরং ছিল ক্ষুধার তীব্রতা। (বুখারী)

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি অবশ্যি সত্তরজন এমন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি, যাদের কারো কাছেই কোন চাদর ছিল না। কারো কাছে হয়তো একটি লুঙ্গি ছিল, আবার কারো কাছে ছিল একটি কম্বল। আর তাঁরা তাদের কাঁধের সাথে বেঁধে রাখতেন। তাঁদের মধ্যে কারো লুঙ্গি পায়ের দু’গোছা পর্যন্ত পড়তো, কারোটা দু’হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা লুঙ্গী হাতে ধরে রাখতেন। (বুখারী)

উবাইদুল্লাহ ইবনে মিহসান আল-আনসারী আল-খাতমী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি শারীরিক নিরাপদ অবস্থায় ও সুস্থ দেহে সকালে উপনীত হলো এবং তার কাছে ক্ষুধা নিবারণের মত ঐ দিনের খোরাক আছে, তাকে যেন দুনিয়ার যাবতীয় কিছুই দান করা হয়েছে।ইমাম তিরমিযী এটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান।

ফাদালা ইবনে উবাইদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়তেন, তখন তাঁর পেছনে দাঁড়ানো আসহাবে সুফফার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কতক লোক ক্ষুধার তীব্রতায় (অজ্ঞান হয়ে) মাটিতে ঢলে পড়ে যেতেন, এমনকি বেদুঈনরা তাদেরকে পাগল বলে আখ্যায়িত করতো। রাসূলু্‌ল্লাহ (সা) নামায শেষে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেনঃ তোমরা যদি জানতে পারতে যে, আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কি মর্যাদা ও সামগ্রী মজুদ আছে, তাহলে ক্ষুধা ও অভাব আরো বৃদ্ধি হওয়ার কামনা করতে।(তিরমিযী)

ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর স্ত্রীর একবার ইচ্ছে হলো কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাওয়াবেন। স্বামীকে এ ইচ্ছের কথা জানালেন। খলিফা সাফ জবাব দিলেন, মিষ্টির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নেই। তিনি খলিফার সঙ্গে কথা আর না বাড়িয়ে সংসারের দৈনন্দিন খরচ থেকে অল্প অল্প করে রেখে মিষ্টি কেনার মতো পয়সা জমালেন। একদিন খলিফাকে তিনি আনন্দের সঙ্গে সংবাদটি দিলেন। কিন্তু এবার খলিফা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজকোষে খবর পাঠালেন। রাজকোষের কর্মচারী খলিফার বাড়িতে এসে হাজির হলেন। খলিফাপত্নী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, খলিফা তার সঞ্চিত অর্থ রাজকোষের লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। স্ত্রীর সঞ্চিত অর্থ রাজকোষে জমা দিয়ে খলিফা আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, এই সঞ্চয়ের ঘটনায় প্রমাণ হলো যে, এ পরিমাণ অর্থ বায়তুল মাল থেকে না তুললেও আমার সংসারের খরচ চলে যাবে। অতিরিক্ত সম্পদ আমি কিছুতেই রাজকোষ থেকে গ্রহণ করতে পারি না।

আবু বকর রা. এর পর খলিফা নির্বাচিত হলেন উমর (রা)।

বায়তুল মাল থেকে তিনি যে ভাতা নিতেন তাতে সংসার চলতো না। তার এ সমস্যার সমাধান কল্পে শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম পরামর্শ করে ভাতা বাড়ানোর চিন্তা করলেন। কিন্তু এ প্রস্তাব তারা সরাসরি খলিফার কাছে উপস্থাপন করার সাহস পেলেন না। শরণাপন্ন হলেন খলিফার মেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সহধর্মিনী হাফসা রা. এর কাছে। সুযোগ বুঝে হাফসা রা. এ প্রস্তাব ওমর রা. এর দরবারে পেশ করলেন। প্রস্তাব শুনে খলিফা ক্রুদ্ধ হলেন। কিছুটা রাগত আর কিছুটা বিষণ্ণ স্বরে প্রশ্ন করলেন, বলো তো হাফসা তোমার ঘরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সবচেয়ে ভালো পোশাক কেমন ছিল? উত্তরে হাফসা রা. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যবহারের জন্য আমার ঘরে মাত্র দুটি হলুদ রঙের কাপড় ছিল। জুমার দিনে আর বিদেশি কোন মেহমান সাক্ষাত করতে এলে তিনি কাপড়গুলো পরিধান করে বের হতেন। ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন, বলতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেযে ভালো খাবার কি খেতেন? হাফসা রা. বললেন, আমরা যবের রুটি খেতাম। একদিন ঘির পাত্রে যে তলানিটুকু ছিল তা গরম রুটিতে লাগিয়ে লাগিয়ে আমরা খেয়েছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তা খেয়েছিলেন। উপস্থিত অন্যদেরকেও তা খেতে দিয়েছিলেন। এবার ওমর রা. প্রশ্ন করলেন,বল তো তোমার ঘরে রাসূলের সবচেয়ে ভালো বিছানাটা কেমন ছিল? হাফসা রা. উত্তরে বললেন, বিছানার জন্য একটি মোটা কাপড় ছিল। গরমের সময় কাপড়টি চার ভাঁজ করে বিছিয়ে দিতাম। শীতকালে অর্ধেকটুকু বিছিয়ে নিতাম আর বাকি অর্ধেক দিয়ে আমরা শরীর ঢাকতাম।এসব প্রশ্নোত্তরের পর খলিফা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তার চেহারায় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, “আমাকে আমার ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ করে কোন লাভ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবু বকর রা. যেভাবে সাদাসিধে জীবনাতিপাত করে গেছেনে আমিও সে আদর্শে অবিচল থাকব”

বিলাসিতার মাধ্যমে ইসলাম আসেনি। ঘরের কোনায় আরামে বসে থেকে ভোজন বিলাসের মাধ্যমে ইসলাম আসেনি।ইসলাম এসেছে উত্তপ্ত ময়দানের উপর দিয়ে,ইসলাম এসেছে দুনিয়ার জাগতিক লোভ লালসাকে পায়ের নিছে পৃষ্ট করে, জান দিয়ে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে গোটা দুনিয়ার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।

যখন ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তা,আরও একটু ভাল থাকার চিন্তা মাথায় ভর করে তখন এই হাদিসগুলি পড়লে মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে।হৃদয়ে অন্যরকম এক প্রশান্তির অস্তিত্ব অনুভব করি।আর তখন নিজের অভাবকে আর অভাবই মনে হয়না।আল্লাহর কাছে নিজের অভাবের কথা বলতে লজ্জা লাগে।

মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। অল্পে যে তুষ্ট থাকতে পেড়েছে সেই সবচাইতে অভাবমুক্ত,সেই পৃথিবীর সবচাইতে ধনী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তার প্রতি তুমি সন্তুষ্টি প্রকাশ কর, তাহলে তুমিই সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে”। (আহমদ ও তিরমিজি)

ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : “সে ব্যক্তিই সফলকাম, যাকে ইসলামের হিদায়াত ও পরিমাণ মত রিযক প্রদান করা হয়েছে, আর সে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে”। (মুসলিম)

পরিশেষে,আল্লাহর কাছে চাওয়া একটাই “ হে আল্লাহ, আমাদের অল্পে তুষ্ট থাকার নেয়ামাত দান করুন এবং আপনার দ্বীনের জন্য আমাদের জান-মালকে কবুল করে নিন”।

আমীন।

নিচে কিছু ফটো দেখুন।তাহলেই বুঝবেন আমরা কত সাচ্ছন্দে আছি।















বিষয়: বিবিধ

২৪৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File