একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ১৭ মার্চ, ২০১৩, ০৩:১২:৫৭ রাত

দীর্ঘদিন যাবত ভালো ঘুম হয় না। নতুন করে কি আর বলবো! এদিকে বাজারের যা অবস্থা! যা বেতন পাই তা দিয়ে কিছুতেই সংসার নামক গাড়িটার চাকা গড়াতে চায় না। মাসের পনের দিন না যেতেই পকেটের অবস্থা গড়ের মাঠ। এসব খুব পুরনো কথা। আপনার, আমার, সবার নিত্যনৈমিত্তিক কাহিনী। আমার মুখে পুরনো প্যাচালের প্রতিধ্বনি শুনিয়ে শুধু শুধু কষ্টটাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি নিশ্চয়ই। কথাগুলো আপনার কাছে নিশ্চয়ই ভাঙ্গা রেকর্ডের মত শোনাবে। যাহোক, যা বলছিলাম। অনেকদিন হলো ভালো ঘুম হয় না। কারণ নানাবিধ। সংসার পোষার চিন্তা, ছেলে-মেয়ের আবদার মেটানো, স্কুল খরচার টাকা যোগানো, আত্মীয় স্বজনের মান অভিমান ভাঙ্গানো, নিত্যনৈমিত্তিক বেড়ে যাওয়া বাসভাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে বাজেট বাড়ানো, রিক্সাওয়ালার সাথে খিস্তি খেউড়-ঝগড়া-ঝাটি, উত্তেজিত মন মেজাজ, ভবিষ্যতের চিন্তা প্রভৃতির ‘কল্যাণে’ ভালো ঘুম হয় না। ঘুমালেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেশীর ভাগ সময় দেখি আমার চারপাশে অনেক হায়েনা। ভয়ঙ্কর দাঁত বের করে আমাকে কামড় দিতে আসছে। আমি ভয়ে সিঁটকে যাই। কখনো বা ভয়ে উন্মাদের মত দৌঁড়াতে থাকি। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি, আর দৌঁড়াতে পারি না। এক সময় পা দুটো ভয়ঙ্কর ভারি হয়ে যায়। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। আর এগোতে পারি না। এই বুঝি কামড় বসালো পায়ে। না, কামড় দেয়ার আগেই দেখি হায়েনা আর নেই। হঠাৎ হায়েনার চেহারা মানুষের আকৃতি নিয়ে নেয়। তখনি চেহারাটা চিনে ফেলি। এ চেহারাটা আমার বাড়িওয়ালা মশাইয়ের। মাস শেষ হতে না হতেই যিনি দুয়ারে এসে কড়া নাড়েন বাসা ভাড়ার জন্য। বাসা ভাড়া দেওয়া হয়নি। আবার কোনদিন দেখি পাওনাদারের মুখ, দোকানদারের মুখ। আর সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম আর হয় না। ভয় হয় কোনদিন না আবার ঘুমের ঘোরেই স্ট্রোক করে বসি। স্বাস্থ্য এবং বয়সের যা অবস্থা! যেকোন সময় ওটাও হয়ে যেতে পারে। যা খাবার খাই-তাতে করে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেসব কার্বাইডযুক্ত বিষাক্ত তরিতরকারী, ফলমূল, ফরমালিনযুক্ত মাছ খাই তার বদৌলতে অনেক আগেই বেসিক আয়ু ফুরিয়ে গেছে; বেঁচে আছি বোনাসের উপর। একটা সময় ছিলো যখন খুব ঘুমিয়েছিলাম। সেটা বাপের হোটেলে খাওয়ার সময়ের কথা। মা ছিলেন বাবুর্চি কাম সার্ভেয়ার। তিনি যে করেই হোক আমাদের সকল ভাইবোনদের আহার্যের ব্যবস্থা করতেন। বিনা পয়সায় বা’জান খাইয়ে বড় করে তুলেছেন। সংসারের কোন কাজে ব্যবহার করেন নি। নিজের উপর সব পরিশ্রমের ভার নিয়ে, নিজের পিঠে সংসারের রোদ বৃষ্টি ঝড় সামলে আমাদেরকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। আমরা ননীর পুতুলের মতো বড় হয়েছি। তাদের একটাই চাওয়া, আমরা যেন পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকি। আমরা সেখানেও ফাঁকি দিতাম। তবে পড়াশোনার জন্য তারা যতটা না চাপাচাপি করতেন তারচেয়ে বেশি বলতেন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য। বলতেন, ভালো মানুষ হতে পারলেই হয়। ভালো মানুষ হয়তো হয়েছি, কিন্তু ভালো মানুষ হওয়াটা এই যুগে ঠিক হয় নি বোধ হয়। খারাপ হলেই মনে হয় ভালো হতো। তাই বাবার জন্য মায়ের জন্য দুঃখ হয়, হয়তো একটু অভিমানও হয়। তারা যদি ‘কোন উপায়ে’ একটা বাড়ি রেখে যেতে পারতেন তাহলে অন্ততপক্ষে বাড়িওয়ালাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতে হত না।

কিন্তু বাবার দেয়া শিক্ষাকে অবমূল্যায়নও করতে পারি নি, কখনো বিবেককে বিক্রী করতে পারি নি। তবে মনে পড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম ছোট বেলায়। আর আজ বিভূতি বাবুর ‘আরণ্যক’ এর ভাষাকে নকল করে বলতে হয় ‘ঘুমিয়েছিলাম কতকাল আগে!’ হয়তো আমার ঘুমের বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে ওখানেই। যাক এসব কথা। গতকাল হরতাল ছিলো। হরতাল হলেও আগে বুকে সাহস নিয়ে অফিসে যেতাম। ইদানিং যে অবস্থা দেখি! বলা নেই কওয়া নেই- কোত্থেকে যে পেট্রোলের বোতল এসে বাসের জানালা দিয়ে ভেতরে হাজির হয়, আর দাউ দাউ করা আগুন, মুহুর্তেই জ্বলে পুড়ে ছারখার, গাড়ি মানুষ একাকার। সে কি ভয়াবহ বিভৎসতা! গা শিউরে উঠে। এখন তাই আর হরতালের সময় বাইরে বেরোই না। এই ওসিলায় অফিস ফাঁকি দিয়ে দুপুরে খেয়ে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিয়েছিলাম, কোত্থেকে যেন রাজ্যের ঘুম এসে জড়িয়ে ধরলো। ঘুম আসার ঠিক আগে মনে হলো, খুব আরাম লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। দীর্ঘ গভীর ঘুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

দেখলাম আমি আমার বড় কর্তার রুমে। ঠিক সময়ে অফিসে হাজির হয়েছি। রাস্তায় কোন জ্যাম ছিলো না। প্রতিদিনের মতো দেখলাম না কোথাও ট্রাফিক পুলিস কোন ট্রাক, বাস কিংবা সিএনজি ওয়ালাকে আটকিয়ে, বিরাট জ্যাম বাধিয়ে ঘুষ খেতে। শুনলাম না কান ঝালাপালা করা গাড়ির বিকট হর্ণ বাজতে। গাড়িগুলো যার যার লেইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শা শা গতিতে। কোন মিছিল নাই রাস্তায়। প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে যাওয়া সময় বাইরে তাকিয়ে অবাক, দেখি ওখানে কোন মানববন্ধন নেই। এই ক’দিন আগে শিক্ষক আন্দোলনে যে শিক্ষকরা ন্যায্য দাবী আদায় করার জন্য পথ অবরোধ করে পুলিসের পিপার ¯েপ্র খেয়ে বমি করেছিলো তারাও নেই। পুলিসও নেই রাস্তায়। ভেবে অবাক হলাম, কোথায় গেলো সব? তবে কি তাদের সবার সব দাবি দাওয়া সরকার মেনে নিয়েছে? পল্টনে এসে দেখলাম সিপিবি কিংবা কম্যুনিস্ট আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-যাদের বিকেল বেলা পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে একপাক মিছিল না করলে বদহজম হয়ে যায়, রাতে ঘুম হয় না- তাদেরও আজ মিছিলের আয়োজন নেই। ফুটপাতগুলো এতো খালি কেন? যারা পথ বন্ধ করে মালামাল বিক্রি করতেন তারা কোথায়? ফুটপাতে যে মহিলাটা তার সন্তানটাকে লম্বা শিকল দিয়ে বেঁধে ঘুমিয়ে থাকতো- পাশে একটা থালা দিয়ে সে-ই বা গেলো কোথায়? আজ কি ছুটির দিন? আমি কি ভুল করে কোন ভাঙ্গা হাটের দিনে এসে হাজির হয়েছি? ঘড়ির ব্যবহার তো অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। মোবাইল ফোন নামক যন্ত্রণাময় যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে দেখি আজ তো কোন বন্ধের দিন নয়। যাক- তবু অফিস থেকে ঘুরে আসি। ছুটি থাকলে তো অন্যরাও কেউ আসবে না। আমিও না হয় বাড়িতে ফিরে যাবো। কিন্তু দেখি অফিস খোলা। বড় সাহেব আমার সময়ানুবর্তিতার প্রসংশা করলেন। আমার বকেয়া বেতনের যে টাকাগুলো অনেকদিন থেকেই ঝুলছিলো তারও সিঁকে ছিড়লো। বস জানালেন ব্যবসা ভালো হওয়াতে আমাদের গত ঈদের অনাদায়ী বোনাসটা আজকে শোধ করে দিবেন। আর সেই উপলক্ষ্যে আমাদের আজকে সবার ছুটি। কি মজা, কি মজা! নিজেকে শিশুর মতো মনে হচ্ছে। স্কুল ছুটি হলে যেমনটা হতো আগে ঠিক সেইরকম। ছুটি ছুটি ছুটি গরম গরম রুটি। টাকাগুলো উঠিয়ে দিলাম ভোঁ-দৌঁড়। সিএনজি নিলাম একটা। আশ্চর্য! সি.এন.জি. ওয়ালার মুখে হাসি, একবারও না করলো না। ঘটনা কি! সাথে সাথেই গাড়ি স্টার্ট। যাবো তো মাত্র ফার্মগেট পর্যন্ত! ওমা এ আবার কি! মিটারও দেখি আছে। কিছু না বলতেই মিটার চালু করে দিলো ড্রাইভার। হাসপাতালে যাবো। অনেকদিন আগে থেকে এক আত্মীয় আছেন হাসপাতালে। দশ মিনিট লাগলো না, চলে এলাম। হাসপাতালে ঢুকতে যাবো আর অমনি লক্ষ্য করলাম সেখানে কোন দালাল নেই। নার্সরা দাঁড়িয়ে আছেন পরীদের মত সাদা পোশাক পরে। আমি হাসপাতালে যেতে ভয় পেতাম হাসপাতালের দুর্গন্ধ, ওষুধপত্র আর ডাক্তারদের ধমকানির কারণে । কি আশ্চর্র্য্য! হাসপাতালে তেমন কোন রোগীই নাই। নার্সরা বসে আমার আত্মীয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। কোন দুর্ব্যবহার নেই। কোন উচ্চবাক্য নেই। নার্স জানালেন আপনার আত্মীয় এখন পুরোপুরি সুস্থ। আমি তো পুরোই থঃ। বলেন কি! এখানের ডাক্তারই তো কিছুদিন আগে বলেছিলো রোগীর আশা ছেড়ে দেন। ভালমন্দ খাওয়ান। সেই রোগী দেখি এখন পুরো ভালো। ভালো করে খেয়াল করলাম চারিদিকে। হাসপাতালটাকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। এখানকার আবহাওয়া আর পরিবেশে এতই আনন্দময় ও স্বাস্থ্যকর থাকলে যে কোন রোগী এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাবে। যাক, মনে অনেক আনন্দ। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হেঁটে ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রীজের দিকে গেলাম। একি! এখানেও আজ ভীড় নেই। হকারদের হাঙ্গামাও নেই। অথচ পুলিসের দাবড়ানি ছাড়া তারা এই স্থান কখনোই ত্যাগ করে না। কিন্তু কোথাও তো পুলিসর টিকিটিও নেই। তাহলে হকারগুলো গেলোই বা কেন? কি জানি! আজ মনে হয় আমার মাথায় কোন গোলমাল চলছে। কিছুই মিলছে না। মানুষের মাঝে কোন তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই। নেই কোন হাঙ্গামাও। এতো শান্তি কেন? অথচ এই এখানে দাঁড়িয়ে দুইপাশের চলন্ত মানুষের হন-হন যাত্রা দেখে আমি ভাবতাম, না জানি কোন অনন্তের দিকে এই মানুষগুলোর যাত্রা! কোথায় চলেছে তারা? কিসের পেছনে? সবার চেহারায় হন্তদন্ত আর তাড়া। উদ্বেগে মাখা মুখগুলো। অথচ আজ চেহারাগুলো দেখে মনে হয় কত সুখী তারা। কোন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার চিহ্নও নেই। কপালের ভাঁজগুলো আগের মতো দেখা যাচ্ছে না, সব টান টান। আমার চেহারাটাও আয়নায় একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার এই ‘ইদুরমুখো’ চেহারাটাও কি এমন সুখী সুখী হয়ে গেছে? একটা সেলুনে ঢুকে পকেট থেকে চিরুনি বের করে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। ওমা! চুলগুলো এলোমেলো নেই। ধুলোবালিও নেই। আয়নায় চেহারা দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, আমার বয়স কতো! ঘরে ফিরে দেখি বউয়ের হাসি মুখ, যা সেই কবে যে দেখেছি! সম্ভবত বিয়ের আগে বা প্রাথমিক যুগে। কোন ধরণের অভাব কিংবা অভিযোগের সুুর নেই। শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো এক গ্লাস। হঠাৎ কেন জানি মনে হলো আমি সম্ভবত এই মহিলাটাকে খুব ঠকিয়েছি। কোন পয়সাওয়ালার সাথে বিয়ে হলে হয়তো এই বয়সে এতোটা বুড়িয়ে যেতো না। সংসারের পেছনে তার যে খাটাখাটনি, পরিশ্রম- তার কতটাই বা মূল্য আমি দিতে পেরেছি? বিপদে আপদে কতভাবেই না সে আমাকে সহযোগিতা করেছে! পাওনাদারের ঋণ শোধ করতে ওর মায়ের দেওয়া গলার হারটাও বেঁচে দিয়েছিলো। আজ কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয়, যেহেতু পকেটে কয়টা পয়সা আছে। বিকেলে বউকে নিয়ে বেরোলাম। পথে আমার বাল্যকালে শিক্ষকের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার কি যেন হল, আমি এগিয়ে গিয়ে কদমবুসি করলাম। তিনি আমাকে দোয়া করে দিলেন। বিষয়টা কেমন যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ লাগলো নিজের কাছেই। আজকালের ছাত্ররা পকেটে ছুরি পিস্তল নিয়ে ঘুরে আর শিক্ষকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে দলবাজি করেন, কোন্দল করেন, পদোন্নতির জন্য তদ্বির করেন। শিক্ষকতা আজকাল লাভজনক পেশা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র। লাখ লাখ টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে যারা এই প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে বেরোয় তারা যেন একেকটা ক্ষুধার্ত হায়েনা। তারা চায় ছাত্রজীবনে যে অর্থ ব্যায় করা হয়েছে তা অল্প কয়েক বছরের মধ্যে উঠিয়ে ফেলতে। তাতে করে ডাক্তার হয়ে রোগীদের জীবন নিয়ে খেলতেও আপত্তি নাই, হেড ইঞ্জিনিয়ার নিুমানের নির্মাণ সামগ্রি দিয়ে ব্রীজ কালভার্ট বানাও-বাধা নেই, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তা হয়ে বে-আইনী লোকের কাছে ঘুষ খাও, কার ভিটে গেলো, কার ঘর গেলো তা ভাবার দরকার নেই। ন্যায় অন্যায়ের কবর তো অনেক আগেই রচিত হয়ে গেছে, এটাতো কলিযুগ। এই যুগে সব জায়েজ, নিজের উন্নয়নের জন্য সব হালাল। ন্যায় সততার বাণী সব ভাগাড়ে যাক।

বউকে নিয়ে স্বর্ণকারের দোকানে গেলাম। ওমা! একি ১৪০০ বছর আগে মদিনার সেই বাজার নাকি? দোকানে ছয় সাতটা তালা নেই, পাহারাদার নেই। দোকানীই বা গেলো কোথায়? স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে দোকানী কোথাও যায় এই বাংলায়? আমার মনে হয় আজকে আমার আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। উল্টো-পাল্টা দেখছি। যাক্ দেখছি যখন তখন তো আর কিছু করার নেই, চোখ বুজে দেখতে থাকি। অনেকক্ষণ পর দোকানি এলেন, কাজ শেষে ফিরে চললাম। ফেরার পথে গিন্নিকে নিয়ে বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে দোকানিকে আর আগের মতো কসাই মনে হলো না। খুব আন্তরিকতার সাথে পণ্যসামগ্রী দেখিয়ে দিলেন। ভালো আর খারাপ দুটাই দেখালেন। দুটোর দাম আলাদা। কসাইয়ের দোকানে নাকি আজকাল মহিষের গোস্ত পাওয়া যায় না। সবই যদি গরুর গোস্ত হয় তাহলে ভারতীয় মহিষের চালান আর দেশের মহিষগুলো যায় কোথায়? কসাই দেখিয়ে দিলেন, এইটা গরুর গোস্ত আর ঐটা মহিষের গোস্ত। কোনটা নিবেন। বাবারে স্বপ্ন দেখছি নাকি? ফেরার পথে আবার নাকি দেখি গাছতলায় টাকার তোড়া নিয়ে কেউ বসে আছেন আর বলছেন, “কাউকে খুজে পেলাম না টাকা নেওয়ার মতো এই শহরে!” কি জানি দেখলে দেখতেও পারি। ১৪০০ বছর আগে অর্ধেক পৃথিবীতে যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তখন এমন দৃশ্য তেমন দুর্লভ ছিল না। তখন দেখা যেত সুন্দরী যুবতী গায়ে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় দিনে রাতে পথ চলছে একা। তার মনে কোন ক্ষতির আশঙ্কাও জাগত না। কিন্তু এই যুগে বসে সেই স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস নেই। যাহোক স্বপ্নে হঠাৎ চলে গেলাম ছোট্টবেলায়। গ্রামের সেই নির্মল আবহাওয়ার দুরন্ত বিকেল। ঘন ঝোপঝাড়ে ঘেরা চারিদিক। শেষ বিকেলে যখন বৃষ্টি সবকিছু ধুয়ে মুছে দিয়ে যায়- কি আকাশকে কি প্রকৃতিকে, আর পশ্চিম আকাশে স্বচ্ছ সূর্যটা মেঘ ভেদ করে উঁকি দিয়ে জেগে উঠে রক্তিম আভায়। বাতাসে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। পোকামাকড়েরা রেরিয়ে আসে মাটির নিচ থেকে। ভিজে ঘাসের উপরে খালি পায়ে হাঁটছি আমি, মনে হচ্ছে জীবন কত আনন্দের! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। আমি পুকুর ঘাটে গিয়ে কাকচক্ষু পানির দিকে নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ একটা কুমির লাফিয়ে উঠলো আমার মুখের সামনে। কুমিরের মুখটা ঠিক বাড়িওয়ালার মত। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম আর...বুঝতেই পারছেন- অপমৃত্যু ঘটলা আমার সুখ-স্বপ্নের।

তাকিয়ে দেখলাম চিরচেনা সেই অন্ধকার ঘর। যেখানে আলোর উৎস লো ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক বাতি, বাতাসের উৎস বুড়ো মিল্লাত ফ্যান। স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা দেয়াল। জানালার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা পানির নালা। সেখানে চলছে হাজারো মশার একঘেয়ে কীর্তন। আগের সেই সংসার-সমরাঙ্গন, যুদ্ধ করো প্রাণপণ।

উফ্, নিজের পশ্চাৎদেশে লাথি দিতে ইচ্ছে হলো। কি সুন্দর একটা স্বপ্নই না দেখছিলাম এতক্ষণ। আহা! হারিয়ে যাওয়া এমন জীবন কি আর ফিরে আসবে না? এ আশা কি শুধু অলীক কল্পনাই থেকে যাবে? সেই সুখ শান্তির ইতিহাস কি কেবল মোটা মোটা বইয়ের পাতায় রয়ে যাবে? সুখ কি কেবল স্বপ্নেই দেখবো? স্বপ্নকি কেবলই মিথ্যা, শুধুই মায়ার খেলা, শুধুই প্রহসন আর প্রহেলিকা? সব ধর্মগ্রন্থেই পড়েছি, সেই শান্তির যুগ নাকি আবার ফেরত আসবে কালের চিরন্তন চক্র পূরণ করতে। যাক, মুখটাকে কালো করে, দুঃখী দুঃখী মন নিয়ে বাইরের দিকে বেরোলাম। রাস্তার পাশে গিয়ে দেখি পুলিসের আনাগোনা আর উৎসুক জনতার ভীড়। কোন এক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বোমা ফাটিয়েছে এখানে। কয়েকজন মানুষের হাত পা মাথা ফেটে গেছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনটা আরো ব্যথায় কেঁদে উঠলো। অন্যদিন হলে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না। ওসব এখন দেখতে দেখতে সয়ে গেছে। বস্তায় ভরা ছাব্বিশ টুকরার লাশও দেখেছি। আজ খারাপ লাগছে স্বপ্নটা ভেবে যে, এইমাত্র কি সুন্দর একটা দুনিয়া ঘুরে এলাম, আর এখন আমি কোন দুনিয়ায়! এতো সুখ-স্বপ্নের পর সেই ঘৃনীত রাজনীতির অনুসারীদের তাণ্ডবের মুখোমুখী হলাম, যারা হানাহানি-হিংসা-বিদ্বেষ আর বায়োবীয় কিছু ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে নিজেদেরকে খণ্ড-বিখণ্ড করে, পৃথিবীর বুকে বিভেদের প্রাচীর তৈরী করে কল্পিত সীমা এঁকে মানুষকে পশুর মতো পোষার চেষ্টা করছে, তাদেরকে বানিয়ে রেখেছে চিড়িয়াখানার জানোয়ার, দুনিয়াটাকে বানিয়ে রেখেছে নরক। খুব অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হলো তাদের, খুব করে

আমি এখনো মন্তব্য করতে এবং জবাব দিতে পারছি না। সবার কাছে এই জন্য দু:খ প্রকাশ করছি।

বিষয়: বিবিধ

১২৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File