এই কি সেই আওয়ামী লীগ?

লিখেছেন লিখেছেন জলি্ ১৯ মার্চ, ২০১৩, ১২:০০:৫৬ দুপুর



http://www.bdtomorrow.net/columndetail/detail/85/1857

সত্তরোর্ধ্ব জীবনের প্রদোষ বেলায় আমার মতো সবারই পেছন ফিরে তাকানোর অভিলাষ জšে§। জীবনের কোন ক্ষেত্রেই আমি বিশিষ্ট নই। তবু জীবনে যা কিছুতেই জড়িয়েছি, যে বিশ্বাসকে পোষণ করেছি বা যে ধারণাকেই লালন করেছি, তাকে বিশিষ্ট ও মহৎ ভেবেই তা করেছি। তরুণ বয়সে সবারই মাথায় কবি হওয়ার, বিপ্লবী হওয়ার বা নিদেনপক্ষে পছন্দের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষালম্বন করে তার জন্য হƒদয় উজাড় করে ভালোবাসা দেয়ার অভিপ্সা জšে§। কিশোর বয়স থেকেই ভাসানী-মুজিবের মিটিংয়ে যেতাম, তš§য় হয়ে তাদের বক্তৃতা শুনতাম।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের প্রশ্নে শেখ মুজিবের ‘স্ট্রেইট টকিং’ আমার বেশি ভালো লাগাত। বুঁদ হয়ে শুনতাম তার স্বাধীনতার প্রাথমিক সংস্করণ ছয় দফার কথা, তার শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ের কথা। ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে সূচিত এগারো দফা, যাতে তৎকালীন প্রবণতা সমাজতন্ত্রেরও গন্ধ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমরা যারা পাকিস্তান সৃষ্টির বঞ্চিত ও প্রতারিত অংশ ছিলাম, শেখ মুজিবের ওপর শতভাগ নির্ভরতা নিয়ে যার যে অবস্থান সেখান থেকে বিনাবাক্য ব্যয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিলাম।

সেই ঘোর দুঃসময়েও দেখেছি নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি হয়েও কেউ কেউ পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বিচিত্র সব পন্থায় সহযোগিতা করেছিল।

সমস্যা হল যখন ওই একই শেখ মুজিবকে স্বাধীন এদেশে শাসনের দণ্ড হাতে দেখলাম। যত দেখলামÑ অতীতের সব আবেগ-উচ্ছ্বাস, শেখ মুজিবকে সবকিছুতে নির্ভুল মনে করার প্রবণতা এবং আমাদের জন্য তার সোনার বাংলার প্রতিশ্র“তি পূরণ হওয়ার আশাকে নিছক একটি দুঃস্বপ্নের ঘোর বলে মনে হতে লাগল। বুঝলাম যে আমরা, এদেশের মানুষরা আসলেই আবেগপ্রবণ জাতি। শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ একটি ঐতিহাসিক এবং তার জীবনে শেষবারের মতো সুন্দর বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। অতঃপর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সমস্যাসংকুল দেশে প্রতিকূল বাস্তবতার ফাঁদে আটকে পড়া শেখ মুজিবের আর কোন উš§াদনা সৃষ্টি করার মতো বক্তৃতা শোনা যায়নি। তবু আমরা যারা স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছিলাম বা সমর্থন দিয়েছিলাম, তাদের জন্য শেখ মুজিবের কোন বিকল্প ভাবা ছিল পাপতুল্যÑ এমনই আসন তিনি গড়ে তুলেছিলেন আমাদের হƒদয়ের কন্দরে। এখন অতীতের পাতা ওল্টালে মনে হয়, একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটানো এবং তার সার্বিক সুরক্ষা বিধান এক জিনিস নয়।

গণতন্ত্রপাগল এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা যখন এদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করল এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থার জোয়ালে ঘাড় পেতে দিল, তখনও শেখ মুজিব এদেশের অবিসংবাদিত নেতা, যার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস কারও নেই। কিন্তু যারা তারই নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল, চৈতন্যলোপ সেই মানুষরা একটি নিদারুণ ঘোরে দেখেও দেখতে পেল না একটি শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অপমৃত্যু।

আমার মনে আছে, তখনও শেখ মুজিবই আমার সব প্রেরণার উৎস। যদিও দেখছি ও শুনছি, দেশে শেখ মুজিব সপরিবারে ঘাতকের অস্ত্রে নিশ্চিহ্ন, শুনছি যে, দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে এবং কায়েমি স্বার্থবাদীরা সেই পাকিস্তান আমলের মতোই যার যার অনুকূলে পক্ষাবলম্বন করছে, আমার কাছে তখনও এদেশের প্রথম ও শেষ ত্রাতা শেখ মুজিব, যিনি তখনও আমার বিশ্বাসে স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিভক্ত রাখার প্রতীক। আমি সামান্য লোক হলেও আমার শক্তির মধ্যে এই নেতার উত্তরাধিকারকে সাধ্যমতো তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি এবং মহীরুহস্বরূপ তার দল আওয়ামী লীগকে নীরব সমর্থন জানিয়েছি।

বাংলাদেশে সেনা শাসনের ধারা প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে অন্তরালে চলে যায়। শেখ মুজিবের রেখে যাওয়া আওয়ামী লীগ হয় বহুধাবিভক্ত। এমনও সংশয় আবর্তিত হতে থাকে যে, দলটি হয়তো আর একখণ্ডে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে না এবং এককালে শক্তিশালী মুসলিম লীগের মতো সময়ে তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে।

সেই প্রক্রিয়া খানিকটা শুরুও হয়েছিল।

শেখ মুজিবের হত্যার পর তার উত্তরাধিকারকে প্রকারান্তরে অস্তিত্ব সংকটে দেখেছি। স্বভাবতই মুজিব-উত্তর বাংলাদেশে তখন নতুন নক্ষত্রশোভিত রাজনৈতিক আকাশ। কালেভদ্রে তখন মুজিবের উল্লেখ পরিলক্ষিত হয়েছে কোন গুরুত্বহীন সংবাদ মাধ্যমে, তার কোন অজ্ঞাত ভক্তের প্রচেষ্টায়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দলে এবং দলের বাইরে তখনও তার অসংখ্য ভক্ত হয়তো নীরবে অশ্র“পাত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তার যথাযথ মর্যাদার স্থানটি দীর্ঘদিন অরক্ষিতই ছিল। সে সময় আমিই প্রথম ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ‘ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ : উবধষরহম রিঃয ঃযব চযবহড়সবহড়হ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম এবং আমার সামরিক ফ্র্যাটারনিটিতে (ঋৎধঃবৎহরঃু) কিছুটা সমালোচিতও হয়েছিলাম।

আমি কি ওই নিবন্ধ লিখে ভুল করেছিলাম? অবশ্যই নয়। তবে নির্বোধের মতো স্রোতের বিপরীতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তেমনটা করাই আমার স্বভাব। আওয়ামী লীগ যখন ২০০১ সালের নির্বাচনে হারার পর শুধু গণমাধ্যমে নয় বৈঠকি আলোচনায়ও অস্পৃশবৎÑ আমার মনে হয়েছিল, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলের এমনটা হওয়া প্রাপ্য নয়। সেজন্যই এক-এগারোর পর থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় পর্যন্ত শেখ মুজিবের দুর্দশাগ্রস্ত আওয়ামী লীগকে ওই একই পত্রিকায় (উধরষু ঝঃধৎ) এবং প্রায় সব বাংলা সংবাদপত্রে অনুকূল নিবন্ধ লিখে দলের দুর্দশা লাঘবে নৈতিক সমর্থন দিয়েছি। যদিও ওই সব নৈতিক সমর্থন দিতে অনেক সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার মতান্তর হয়েছে এবং এখনও সেসব মতপার্থক্য বহাল রয়েছে।

কেউ হয়তো ভাববেন, আজ কেন এসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা? তা এ কথাটিই স্পষ্ট করতে যে, সব অঙ্গনে যার যা প্রাপ্য, তাকে সেটা দিতেই হয়। যদিওবা সময়ে তা অপাত্রে প্রদত্ত হয়েছে বলে মনে হবে। আজ শেখ হাসিনার যে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো দেশ শাসন করছেÑ তার ঔদ্ধত্য, আচরণ, কর্তৃত্ববাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রতাও পরিলক্ষিত তার পরিবার ও দলতন্ত্রে এবং অপদার্থতায়।

কিন্তু কী করে অস্বীকার করি যে, এই দলটিই অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। সেই ত্যাগ-তিতিক্ষার মূল্য দিতে গিয়ে কখনও যদি তা মোহভঙ্গের ফলে তিক্ততায় পর্যবসিত হয়, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেজন্য কাউকে দোষারোপ করার অবকাশ নেই। কতই না ভালো হতো যদি সেই মোহভঙ্গের পর্বটাই না ঘটত।যুগাšত্মর

এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

উৎসঃ যুগান্তর

বিষয়: বিবিধ

৯৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File