এক রানা কারাগারে - লক্ষ রানা ঘরে ঘরে
লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৩২:১৭ রাত
অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর সাভারের রানা ভবন মালিক সোহেল রানা গ্রেফতার হলেন। ঘটনার ৫ দিনের মাথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ভারতে পালানোর সময় যশোরের বেনাপোল থেকে সোহেল রানা গ্রেফতার হয়। এর আগে রানাকে গ্রেফতারের জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দান করেন। গ্রেফতারের পর সাধারণ মানুষ আশা করছে এতগুলো প্রাণের ক্ষয়-ক্ষতির দায়ে অভিযুক্ত রানার সঠিক বিচার হবে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। অভিযোগ আছে রানা ঐ ভবনের মালিক থাকায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গার্মেন্টকর্মীদের ব্যবহার করতো দলীয় কাজে। এই রানা ভবন থেকেই বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন ঠেকাতে হরতালের দিন হরতাল বিরোধী মিছিলের আয়োজন করা হতো। ঘটনার আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দিলে সেখানে কাজ করাটা ঝুকিপূর্ণ জেনেও হরতালের দিন কারখানা খোলা রেখে হরতাল প্রত্যাখ্যান হয়েছে প্রমান করতে মালিকদেরকে দিয়ে শ্রমিকদের কারখানায় আসতে বাধ্য করা হয়। আরো অভিযোগ আছে গার্মেন্টগুলোর জুট ব্যবসা, টিফিনের সাপ্লাই প্রভৃতির মাধ্যমে রানা সেখান থেকে উচ্ছিষ্ট ভোগ করতো।
কে এই রানা? : খুব সাধারণ ঘর থেকে উত্থান রানার। তার পিতা একজন সাধারণ তেল ব্যবসায়ী ছিলেন। স্থানীয় সাভার অধরচন্দ্র হাইস্কুল থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন রানা। এরপর অভাবের সংসারে লেখাপড়া আর এগোয়নি তার। রানা সেই সময়ে তার পিতার সাথে তেলের ঘানিতে কাজ করার পাশাপাশি বোতলে করে পায়ে হেটে সরিষার তেল বিক্রি করতেন। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফখরুল আলম সমরের হাত ধরে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন রানা। সমরের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে ১৯৯৮ সালে সাভার পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এর কিছুদিন পর থেকে রানা সমরের পাশাপাশি তৌহিদ জংয়ের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার চেষ্টা স্বার্থক হয়। নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করাসহ বেশকিছুদিন মুরাদ জংয়ের দেহরক্ষী হিসেবেও কাজ করেন রানা। এ সুযোগকে কাজে কাজে লাগিয়েই সোহেল রানা কোটিপতি বনে যান। প্রথমে ভাড়া বাড়িতে একটি তেল তৈরির মেশিন বসালেও পরে গরুর ঘানি থেকে তা নিয়ে যান উন্নত মেশিনে। নাম দেন রানা অয়েল মিল। সেখানকার উৎপাদিত গোলাপ ফুল মার্কা সরিষার তেল সরবরাহ করা হতো রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায়। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সংখ্যালঘু রবীন্দ্রনাথ সাহার জমি দখল করে সেখানে ডোবার ওপরে রানা প্লাজা নামে একটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ সাহা আদালতে মামলা করলেও ক্ষমতার দাপটে, রাজনৈতিক প্রভাবে সে মামলা বেশিদূর এগোয়নি। এতে একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ সাহা পাগল হয়ে যান। ২০০৬ সালে সাভার পৌরসভা থেকে ছয় তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে শুরু করেন রানা প্লাজার নির্মাণ কাজ। জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ করার পর ২০১০ সালে ভবনটির উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ।
রানা গ্রেফতার হওয়াতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ হয়তো কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই এক রানা তো গ্রেফতার হলো- কিন্তু ঘরে ঘরে আরো যে লক্ষ রানা রয়ে গেলো- তাদের কি হবে? স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে নাকি ২২ টি পরিবারের আধিপত্ত্য ছিলো। তাদের কথায় নিয়ন্ত্রিত হতো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি। সব কিছুতে ছিলো তাদের অবাধ বিচরণ। স্বাধীনতা লাভের সুবিধা হোয়েছে এই যে, সেখানে আজ লক্ষ লক্ষ এমন পরিবারের জন্ম দিয়েছে, জন্ম দিয়েছে লক্ষ লক্ষ রানার। আজ আমাদের দেশে যে কতক লোকের নব উত্থান ঘটেছে তার প্রায় প্রত্যেকটাই একেকটা রানার মুর্তপ্রতীক। রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক দলের সুবিধা গ্রহণ করে, প্রভাব খাটিয়ে অসহায় মানুষের ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে তারা স্বল্প সময়ে ধনী বনে গিয়েছেন। এখন তাদের পা আর মাটিতে পড়ে না। ক্ষমতার দাপটে প্রতিটি মানুষ তখন অন্ধ হয়ে যায়। মানবতা, মানবিকতা সবকিছু তারা হারিয়ে ফেলেছে। অন্যায়, অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা হস্তগত করার পরেও তাদের ক্ষূধার নিবৃত্তি ঘটেনা। খাই খাই তাদের চরিত্রে গেথে যায়। অন্যদের সাথে তারা প্রতিযোগিতায় নামে সম্পদ অর্জনের খেলায়। থানা পুলিস, প্রশাসন তারা কিনে ফেলে। সাভারের ঘটনায় আলোচিত এই রানা তার একটা নমুনা। এই রকম আরো লক্ষ লক্ষ রানা রাজনৈতিক নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করে তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। আর রাজনৈকিত নেতারাও তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য এই সব ভীতিকর লোকগুলোকে দুধ কলা খাইয়ে পুষে থাকেন। এই কথাগুলো আজ আর নতুন নয়। সবাই জানে। এটা এদেশের একটা কালচার হয়ে গিয়েছে। একজন তালুকদার মুরাদ জং, একজন সোহেল রানা তাদের একটা প্রতিনিধি মাত্র। কে তাদের বিচার করবে? যারা বিচার করবে তারা প্রতিজন নিজেরাই একটা করে তালুকদার মুরাদ জং, যারা বিচার করবে তারা প্রতিজন একটা করে সোহেল রানা। সাধারণ মানুষের হাতে কিছু করার নেই। কোর্ট-কাচারী তাদের নিয়ন্ত্রনে নাই। সাধারণ জনতা একটা কাজ ভালো পারে। আর তা হলো রাজপথে গনধোলাই। তাও পেটের দায়ে চুরি করা সাধারণ ছিচকে চোর, ভবঘুরে পকেটমার- বড়জোড় পাইপ কেটে বানানো পাইপগানধারী ডাকাতকে। এই সব রানাদের টিকিটি ছোঁয়ার সাধ্য সেই সাধারণ জনতার । তারা জনতাকে একধরণের ইমোশন জাগিয়ে, মানবতার কথা বলে, আদর্শের কথা বলে, ফটোশ্যুট দান খয়রাত করে, সুখ স্বপ্ন দেখিয়ে, বিটিভিতে উন্নয়নের জোয়ার দিয়ে ভাসিয়ে দিনের পর দিন জনতার সাথে প্রতারণা করে যায়। মানুষ তা জানে, বুঝে। কিন্তু প্রতিকারের কোন উপায় তাদের জানা নেই।
জানা যায়, রানা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের স্থানীয় যুগ্ম আহ্বায়ক। যদিও প্রধান মন্ত্রী নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে তালিকা হাতে নিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে রানা আওয়ামীলীগের কেউ নয়। আসলেই তারা কোন দলের নয়। তাদের কোন দল নেই। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। এরা সুবিধাবাদী দলের লোক। রানার পরিবারের দিকে তাকান। তার পরিবারের কোন সদস্য আওয়ামীলীগ করে না। তারা বিএনপি জামায়াত পন্থী। রানার চাচা আজিজ বিএনপির একজন সক্রিয় নেতা। তার শ্বশুর নুরুল ইসলামও পৌর বিএনপি নেতা। চাচা শ্বশুর পৌর কাউন্সিলর পৌর যুবদলের সভাপতি। রানার বাবা আবদুল খালেক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সাবেক স্থানীয় বিএনপি সংসদ সদস্য ডাক্তার দেওয়ান মো. সালাউদ্দিনের বাসায় গিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করেন। ছোট বোন সুমির উকিল বাবা পৌর বিএনপি নেতা। রানার ফুফাতো বোন শিবলীর স্বামী মো. সাইফুল ইসলাম সাভার পৌর ছাত্রদলের সভাপতি । কিন্তু রানা একাই কেন আওয়ামীলীগ করতো? এটাও খুব পরিষ্কার। রানারা জানে এদেশের ক্ষমতায় কেউ চিরদিন থাকবে না। ক্ষমতার পট-পরিবর্তনে তাদের যাতে কোন ব্যঘাত না ঘটে তাই একই পরিবারের লোক, একই মায়ের পেটের ভাই একদল করে তো আরেক ভাই আরেক দল করে। কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে জনতা মরে। তারা মারা পড়ে না। রানারা ঠিকই মুখে মুখে কথার মাধ্যমে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী করে রাখে। কিন্তু মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে ঠিকই নিমন্ত্রণ করে, কোলাকুলি করে। একনেতা আরেক নেতার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়। নববর্ষের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময় করে, কার্ড পাঠিয়ে শুভ কামনা করে। জনগণ ভাবে, আহ! নেতারা কত উদার!!
এই জনতা জানে কি এই রানারা জলাশয় ভরাট করে ছয়তলা ভবনের নকশা পাশ করিয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে- আর সেখানে ছয়তলার ছাদে আরো তিন চার তলা বাড়িয়ে আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন পূরণ করছেন? নেতারা এই ভবনের নীচে সাধারণত যান না। তারা বিশ্বখ্যাত লুই আইকানের ডিজাইন করা ভবনে অফিস করেন। কোন কারণে যদি কোনদিন কোন বাগে পড়ে যান তাদের নিরাপত্তার জন্য এসএসএফ আছে, র্যাব আছে, কোবরা আছে, হেলিকপ্টার আছে। আচ্ছা, ঐ নেতারা কি বলতে পারবেন, যদি ৭ বা সাড়ে ৭ মাত্রার একটা ভুমিকম্প হয় তাহলে এই দেশে, শুধুমাত্র এই রাজধানী শহরে কতগুলো ভবন ধসে পড়বে? যদি কম করে হলে ১০ হাজার ভবনও ধসে পড়ে তাহলে উদ্ধার কাজ করতে কত দিন লাগবে? একটা রানা ভবন ৫ দিনেও সরানো যায় নি। সেখানে গড়ে ২দিন করে লাগলেও ৫০ বছর লাগবে। কিন্তু তখন উদ্ধার কাজ করতে খোলা রাস্তা পাওয়া যাবে কোথায়? হতাহতদের উদ্ধার করবে কে? হাসপাতালগুলো অক্ষত থাকবে তো? যে রানারা এই রানাদের বিচার করবে- এটা তাদের একটা আইওয়াশ মাত্র। যদি সত্যি বিচার করতে হয় তাহলে নিজেদের বিচার করতে হবে আগে। ঘর থেকে ধরে আনতে হবে লক্ষ লক্ষ রানাদের। সেই হিম্মত কি এই প্রতিষ্ঠিত রানাদের আছে?
বিষয়: বিবিধ
১১৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন