অগণতান্ত্রিকদের প্রতি গণতান্ত্রিকদের নির্ভরতা কেন?

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:৪৪:৪৯ রাত

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অবাস্তব, ভিত্তিহীন ও ভারসাম্যহীন একটি জীবনব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। আজ পর্যন্ত এর কোন আকার-আকৃতি কেউ খুঁজে পায় নি। একেক দেশে একেক রকম এর রূপ। যারা এর উদ্গাতা তারা পর্যন্ত আজও একে নিজেদের জীবনে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। যারা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের কাছে এই গণতন্ত্র রপ্তানি করে গেছেন তারা দীর্ঘ দুইশ বছর আমাদেরকে বন্দুকের জোরে শাসন করে গেছেন, তখনও কিন্তু এখানে কোন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সুতরাং গণতন্ত্র প্রযোজ্য শুধু গোলাম জাতির জন্য। প্রভুর জন্য নয়। আর গোলামরাও অনন্যোপায় হয়ে প্রভুদের মনোতুষ্টির জন্য, প্রভুদের খুশি করার জন্য তা মেনে চলেছে।

যাই হোক, গণতন্ত্র মেনে নিয়ে সবচাইতে করুণ অবস্থা হয়েছে তথাকথিত এই মোসলেম জাতিটির। এরা এই গণতন্ত্রের চর্চা করে নিজেরা নিজেরা মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, অপরদিকে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে মিছিল মিটিং, হরতাল-অবরোধের নামে রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দেয়। এই গোলাম জাতির মধ্যে দুইটি প্রধান ভাগ বিদ্যমান। একটি সামরিকভাগ এবং অন্যটি বেসামরিকভাগ। বেসামরিকভাগটি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সামরিক অংশটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভাগ বসাক তা কিছুতেই কামনা করে না। কোন একটি অংশ যদি সামরিক ভাগ থেকে উঠে এসে ক্ষমতা দখল করে তখন তারা এদের কঠোর সমালোচনা করে। এরা কথায় কথায় তাদের প্রতি দোষারোপ করে বলে এরা সামরিক ছাউনি থেকে উঠে আসা দল, এদের মধ্যে গণতন্ত্র নেই, সমঝোতা নেই, এরা বর্বর ইত্যাদি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় যে অভিযোগটি তারা করে থাকে তা হচ্ছে এই যে সামরিক বাহিনী সুবিধা গ্রহণকারী অংশ। এরা বসে বসে রাষ্ট্রীয় সম্পদের গুষ্টি উদ্ধার করে। এরা কোন কাজে আসে না। এরা যদি কখনো কখনো ক্ষমতায় আসেও তখন তাদের প্রতি অভিযোগ তুলে বলা হয় যে, এরা ক্ষমতা দখল করে বেসামরিক প্রশাসনের কাঠামো ভেঙ্গে দেয়, রাজনীতিবিদদের দুর্দশা ডেকে আনে, গণ-মানুষের সাথে এরা রাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিকদের মধ্যে যত মতভেদই থাকুক না কেন, এই ব্যাপারে তারা সকলেই একমত। অপরদিকে সামরিক ভাগটি বেসামরিক অংশটিকে বিশৃঙ্খল সিভিলিয়ান ও দুর্নীতিবাজ বলে হেয় জ্ঞান করে থাকে। যা হোক, তাদের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আজ আমাদের আলোচনা নয়। এ বিষয় নিয়ে অতীতেও বহু কথা হয়ে গেছে।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় একটি দেশে সামরিক বাহিনী এবং গণতান্ত্রিকদের এই দ্বন্দ্বের ফলাফল নিয়ে। একটি দেশে সামরিক বাহিনী মূলত বৈদেশিক শত্র“র মোকাবেলার জন্যই গড়ে তোলা হয়। দেশের চৌকষ ও শারীরিক ও মানষিককভাবে যোগ্য এবং মেধাবী সন্তানগণই এই বাহিনীতে যোগ দেন। রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করা নয়, রাষ্ট্রের প্রতি আত্মোৎসর্গ করাই তাদের লক্ষ্য। অন্যদিকে সামরিক ভাষায় যারা সিভিলিয়ান অর্থাৎ সাধারণ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ রয়েছেন তারা পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা তথাকথিত গণতন্ত্রের চর্চা করে, গণতন্ত্রের নামে সস্তা কথা প্রচার করে, মানুষের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যান। কিন্তু বিভেদের বীজ বোনা বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে তারা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে পারেন না। নির্বাচনে কারচুপি, ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি করে তারা সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তোলে। অপরদিকে বিরোধী দলের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের কারণে বেশিরভাগ সময়ই নির্বাচিত একটি সরকার তাদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে না। কোন সরকার যদি বিরোধী মতকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণও করে তবুও দেখা যায় ক্ষমতার পালা পরিবর্তনের সময় দেশ চূড়ান্ত অরাজকতার দিকে ধাবিত হয়। এই অবস্থায় বিবদমান দুটি পক্ষের অভিভাবক হয়ে কেউ সমঝোতা কিংবা আপস-রফার মাধ্যমে কোন একটি সমাধান এনে দেবার কেউ থাকে না। রাজপথে চলে তখন মানুষ হত্যার নামে পাল্টা পাল্টি গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এটা এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম। এই সিস্টেম যখন ভেঙ্গে পড়ে চূড়ান্ত গহ্বরে পতিত হওয়ার উপক্রম হয় তখন গণতান্ত্রিক উভয়পক্ষই ব্যারাকে বসবাস করা অংশটি, যারা কখনো গণতন্ত্র মানে না, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সিভিলিয়ানদের বক্তব্য-বিবৃতিতে, সেমিনারে, টকশো’তে যাদেরকে অকর্মন্য, জঘন্য বলে অভিহিত করতো তাদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়।

চিত্তাকর্ষক বিষয় এই যে, পাশ্চাত্যের প্রেসক্রাইব করা রীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক আওতাভুক্ত একটি এলাকায় একই সাথে গণতন্ত্র মান্যকারী এবং গণতন্ত্রহীন দুটো অবস্থা চলার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে একটি দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে গণতন্ত্র জায়েজ আর ক্যান্টনমেন্টে গণতন্ত্র চলে না। সেখানে কমান্ডারের হুকুমই চূড়ান্ত। সেটা কার পছন্দ হয়েছে আর কার পছন্দ হয় নি তা ধর্তব্য নয়। ‘অমুক দাবী মানতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে’ এই সব স্লোগান বিশৃঙ্খল সিভিলিয়ানদের মধ্যে চলতে পারে কিন্তু সেনাবাহিনীতে নয়। আর সিভিলিয়ানদের মত সেখানে এসব চললে তারাও সিভিলিয়ানদের মতোই বিশৃঙ্খল সৃষ্টি করে লেজে গোবরে আটকে থাকতো। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত গালাগালি খাওয়া অগণতান্ত্রিকরাই দেশ রক্ষায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রায় গৃহযুদ্ধের সমতুল্য। দেশের অধিকাংশ এলাকা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন। বিভিন্ন জেলার জেলাপ্রশাসকগণ কেন্দ্রে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করছেন। প্রশাসনের কার্য-পরিধিও ক্রমশঃ খাটো হয়ে আসছে। আগামী ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এই চলমান অরাজক পরিস্থিতি বজায় থাকলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে না বলে অনেকে বলে আসছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও চলমান সহিংস পরিস্থিতি বজায় থাকলে নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষক দল দেশে পাঠাবে না বলে জানিয়েছে। তাই দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যাকুল হয়ে এখনই দেশে সেনাবাহিনী নামানোর জন্য তোড়জোর করছেন। যদিও সেনাবাহিনী নামার কথা শুধুমাত্র নির্বাচনকালীন সময়ে। আচার-আচরণে মনে হচ্ছে তারা একপ্রকারে মেনেই নিয়েছেন যে সেনাবাহিনী ছাড়া এই মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারও শেষ অস্ত্র হিসেবে সেনাবাহিনীকেই ব্যবহার করবে যা আকারে ইঙ্গিতে এখনি পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে সেই লক্ষ্যে প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশও দিয়েছেন।

গণতান্ত্রিকদের এই যে অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি নির্ভরতা এটা কিন্তু অগণতান্ত্রিক শক্তিটিও জানে। তাই তারা এই নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের নৈতিক কিংবা অনৈতিক দাবি-দাওয়া গণতান্ত্রিকদের হাত থেকে আদায় করে নেয়। দেশের সিংহভাগ বাজেট তারা ভোগ করে থাকে। সিভিলিয়ানরা মুখে নানা কথা বললেও তারা অগণতান্ত্রিকদের এই দাবি-দাওয়া পূরণে বাধ্য হয়। কারণ ক্ষমতায় থাকতে হলে তাদেরকে হাতের মধ্যে রাখতে হয়। না হলে বিরোধী পক্ষ সরকারকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ফেলবে।

এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক আর অগণতান্ত্রিক কোন মুখ্য বিষয় নয়। নীতি-নৈতিকতাই প্রধান। এই বিষয়টি এই দুটো পক্ষের মধ্যেই নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে। এই দুইপক্ষের কোন পক্ষের কারো কাছেই শান্তি পাওয়া যাবে না। এর প্রমাণ অতীতের সেনা শাসন আমলগুলো এবং বর্তমান চলমান সঙ্কট। তাই এই মুহূর্তে মানবজাতির মুক্তির জন্য এমন একটা সিস্টেম বা জীবন ব্যবস্থা অপরিহার্য যেখানে ন্যায়-নীতি, হকই চূড়ান্ত। সেখানে সামরিক কিংবা বেসামরিকের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। কি শাসক- কি শাসিত, কি সামরিক-কি বেসামরিক সবার জন্য একই মানদণ্ড প্রযোজ্য হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এমনই একটি ভারসাম্যযুক্ত জীবন বিধান দান করেছেন। একমাত্র সেই জীবন-বিধান কায়েম করার মাধ্যমে জাতির মধ্য থেকে বিভেদ-ব্যবধান দূর করে শান্তি আনা সম্ভব। অন্যথায় আমাদের এই সঙ্কট কখনো দূর হবে না।

বিষয়: বিবিধ

১৪৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File