বাঁচতে হলে প্রয়োজন সুদৃঢ় ঐক্য

লিখেছেন লিখেছেন ই জিনিয়াস ০৪ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:১২:০৭ রাত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ও বিখ্যাত রম্য লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর একটি রঙ্গ লেখার কথা মনে আসে। গল্পের একটা অংশে লেখক শয়তানের সাথে সাক্ষাৎলাভ করেন। সাক্ষাতে তার সাথে শয়তানের কিছু কথোপকথন হয়। লেখকের ভাষায় শয়তানকে জিজ্ঞেস করা হয় যে যেহেতু সে শয়তান- সেহেতু সে তার শয়তানী শক্তির মাধ্যমে বিদু্যুতের লোডশেডিং না ঘটিয়ে একে বারেই বিদ্যুৎকে বন্ধ করে দেয় না কেন। আবার মাঝে মাঝে পানির সাপ্লাই না দিয়ে একেবারেই পানি আসা বন্ধ করে দেয় না কেন। জবাবে শয়তান তার শয়তানী হাসি হেসে জানায় যে, যদি একেবারেই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে মানুষ ধীরে ধীরে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখে যাবে। উদাহরণ হিসাবে অন্ধকারে চলাচল করা প্রাণীদের কথা বলা হয়। ঠিক তেমনি করে পানি একেবারে বন্ধ করে দিলে মানুষ পানি ছাড়াও আস্তে আস্তে নিজেদের মানিয়ে নেবে। গ্যাস সঞ্চালন একেবারে বন্ধ করে দিলে মানুস গ্যাস ছাড়াই চলতে শিখে যাবে। শয়তানের মূল কথা হলো তার গৃহিত পদ্ধতির মাধ্যমে কোন একটা অবস্থায়ই মানুষকে স্থিতি লাভ করতে দেবে না। কখনো লোডশেডিং দেবে আবার কখনো বিদ্যুৎ দেবে। এই অবস্থায় মানুষ কোন অবস্থায়ই শান্তি পাবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা দেখে হুবহু তাই মনে হয়। হাজারো মতবাদের দলে পূর্ণ এই দেশে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। এই হরতাল, আবার এই গাড়ি চলে। এই রাজপথে মিছিল-মিটিং আবার এই খালি, এই এখানে গোলাগুলি করে খুনাখুনি হলো তো আবার কিছুক্ষণ পর এই জায়গা দেখলে কারো মনে হবে না যে এখানে মাত্র কিছুক্ষণ আগে মানুষ মারা গিয়েছে। স্থায়ীভাবে হরতাল দিয়ে, কারখানা বসিয়ে রেখে, সকল উৎপাদন বন্ধ করে দেশকে একেবারে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে না। যদি তা করা হতো তাহলে এর একটা সর্বশেষ পরিণতির মাধ্যমে কোন একটা সমাধান বেরিয়ে আসতো। স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও এই অবস্থার পরিবর্তন নেই। মুক্তির কোন উপায় নেই। বরং দিন দিন এই অস্থিরতা বেড়েই চলছে। বিভেদ বিভাজন ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ঘরে ঘরে আজ শত্র“তা। একই পরিবারে বসবাস অথচ তাদের চিন্তা চেতনা আলাদা। কেউ একদল করে তো কেউ অন্যদল করে। তবে যে যাই করুক- সবাই একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পারছে যে কয়েকদিন আগে বলা হচ্ছিলো দেশে গৃহযুদ্ধ আসন্ন তা আজ প্রায় শুরু হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসছে সারা দেশের নানা প্রান্তে সংঘাত আর সংঘর্ষের। হয় নিজ দলের কোন্দলে মরছে না হয় বিরোধী পক্ষের হামলায় মরছে। মানুষ মারা যাচ্ছে অকাতরে। উত্তেজিত জনতা প্রশাসনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা চালাচ্ছে। আবার পুলিশও নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারছে। কোন দল দাবী করছে দেশে গণহত্যা চলছে, আবার কোন দল দাবী করছে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে দেশের মানুষ শান্তিতে নেই। একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, চালক অর্থাৎ আপামর জনতা কেউই শান্তিতে নেই। এ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। বুদ্ধিজীবি, চিন্তাবিদ, সমাজ সচেতন, সুশীল সমাজ- সবাই যার যার আঙ্গিকে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ফর্মূলা পেশ করছেন । কেউ তা মানছেন আবার কেউ তা প্রত্যাখ্যান করছেন। টিভিতে, টকশোতে, সংবাদপত্রে, ব্লগে- ইন্টারনেটে, রেডিওতে, রাজপথে, মঞ্চে, গোলটেবিলে, চায়ের দোকানে, আড্ডায় উপস্থাপন করছেন সমস্যা ও মুক্তির উপায়। কিন্তু ফলাফল শুন্য। জাতি শতধা বিভক্ত। কোন উপায়েই মুক্তির কোন পথ দেখা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গের শেষ সীমা পর্যন্ত অন্ধকার। কেউ দাবী করছেন দেশ চলবে একাত্তরের চেতনায়, আবার কেউ বলছেন দেশ চলবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। কেউ বলছেন দেশ চলবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে, কেউ বলছেন দেশ চলবে ধর্মের আলোকে। কেউ বলছেন দেশ চলবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে, কেউ বলছে দেশ চলবে গনতান্ত্রিক নিয়মে। এতসব মতবাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমাদের দেশের সংবিধানে যোগ করা হয়েছে পরস্পর সার্বভৌমত্ব বিরোধী মূলনীতিসমূহ। তাই একেকবার একেক সরকার এসে সংবিধানে কাচি চালায়। কোন ব্যবস্থাই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে এইসব মতবাদে বিশ্বাসী জনগণ বিভক্ত হয়, মারামারি করে। একদল আরেকদলকে সহ্য করতে পারে না। শয়তানের এই দুষ্টচক্রে আষ্টেপৃষ্টে আটকে পড়েছে জনগণ।

এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য কেউ কেউ দাবী করছেন যদি বর্তমান বিবাদমান দুইটি দলের চক্র থেকে বেরিয়ে কোন তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটতো তাহলে হয়তো এই জাতির মুক্তি মিলবে। আবার কেউ মনে করছেন সামরিক বাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু অতীত ইতিহাস তা বলে না। ২০০৭ সালে সংঘটি ওয়ান ইলেভেন বলে খ্যাত ঘটনার আগে বিবাদমান দুইটি দলের লগি বৈঠা এবং কাস্তের লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে রাজনৈতিক নেতাদের জেলে ঢুকিয়ে, মানুষের মনে স্বস্তির আশ্বাস জাগিয়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় তা মাত্র কিছুদিন যেতে না যেতেই জন সমর্থন হারিয়ে শুন্যের কোঠায় নেমে আসে। যে ফখরুদ্দিন জনমানসে নায়ক হয়ে আবির্ভুত হন সেই একই ব্যক্তি ভিলেনের তকমা পরিধান করে মঞ্চ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। নিয়তির কি পরিহাস তিনি আজ দেশেই থাকতে পারছেন না। অতীত ইতিহাস বলে সেনাবাহিনীও কোনকালে শাসন কাজ সঠিকভাবে চালাতে পারে নি। সুতরাং তারাও আর রাজনীতিতে আসতে ইচ্ছুক নয় বলেই মনে হয়।

অতি সাম্প্রতিক দেশের প্রখ্যাত রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক, কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারকে আহবায়ক করে ২০০১ জন বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের অঙ্গীকার নিয়ে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস’ বা নাগরিক অধিকার রক্ষা জাতীয় কমিটি নামে একটি নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে । ফেব্র“য়ারীর শুরুতে শাহবাগ আন্দোলন মানুষের চেতনায় বিশাল নাড়া দিয়ে এক বিশাল আশা জাগায়। সেই আবেগের নদীতেও আজ পানি নেই। নিভু নিভু করে জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটের ভেতর গণজাগরণের চেতনাকে। সেখানে আজ হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এই জাগরণ আমাদের যা দিয়ে গিয়েছে তাতে শুধু বিভেদ বেড়েছেই, কিছু অংশও কমেনি। জাগিয়ে দিয়ে গেছে বিভেদের আগুন। যার লেলিহান শিখায় সারাদেশ আজ অগ্নিগর্ভ। দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সংবিধান প্রণেতা ও বিশেষজ্ঞ জনাব ডক্টর কামাল হোসেনও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন অনেক। ফলাফল তথৈবচ। ইদানীং যোগ হয়েছে হেফাজতে ইসলামের নামে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আল্লামা শফির আন্দোলন। কিন্তু এটিও কোন সমাধান নয়, বরং এতে যোগ হয়েছে নতুন আরেক উপসর্গ। আগামী ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামীর লংমার্চকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন উত্তেজনা, নতুন সংঘাতের সম্ভাবনা।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল মনে করছে দেশ থেকে দেশবিরোধী, বাঙ্গালী চেতনা বিরোধী, একাত্তরের চেতনা পরিপন্থি শত্র“দের নির্মূল করার মাধ্যমে নেমে আসবে চিরশান্তি, গঠিত হবে সোনার বাংলা। কিন্তু তারা কি বিবেচনা করে দেখেছে একাত্তরের চেতনা বিরোধীদের সংখ্যাটা কি পরিমাণ? যাদেরকে রাজাকার আলবদর বলা হয় তাদের ছানা পোনার সংখ্যাও কম নয়। তারা দেশের বিরাট একটা অংশের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যাবসা বাণিজ্য, কলকারখানা, ব্যাংক বীমার একটা বিরাট অংশের নিয়ন্ত্রক তারা। তাদের উৎখাত মানে দেশকে পঙ্গু করে দেয়া। সুতরাং এই বিশাল অংশকে নিধণ করা মানে বাকীরাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো। সম্ভাবনা পুরো জাতির ধ্বসে পড়া।

কথা হলো এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি? এই ভিন্নমত, অনৈক্য থেকে বেরিয়ে এসে সুদৃঢ় ঐক্যের মাধ্যমে জাতিকে শক্তিশালী করার কোন পথ আছে কি? একটা মহাসত্য হচ্ছে এই যে আধার যতই গভীর হোক তার পেছনে এক উজ্জ্বল আলো থাকে। রাত যতই গভীর অন্ধ%

বিষয়: বিবিধ

৯৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File