পহেলা বৈশাখের মোড়কে রমরমা বাণিজ্য
লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ১৪ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:২৯:১০ বিকাল
আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২০ বাংলা সনের প্রথম দিন। এই দিনটিকে বরণ করার জন্য সর্বত্র চলছে নানা আয়োজন। যদিও এসব আয়োজনের অধিকাংশই ঐতিহাসিকভাবে পহেলা বৈশাখের বা বাংলা সনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণী এসব আয়োজনকে ‘আবহমান বাংলার ঐতিহ্য’, ‘বাঙালীর প্রাণের উৎসব’ ইত্যাদি বলে চালিয়ে দিচ্ছে এবং আমরাও এই জনপদের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় তাদের এসব আয়োজনকে স্বতঃস্ফুর্তভাবেই গ্রহণ করে নিচ্ছি।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় মোঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশে তৎকালীন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি হিজরী সন ও সৌর সনের সমন্বয়ে বংলা সনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। ভারত উপমহাদেশের আবহাওয়া ও কৃষিকাজের সাথে সমন্বয় রেখেই রেখেই বাংলা সন প্রণয়ন করা হয় যাতে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় সহজ হয়। সে কারণে বাংলা সনকে প্রাথমিক অবস্থায় ফসলী সন হিসাবেও ধরা হতো।
সম্রাট আকবরের শাসন আমলে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে প্রজাদেরকে খাজনা, মাশুল ইত্যাদি পরিশোধ করতে হতো এবং পরদিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকগণ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যমে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। অপরদিকে ব্যবসায়িক ও জনসাধারণের মধ্যে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় হালখাতার মাধ্যমে। হালখাতা খোলার পর ব্যবসায়িকগণও ভোক্তাদেরকে মিষ্টিমুখ করাতো। আর এইদিন বিকালে গ্রামগঞ্জে আয়োজন হত বৈশাখী মেলার। এটুকুর মধ্যে মূলত পহেলা বৈশাখ ছিল সীমাবদ্ধ।
আধুনিক যে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, তার ভিত্তি রচিত হয় ১৯১৭ সালে। সে সময় ভারত উপমহাদেশ ছিল বৃটিশদের গোলাম। বিলেতি প্রভূদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পহেলা বৈশাখে হোমকীর্তন ও পূজা-অর্চনা করা হয়। ভারতীয় মুসলিমরা মানসিকভাবে ব্রিটিশ বিরোধী হওয়ায় পহেলা বৈশাখের মাধ্যমে ব্রিটিশ বন্দনা ও প্রার্থনায় অংশ নেয় নি। আমাদের দেশে ১৯৬৭ সালের আগে বর্তমানের মত ঘটা করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তানী শাকগোষ্ঠির অন্যায়, নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ রমনার বটমূলে নতুন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ভাষা ছিল প্রতিবাদের। কিন্তু স্বাধীনতার পর কয়েক বছর পর থেকে ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। যে সকল মাত্রা না এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত, না বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূলত এসকল মাত্রা যোগ হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের মানসিক দাসত্ব ও স্বদেশী বেনীয়াদের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। পহেলা বৈশাখ এখন সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক উভয় আগ্রাসনের হাতিয়ার। বৈশাখী জামা-কাপড় ও ফ্যাশনের কথা বাদ দিলেও কেবল মাত্র পান্তাভাত ও ইলিশের পেছনে যে বিপুল অর্থ অপচয় হয়ে থাকে তা কি এদেশের নিত্য-অনাহারী মানুষের প্রতি এক ধরণের উপহাস নয়?
১৯৮৯ সাল থেকে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে আরও একটি মাত্রা যোগ হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামকরণে। বিভিন্ন মিডিয়ায় এই শোভাযাত্রাকে আবহমান গ্রামবাংলার গ্রামীণ জীবনের রূপকে ফুটিয়ে তোলার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু যারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ না করলেও অন্তত পত্রপত্রিকায় এই ‘মঙ্গল’ শোভাযাত্রার ছবি ও টিভি চ্যানেল ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন আশা করি তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় যে সকল মুর্তি, মুখোস ইত্যাদি শোভা পায় সেগুলোর সাথে গ্রাম বাংলার গ্রামীণ জীবনের কোন মিল নেই। বরং একে রথযাত্রার দৃশ্যের সাথে মেলাতে কারো কষ্ট হবে না। যদিও এই শোভাযাত্রার নাম দেয়া হয়েছে ‘মঙ্গল’ শোভাযাত্রা এর উদ্দেশ্য জাতির নতুন বছরটি যে মঙ্গলময় হয়। কিন্তু এই মঙ্গল কামনা তারা কার কাছে করছেন এটিই এখন প্রশ্নবোধক?
ইহুদী নিয়ন্ত্রিত বিশ্বখ্যাত কোকাকোলা কোম্পানীর পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্ট ধর্মে ‘সান্তাক্লজ’ নামক এক নতুন আইকন সৃষ্টি করা হয়েছে যদিও বাইবেলে এই সান্তাক্রজের কোন অস্তিত্ব নেই। তথাপি এই চরিত্রের অবতারণা করে তারা কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিতে সমর্থ হচ্ছে অথচ এই ইহুদীরাই যীশুকে ক্রুশে ঝুলিয়েছে বলে গৌরব করে থাকে। অনুরূপভাবে পহেলা বৈশাখকেও কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলি বাঙালির প্রাণের উৎসবের মোড়ক লাগিয়ে একে ক্রমান্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নিছক ব্যবসায়িক সফলতার জন্য। তাই পহেলা বৈশাখকে পুঁজি করে কেউ যেন সাধারণ মানুষের মাথায় লবন রেখে বরই খেতে না পারে সে বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন