মে দিবসের কথা/ দিবসের ফাঁদে শুকায় শ্রমিকের ঘাম

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ০১ মে, ২০১৩, ১২:৩৫:৪০ রাত

আজ মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের বেশকিছু দেশে মে দিবসকে ‘লেবার ডে’ হিসাবেও পালন করা হয়। এ দিনটি সরকারীভাবে ছুটির দিন। ১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবীতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় এইদিন পালিত হয় না। বলা হয়ে থাকে এই দিনের আগে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হত, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন। বিপরীতে মজুরী মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত, ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করে, এবং তাদের এ দাবী কার্য্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নিল না। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর ‘হে’-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিস দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে এক পুলিস নিহত হয়। পুলিসবাহিনী তৎক্ষনাত শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা পরবর্তীতে রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়। পুলিস হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করে, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, "আজ আমাদের এই নি:শব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে"। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেয় এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবী ‘অফিসিয়াল’ভাবে স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের দিন হিসেবে। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের উক্ত গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ করে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”। ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট কংগ্রেসেও ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিকশ্রেনী কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়াসহ পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য্য অর্জন করে। জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা অরগানাইজেশন (আই .এল.ও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে এবং সকল দেশে শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায়। বাংলাদেশ আই.এল.ও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ঘটনা যেহেতু ঘটেছিলো পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রে, কাজেই পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেনীর প্রাধান্যের কারণে অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশে বেশ গুরুত্ব সহকারে মে দিবস পালন করে থাকে।

শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় এত ঢাকঢোল পেটানো, এত আয়োজন হলেও সত্যিকার অর্থে কতটা মুক্তি পেয়েছে বিশ্বের খেটে খাওয়া, ঘাম ঝড়ানো শ্রমিক সম্প্রদায়- এ প্রশ্ন খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীবাসীর সামনে। ১০০ বছরের বেশী সময় পেরিয়ে গেলো শ্রমিকের মুক্তির নামে আচ্ছাসে পেটানো ঢোল। এতে ঢোলেরই যা ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে। আজও শ্রমিক আঠারো ঘন্টা কাজ করে মরে কারখানার ধোঁয়া আর কালিতে। অল্প বয়সে রোগে ভূগে, জরাজীর্ন হয়ে ধুকে ধুকে মরে এই শ্রমিকেরা। জোড় করে বাধ্য করা হয় কাজ করতে। বিনিময়ে কি পায় তারা? কতটুকু পেলো মর্যাদা? প্রায় শতবছর আগে বাংলাদেশের ‘বিদ্রোহী কবি’ তাঁর কবিতায় বর্ণনা করে গিয়েছিলেন তৎকালীন শ্রমিকদের অবস্থা। ‘কুলি মজুর’ কবিতায় সখেঁদে বলেছিলেন:

“দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে-

চোখ ফেটে এলো জল,

এমনি করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?

যে দধীচিদের হাড় দিয়া ঐ বাষ্প-শকট চলে,

বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।”

আবার,

“বল তো এসব কাহাদের দান !

তোমার অট্টালিকা,

কার খুনে রাঙ্গা ?-

ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।

তুমি জান নাকো কিন্তু পথের প্রতি ধুলিকনা জানে,

ঐ পথ ঐ জাহাজ শকট অট্টালিকার মানে !”

সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, যতই বাড়ুক হাইটেক প্রযুক্তি, উচু উচু দালান কোঠা- কিন্তু বাড়ে নি মানবতা। আজও তারা সেখানেই অবস্থান করছে। দিবসের আড়ালেই শুকিয়ে যাচ্ছে শ্রমিকের ঘাম আর খুন। শ্রমিক হারাচ্ছে তার ন্যায্য পাওনাটুকু। পুঁজিবাদী প্রতারণার অর্থব্যবস্থা শ্রমিককে দেয় নি কিছুই। সমাজতন্ত্রও দেখিয়েছে তার সত্যিকার ভয়ানক রূপ। শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিলো সেখানে। দু'টুকরো রুটির জন্য পড়তো লম্বা লাইন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সেখান থেকে মানুষ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলো। পালাতে গিয়ে তারা দেশের সীমানা প্রাচীর রেলগাড়ীর ইঞ্জিন ঠেলে ভেঙ্গে দেশ থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। অনেকে প্রিয় মাতৃভুমির মায়া চিরতরে ত্যাগ করে ছোট্ট নৌকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী সংখ্যায় আরোহণ করে পাড়িয়ে দিতে গিয়ে ডুবে মরেছে অথৈ সাগরে। তাহলে কি দিলো সমাজতন্ত্র? দিয়েছে শান্তনার একটি দিবস। হ্যাঁ, পাশাপাশি পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র দিয়েছে শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য নিজের পছন্দমত একটি ব্যবস্থা। সেটা হোচ্ছে শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার, মে দিবসের ছুটিতে গালভরা বুলি আওড়ানোর জন্য সভা সেমিনার করার সুযোগ। প্রচলিত সিস্টেম বা জীবন পদ্ধতি এটাও করেছে মালিক পক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে একটি স্থায়ী ভুল বোঝাবুঝি, অসন্তোষের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখার জন্য, একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানোর জন্য। একদিকে শ্রমিকদের অধিকার দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন করার, আন্দোলন করার, অপরদিকে মালিককে চাপে ফেলানো হচ্ছে দ্রব্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে। মালিকরা যদি শ্রমিক ইউনিয়নের চাপ, অসহোযোগ আন্দোলন, লক-আউট ইত্যাদির কারণে তাদের দাবি দাওয়া মেনেও নেয়, মজুরি বৃদ্ধি করে- ওদিকে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো যাতায়াতভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। বেতন বাড়লো তো সবকিছুর দাম বাড়লো। ফলে শ্রমিকের মজুরি দু’ টাকা বাড়লে ব্যয় বাড়ে দশ টাকা। এভাবেই আবর্তিত হয় শোষণের চক্র, ঘুরে ফিরে আসে ‘মে’ দিবসের প্রহসন। সেই সাথে শ্রমিক আজও মরে কারখানায় আগুন লেগে, ভবন ধসে, কলে চাপা পড়ে। কাগজে কলমে বড় বড় সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ দেখায় ৮ ঘন্টার বেধে দেয়া কাজের সময়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজও তাদের খেটে মরতে হয় দিনে আঠারো ঘন্টা। হাড় জিরজিরে এই শ্রমিকের ঘাড়ে চেপে আছে প্রভুদের উপভোগের দায়। তারপরেও প্রভুদের আরাম আয়েশ আর বিলাসীতাকে আরো নিচ্ছিদ্র করতে ছাটাই করা হয় সাধারণ শ্রমিকদের। তাহলে শত বছর পেরিয়ে যাওয়া এই মে দিবসের নেট ফল কি? যারা এই দিবসের ঢোল পিটাচ্ছে সজোড়ে - খোদ তাদের দেশেই আজ আন্দোলন হচ্ছে ব্যাপক আকারে। আগে হয়তো বিক্ষোভে জমায়েত হতো শত শত মানুষ। আর আজ জমায়েত হয় লাখে লাখে। ফ্রান্স, গ্রীস, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী, ইংল্যাণ্ড উত্তাল হয় আজও শ্রমিকের ক্ষোভে। দিনের পর দিন চলতে থাকা এই বিক্ষোভে শাসকের জলকামান এর গরম পানির তোড়ে ভেসে যায় শ্রমিকের অধিকার নামের অধরা বস্তুটি। তাহলে কি দিলো এই দিবস? সভ্যতার গর্ব যে অবকাঠামো, দালান কোঠা, চোখ জুড়ানো নান্দনিক স্থাপত্য, সেতু- কার শ্রম দিয়ে গড়া এই সব? যার শ্রমে গড়া সেই শ্রমিকের নাম কি খুঁজে পাওয়া যায় কোথাও? একবারও কি উচ্চারিত হয় তা? তাই বার বার মে দিবস এসে মনে করিয়ে দিয়ে যায় শ্রমিকের না পাওয়ার কথা, বঞ্চনা আর শোষণের কথা। আমাদের দেশে এবারে যে মে দিবস এলো, তা এলো এমন এক সময়ে যার মাত্র কয়েকদিন আগে রাজধানীর অদূর সাভারে একটি নয়তলা পোশাক কারখানা ধসে এই পর্যন্ত হিসাবে ৪শতাধিক প্রাণ ঝড়ে গেলো, আহত হলো আড়াই হাজারের উপরে। এখানে আজো রক্তের দাগ শুকায় নি। সম্পন্ন হয় নি উদ্ধার তৎপরতা। এখনো সম্পন্ন হয় নি দাফন কাফনের কাজ। কাটেনি শোক। শেষ হয় নি কান্নার রোল। কিন্তু যেহেতু দিবস এসে গেছে তাই আজকেও প্রতারক সভ্যতার অন্ধ অনুসারী কিছু ব্যাক্তি বক্তব্য বিবৃতি দিবে, শোনাবে শ্রমিকদের মুক্তির সুশ্রবণীয় কাব্যিক বাণী। টকশো মাতাবে বুদ্ধিজীবির দল। প্রেসক্লাবে হবে গোলটেবিল-সেমিনার। কিন্তু শ্রমিকের মুক্তি এবং শ্রমের মর্যাদা কি সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে? এই সভ্যতার ধ্বজাধারীরা কি আপসে তাদের ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে, অন্যায়- অন্যায্য নীতিকে বর্জন করবে? কিন্তু কবি তো বলে গেছেন,

“আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋন!"?

প্রশ্ন হলো কে এনে দিবে তাদের এই শুভদিন? যারা প্রকৃতপক্ষে মূল্যায়ন করবে তাদের- কোথায় তারা? কোন ব্যবস্থা দিবে তাদের মুক্তি, কে গাইবে শ্রমিকদের জন্য এই স্তবগান,

“হতুড়ি শাবল গাইতি চালিয়ে ভাঙ্গিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তোমারে সেবিতে হইল যারা মজুর, মুটে ও কুলি,

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাদেরই গান,

তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।”?

বিষয়: বিবিধ

১৫২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File