মাদ্রাসা শিক্ষাক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র- প্রথম পর্ব

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:২৯:৫৮ বিকাল

মোহাম্মদ রিয়াদুল হাসান

মহান আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে হেদায়াহ ও সত্যদীন এসলাম দিয়ে প্রেরণ কোরেছিলেন সারা দুনিয়ার সকল জীবন ব্যবস্থার উপর এসলামকে বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য (সূরা তওবাহ ৩৩, সূরা ফাতাহ ২৮, সূরা সফ ৯)। মহানবী ও তাঁর আসহাবরা কঠিন সংগ্রাম কোরে অর্ধ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রকৃত এসলাম প্রতিষ্ঠা কোরেছিলেন। আল্লাহ কোর’আনে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ কোরেছেন যে, এই জাতি যদি তাদের মূল কাজ অর্থাৎ দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছেড়ে দেয় তাহোলে আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন এবং তাদের উপর অন্য জাতি চাপিয়ে দিবেন (সূরা তওবা ৩৮-৩৯)। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রসুলাল্লাহর চোলে যাওয়ার ৬০/৭০ বছর পরেই এই জাতি পৃথিবীময় ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দিল। তখনও এই শেষ জীবন ব্যবস্থা তাদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে কার্যকরী ছিল। কিন্তু দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে এবং বিকৃত সুফী মতবাদের প্রভাবে এই জাতি ঐক্যহীন একটি স্থবির প্রাণহীন জনসংখ্যায় পরিণত হলো যেটা শত্র“র আক্রমণের মুখে সহজেই ভেঙ্গে পড়লো।

ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলি সামরিক শক্তিবলে পৃথিবীর প্রায় সবক’টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ অধিকার করার পর এরা যাতে আর ভবিষ্যতে কোনদিন তাদের ঐ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলো। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা, কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক বিষয় যে এর মাধ্যমে মানুষকে যা ইচ্ছা তাই করা যায়; চরিত্রবান মানুষও তৈরী করা যায় আবার দুশ্চরিত্র মানুষেও পরিণত করা যায়; কী শিক্ষা দেয়া হোচ্ছে তারই ওপর নির্ভর করে সে কেমন মানুষ হবে। তাই দখলকারী শক্তিগুলি তাদের অধিকৃত মুসলিম দেশগুলিতে মাদ্রাসা স্থাপন কোরল। উদ্দেশ্য- পদানত মুসলিম জাতিটাকে এমন একটা এসলাম শিক্ষা দেয়া যাতে তাদের চরিত্র প্রকৃত পক্ষেই একটা পরাধীন দাস জাতির চরিত্রে পরিণত হয়, তারা কোনদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তাও না করে। খ্রীস্টানদের মধ্যে Orientalist (প্রাচ্যবিদ) বোলে একটা শিক্ষিত শ্রেণী ছিলো ও আছে যারা এসলামসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্ম, কৃষ্টি, ইতিহাস ইত্যাদির ওপর গবেষণা করে থাকেন। এদের সাহায্য নিয়ে খ্রীস্টানরা মাদ্রাসায় শিক্ষা দেবার জন্য তাদের মন মত Syllabus (কি শিখানো হবে তার তালিকা) ও Curricullum (কি প্রক্রিয়ায় শেখানো হবে) তৈরী কোরে তা শিক্ষা দেবার জন্য তাদের অধিকৃত সমস্ত মুসলিম দেশগুলিতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরল। আমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ কোর’আনে সুরা তওবার ৩৮-৩৯নং আয়াতে দেয়া প্রতিশ্র“তি মোতাবেক আমাদের ব্রিটিশদের গোলামে পরিণত কোরে দিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশের ভাইসরয় (Viceroy) বা বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংকস ১৭৮০ সনে তদানিন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরে শেষ নবীর মাধ্যমে আল্লাহর দেওয়া দীনুল এসলাম নয়, তাদের প্রাচ্যবিদদের (Orientalist) দ্বারা তৈরী করা একটি বিকৃত এসলাম শিক্ষা দিতে আরম্ভ কোরলেন। খ্রীস্টান প্রাচ্যবিদদের দ্বারা তৈরী করা এই এসলামে প্রথমে কালেমার অর্থ বিকৃতি করা হোল; লা এলাহা এল্লাল্লাহ-র প্রকৃত অর্থাত ‘আল্লাহ ছাড়া আদেশদাতা নেই’ কে বদলিয়ে করা হোল আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই, যেটাকে আরবীতে ভাষান্তর কোরলে হয় লা মা’বুদ এল্লাল্লাহ। এটা করা হোল এই জন্য যে, আল্লাহকে একমাত্র আদেশদাতা হিসাবে নিলে এ জাতিতো ব্রিটিশদের আদেশ মানবে না, মুসলিম থাকতে হোলে আল্লাহর আদেশ মানতে হবে। আর কালেমার মধ্যে এলাহ শব্দের অর্থ বদলিয়ে যদি উপাস্য বা মা’বুদ শেখানো যায় তবে এ জাতির লোকজন ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর উপাসনা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি নানা উপাসনা কোরতে থাকবে এবং জাতীয় জীবনে ব্রিটিশ প্রভুদের আদেশ পালন কোরতে থাকবে; তাদের অধিকার ও শাসন দৃঢ় ও স্থায়ী হবে। এই উদ্দেশ্যে ঐ বিকৃত এসলামে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা, আধ্যাত্মিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হোল। কারণ এরা ঐ এবাদত, উপাসনা নিয়ে যত বেশী ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ হবে।

(খ) ব্রিটিশ শাসকরা এই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ((Syllabus) মধ্যে প্রধানতঃ বিতর্কিত বিষয়গুলির প্রাধান্য দিলো, যেগুলো অতি আগে থেকেই বিদ্যমান ছিলো এমামদের এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে, কোর’আনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে। এগুলোকে প্রাধান্য ও প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় বিষয় বোলে (Syllabus) এর অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো এই যে এই মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা যেন ঐগুলি নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তর্কাতর্কি, এমনকি মারামারি কোরতে থাকে, শাসকদের দিকে তাদের দৃষ্টি দেবার সময় না থাকে।

(গ) খ্রীস্টানদের প্রাচ্যবিদদের তৈরী ঐ এসলামে কোর’আনের গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে দিয়ে সেখানে হাদীসের প্রবল প্রাধান্য দেয়া হলো। কারণ এই যে কোর’আন চৌদ্দশ’ বছর আগে যা ছিলো আজও ঠিক তাই-ই আছে, এর একটা শব্দ নয় একটা অক্ষরও কেউ বদলাতে বা বাদ দিতে পারে নাই, কারণ এর রক্ষা ব্যবস্থা আল্লাহ তার নিজের হাতে রেখেছেন (কোর’আন- সুরা হেজর ৯) কিন্তু হাদীস তা নয়। বহু হাদীস মানুষ তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তৈরী কোরেছে, খেলাফতের পরে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর উমাইয়া, আব্বাসীয়া, ফাতেমী ইত্যাদি খেলাফতের নামে আসলে রাজতন্ত্রের রাজারা তাদের যার যার সিংহাসন রক্ষার জন্য অজস্র মিথ্যা হাদীস তৈরী কোরে আল্লাহর রসুলের নামে চালিয়েছে। সুন্নীরা তাদের মতবাদের পক্ষে, শিয়ারা তাদের মতবাদের পক্ষে মিথ্যা হাদীস তৈরী কোরে নিয়েছে যার যার মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য। আরও বিভিন্নভাবে হাদীস বিকৃত হোয়েছে। কোর’আনের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে হাদীসের ওপর এত জোর এবং গুরুত্ব দেয়ার উদ্দেশ্য হলো বিতর্ক, বিভেদ শুধু জিইয়ে রাখা নয় ওটাকে শক্তিশালী করা।

(ঘ) তারপর তারা যে কাজটি কোরল তা সাংঘাতিক এবং যার ফল সুদূর প্রসারী। তারা তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তাদের তৈরী করা বিকৃত এসলামে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কোরল তাতে মাদ্রাসার শিক্ষা শেষ কোরে বেরিয়ে এসে তাদের রুজি-রোজগার কোরে খেয়ে বেঁচে থাকার কোন শিক্ষা দেয়া হোল না। অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থ-বিজ্ঞান, জীব-বিদ্যা ইত্যাদির কোন কিছুই ঐ সব মাদ্রাসার সিলেবাসে ((Syllabus) রাখা হোল না। খ্রীস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে কোরল যে, তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যেন ওখান থেকে বেরিয়ে যেয়ে তাদের শেখানো বিকৃত এসলামটাকে বিক্রি কোরে পয়সা উপার্জন করা ছাড়া আর কোন পথে উপার্জন কোরতে না পারে; কারণ ঐ মানুষগুলির মধ্য থেকে ব্যতিক্রম হিসাবে যদি কেউ বুঝতে পারে যে তাদের শিক্ষা দেয়া ঐ এসলামটা প্রকৃতপক্ষে নবীর মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া সত্য এসলাম নয়, ওটা বিকৃত, তাহোলেও যেন সে বাধ্য হয় ওটাকেই বিক্রি কোরে উপার্জন কোরতে, কারণ তাকে এমন আর কিছুই শিক্ষা দেয়া হয়নি যে কাজ কোরে সে টাকা পয়সা উপার্জন কোরে খেতে পারে। মুর্খ জনসাধারণ ধর্ম সম্বন্ধে জানার জন্য, ফতওয়া নেবার জন্য স্বভাবতই এদের কাছেই যেতে বাধ্য এবং তারা অবশ্যই ব্রিটিশ-খ্রীস্টানদের তৈরী করা ঐ প্রাণহীন, আত্মাহীন, বিতর্ক-সর্বস্ব এসলামটাই তাদের শিক্ষা দেবে ; এবং এই ভাবেই ঐ বিকৃত এসলামই সর্বত্র গৃহিত হবে, চালু হবে। খ্রীস্টানরা তাদের অধিকৃত সমস্ত মুসলিম দেশগুলিতে এই নীতিই কার্য্যকরি কোরেছে এবং সর্বত্র তারা একশ’ ভাগ (১০০%) সফল হোয়েছে। ১৭৮০ সনে কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরে খ্রীস্টান শাসকরা এর পরিচালনার ভার অর্পণ কোরলো এ দেশীয় একজন মোল্লার হাতে যিনি খ্রীস্টানদের বেঁধে দেওয়া শিক্ষাক্রম (Curricullum) অনুযায়ী মুসলমান ছাত্রদেরকে তাদেরই বেঁধে দেওয়া পাঠ্যসূচি (Syllabus) অর্থাৎ এসলাম শিক্ষা দিবেন। কিন্তু এ মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ তারা সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের হাতে রাখলো। তারা অর্ধশতাব্দির অধিক সময় এ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান চালু রাখলো। অর্ধশতাব্দীর পর্যবেক্ষণের পর তারা যখন দেখলো যে এ থেকে তাদের আশানুরূপ ফল আসছে না, তখন মুসলিম বোলে পরিচিত এই জাতিটাকে নিজেদের তৈরী বিকৃত এসলামের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য পঙ্গু, অথর্ব কোরে নিজেদের শাসন দীর্ঘদিনের জন্য পাকাপোখ্ত করার এই জঘন্য পরিকল্পনা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ খ্রীস্টান শাসকরা তাদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (Principal) পদটিও নিজেদের হাতে নিয়ে নিলো। প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হোলেন ডঃ ¯স্প্রি্ংগার (Springer)। তারপর একাধিক্রমে ২৬ জন খ্রীস্টান ৭৬ বৎসর (১৮৫০-১৯২৭) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে আসীন থেকে এই মুসলিম জাতিকে এসলাম শিক্ষা দিলেন।

...(চলবে)

সূত্র

বিষয়: বিবিধ

১১১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File