সভ্যতার বৃথা আস্ফালন!

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১২:০৮:৫৫ রাত



একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ নিজেদেরকে সভ্য মনে করে গর্ববোধ করে। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে নিজেদেরকে উন্নত মনে করে অহঙ্কার করে। তারা অতীতের পানে তাকায় কৃপা আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে। অতীতকে কখনো বা আখ্যা দেয় আইয়্যামে জাহেলিয়া আবার কখনও বলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। যে দূরের চাঁদকে সে এতদিন মনে করত কোন এক বুড়ি সেখানে বটের তলায় বসে চরকায় সূতা কাটে, সে চাঁদের বুকে আজ থেকে বহু দিন আগেই তারা পা ফেলেছে। আজ তাদের রকেট পৌঁছেছে লালগ্রহ মঙ্গলে। তারা স্বপ্ন দেখছে হয়তো আর কিছু দিন পরেই তারা মঙ্গলেও পা রাখবে। শুধু তাই নয়, তারা হয়তো কিছু দিন পর গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবে। আকাশের বিদ্যুৎ আজ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাকে বেঁধে আজ চাকরের মত খাটানো হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে তারা গড়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। তাদের গর্বের বুক অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে স্ফীত। আরাম আয়েশ, ভোগ বিলাস করার এমন এমন যন্ত্র আবিস্কার করেছে যে হয়তো কিছু দিন পর তাদেরকে নিজ হাতে আর কোন কাজই করতে হবে না।

এত উন্নতির পরও কিন্তু এই মানুষগুলোর চোখে মুখের দিকে তাকানো যায় না। অভ্যন্তরীণভাবে তারা নিদারুণ অন্যায় আর অশান্তির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। শুধু তাই নয়, তাদের তৈরি পারমাণবিক বোমার মজুদ নিয়ে তারা সর্বদা শঙ্কিত। পৃথিবীর নানা ভৌগোলিক দেশগুলো পারস্পরিক এমন সমস্যায় আক্রান্ত যে কখন কার উপর কে পারমাণবিক বোমা ছুঁড়ে মারে তা চিন্তা করে সর্বদাই তাদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। ইতোমধ্যে তারা যে তা ছুঁড়ে মারেনি তাও নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ১৯৪৫ সালে তারা চেরি ফুলের দেশ খ্যাত জাপানের দুটি শহরকে আণবিক বোমার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। হ্যাঁ, তারা বিলাসী হয়েছে বটে, তবে শান্তি পায়নি। অতীতের যে কোন সময়ের পরিসংখ্যান টানলে দেখা যাবে গত ১৯০০ বছরের যে কোন সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের মানুষ হত্যা করতে যদি তাদের এক বছর লাগত সেটা আজ এক সেকেন্ডের ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে।

সভ্যতা নিয়ে যাদের এত গর্ব তাদেরকে এসব কথা শোনালে নিশ্চয় তাদের গর্বে স্ফীত বুকটা বেলুনের মত চুপসে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়, মানুষ সুন্দর পোশাকের আড়ালে যেমন তার শরীরের নোংরা ক্ষতকে ঢেকে রাখে, এই সভ্যতার মানুষগুলোও ঠিক তেমনি।

হ্যাঁ, আদুরীর কথাই বলছি। মানুষ কোন পর্যায়ে নামলে এত নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে, ৯বছর বয়সী একটা ছোট শিশুকে মানুষ এমনভাবে মারতে পারে? কোন অভাব, কোন অপূর্ণতা তাদের?

তার নাম আদুরী। সে রাজধানীর পল্লবীর গৃহকর্তী নওরীন আক্তার নদীর বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো। পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠির বাসিন্দা মৃত খালেক মৃধার কন্যা আদুরী দুমাস আগে রাজধানীর পল্লবীতে গৃহবধূ নদীর বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগদান করে। কাজে যোগদানের পর থেকেই নদী আদুরীকে না খাইয়ে রাখাসহ বীভৎস সব শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতিত শিশুটির ভাষ্যমতে, তাকে গৃহকর্ত্রী নওরীন, তাঁর বোন পুষ্পিতা ও মা ইশরাত জাহান মারধর করতেন। গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতেন, ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে দিতেন।

এরই ধারাবাহিকতায় নদীর পরিবারের লোকজন আদুরীকে বেদম প্রহার করলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে আদুরীকে মৃত ভেবে তারা ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন বারিধারা ডিওএইচএস এলাকায় ময়লা আবর্জনার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। পরে এলাকার লোকজন গত রোববার শিশুটিকে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করে থানায় সংবাদ দিলে ক্যান্টনমেন্ট থানার এসআই মান্নান মুমূর্ষু অবস্থায় আদুরীকে অজ্ঞাত শিশু পরিচয়ে দুজন নারীর মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। উদ্ধারের সময় শিশু আদুরীর শরীরে আয়রন ও গরম খুন্তির পোড়া দাগ ছাড়াও তার মাথা এবং দেহের বিভিন্নস্থানে প্রহারের চিহ্ন ছিল। আদুরীর মা সাফিয়া বেগম মেয়ের সন্ধান না পেয়ে লোকমারফত খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আদুরীকে শনাক্ত করেন। পরে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে সাফিয়া বেগম পুলিশের সহায়তা চাইলে পল্লবী থানা পুলিশ গৃহকর্তী নদীকে আটক করে।

হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন শিশুটির অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়।

যারা এই শিশুটিকে টিভির পর্দায় দেখেছেন তারা ঘটনা না শুনলে নিশ্চয় অবাক হতেন। নিশ্চয় ভেবে বসতেন এটা আফ্রিকা মহাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত কোন দেশের মানব শিশু কোনভাবে ছিটকে এদেশে এসে পড়েছে। না, তা নয়। এটা এই সভ্যতারই অধীনে বসবাস করা একটি কন্যা শিশু। দেশে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে বলেও কেউ দাবি করতে পারবে না। সে সভ্য মানুষের হাতে নির্যাতিত হতভাগী এক শিশু।

অনেকে বলতে পারেন যে এর চাইতে কত বড় এবং নিষ্ঠুর ঘটনাইতো দেশে ঘটছে, এই নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই, এর চাইতে নিষ্ঠুর এবং নৃশংস ঘটনা দুনিয়াতে অহরহই ঘটছে। কিন্তু এর পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে। কখনো বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মারা হচ্ছে, কখনো বা চোর ডাকাতকে মারা হচ্ছে, আবার কখনো বা ধর্মীয় বিরোধকে কেন্দ্র করে মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। কিন্তু এ নির্যাতনের পেছনে কোন কারণ আছে বলে জানা যায় নি। কীইবা এমন কারণ থাকতে পারে অল্প বয়সী এই মেয়েটিকে এমনভাবে নির্যাতনের পেছনে? না, গৃহবধূ নদীও কোন কারণ দর্শাতে পারেন নি।

এর কারণ আসলে সভ্যতার আত্মিক শূন্যতা নামক ভয়াবহ রোগ, এক মহামারী। আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন এক সময় আসবে- যখন কোন মানুষ অন্যকে হত্যা করবে, সে জানবে না কেন সে তাকে হত্যা করলো, আর যে নিহত হোল সেও জানবে না কেন তাকে হত্যা করা হোল। গৃহবধূ নদী এবং আদুরী তার একটি নমুনা মাত্র। গৃহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের জরিপ অনুযায়ী ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ১৩ বছরে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ৫৬৭ জন গৃহকর্মী। গৃহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১০ বছরে আমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭৯৭ জন গৃহকর্মী। এরমধ্যে মারা গেছে ৩৯৮ জন এবং আরো ২৯৯ জন গুরুতর আহত অবস্থায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে।

এছাড়া ভিন্ন কায়দায় নির্যাতনের শিকার হয় আরো অন্তত: ১শ’ গৃহকর্মী। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হলেও অপরাধীরা অর্থ কিংবা পেশী শক্তির জোরে থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই হচ্ছে আমাদের কথিত গর্বের সভ্যতার বাস্তবিক অবস্থা। অথচ এই সভ্যতা নিয়েই আমরা অহঙ্কার করি, সাফল্যের আত্মপ্রসাদে ঢেকুর তুলি। আমাদের অতীতের দিকে তাকাই করুণার দৃষ্টিতে। কিন্তু একমাত্র যান্ত্রিক প্রগতি ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়ে এই সভ্যতা কি দেখাতে পারবে তারা করুণার দৃষ্টিতে যে অতীতের দিকে তাকায় তার চেয়ে তারা উন্নতি লাভ করেছে?

আদুরীদের মত যে ঘটনা অহরহ ঘটছে তা একেকটি সুঁই, যা আমাদের সভ্যতার স্ফীত বেলুনকে বার বার ফুটো করে দেয়। মিলিয়ে দেয় আমাদের অহঙ্কারকে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা মোটেই এগোই নি। যান্ত্রিক প্রগতি ছাড়া আর সকল দিক দিয়ে অতীত থেকে শুধু পিছিয়েছি। সৃষ্টি করেছি আত্মাহীন দানবাকৃতির এক সভ্যতাকে। ধিক! এই সভ্যতাকে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File