একটি নতুন ওয়াকফ আন্দোলন প্রয়োজন
লিখেছেন লিখেছেন মিজবাহ ২১ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:৫৩:২৯ রাত
আমাদের নতুন এক ওয়াকফ আন্দোলন প্রয়োজন। ওয়াকফের যে গুরুত্ব, তা আজকের দিনে আমাদের সমাজে হারিয়ে গেছে। সেই গুরুত্বকে আমাদের পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
ওয়াকফের নীতি হলো, যেকোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তির একটি অংশ আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়ে দিতে পারে এবং বলে দিতে পারে সে সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে, কী কাজে ব্যবহার হবে। ওয়াকফ সব সময় ভালো কাজেই ব্যবহার করা যায়, মন্দ কাজে ব্যবহার করা যায় না। ওয়াকফ যিনি করেন, তিনিই ওয়াকফ কিভাবে চলবে তার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তার ব্যবস্থাপনা কৌশল বলে দেন। কমিটির মাধ্যমে বা কিভাবে ওয়াকফ পরিচালিত হবে, এ নির্দেশ তিনি দিতে পারেন।
ইসলামের শুরুতেই ওয়াকফ শুরু হয়। প্রথম থেকেই মুসলমানদের স্বভাব ছিল তাদের সম্পত্তির একটা অংশ তারা আল্লাহর পথে দিয়ে যেতেন। এই সম্পদ কিভাবে ব্যয় হবে তা-ও বলে দিতেন। যেমনÑ এর মাধ্যমে সেখানে সরাইখানা করা হতো যেখানে পর্যটকেরা থাকতে পারতেন। যারা মুসাফির হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেন তারা থাকতে পারতেন। সে সময় বহু হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। সেসব ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন আকারে হয়েছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব কিছুই ওয়াকফের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ওয়াকফের ফান্ড থেকে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা চালু ছিল। সমাজের যত এতিম ছিল তাদের জন্য ওয়াকফের মাধ্যমে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হতো। সমাজের দুস্থ শ্রেণীর শিশুদের জন্য একটি পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাদের ভরণপোষণের সব রকম ব্যবস্থা এই ওয়াকফ ফান্ড থেকে করা হতো। অর্থাৎ বলতে গেলে তখন ওয়াকফের একটি বিরাট সামাজিক ভূমিকা ছিল, গুরুত্বও ছিল।
ঐতিহাসিক বিচারে আমরা দেখতে পাই, মধ্য এশিয়ার ইতিহাস পড়ে আমি দেখেছি, মধ্য এশিয়া বিশেষ করে তাতারস্তান, বশখিরিয়া, ভলগা-উরাল অঞ্চলের মতো রাশিয়ার মুসলিম অঞ্চল অথবা মধ্য এশিয়ার যেসব অঞ্চল এক সময় রাশিয়া দখল করে নিয়েছিল সেসব জায়গায় ওয়াকফের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তাদের ভূখণ্ডের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এত বিপুল সম্পত্তি ওয়াকফের অধীনে থাকার কথা ইতিহাস সাক্ষী দেয়। তখন মূল সম্পদ হিসেবে ভূসম্পত্তিকেই ধরা হতো। এটা আজ থেকে চার-পাঁচ শ’ বছর আগের কথা। এটা শিল্প বিপ্লবের বহু আগের কথা। সে সময় সম্পদ বলতে বোঝাত এক দিকে জায়গাজমি আর অন্য দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্য। আমি Pall Mall Press, London থেকে প্রকাশিত Alexander Bennigsen and C. L Quelquejay-Islam in the Soviet Union বইতে এই বিষয়ে দেখেছি। আবার ড. ওমর চাপরা তার Islam and the Economic Challenge বইয়ে বলেছেন, ওয়াকফের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে এবং একসময় মুসলিম বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ ভাগ সম্পদ ওয়াকফের অধীনে চলে এসেছিল।
কিন্তু পরবর্তীকালে কমিউনিস্টেরা সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে সব সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করল। ফলে সেসব ওয়াকফের অধীনে যেসব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এতিমখানা, সরাইখানা বা হাসপাতাল পরিচালিত হতো তার সবই বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের দেশে একসময় ওয়াকফ সিস্টেম চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে আগ থেকে চলে আসা কিছু ওয়াকফ ছাড়া নতুন করে ওয়াকফ কম হচ্ছে। আমরা যদি সত্যিই সমাজের দুস্থ ও দরিদ্রদের জন্য ব্যবস্থা করতে চাই যারা সমাজে অসহায় ও বিত্তহীন, তাহলে আমাদের নতুন করে আবার ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করতে হবে। এর জন্য একটি নতুন ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করা উচিত বলে আমি মনে করি। এটা সারা বিশ্বেই শুরু করা উচিত, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।
আমাদের দেশের কথাই বলি; এখানে যাদের শত কোটি টাকা আছে বা প্রচুর সম্পদ আছে, তারা তাদের অর্থসম্পদ রেখে মারা গেলে সেই অর্থসম্পদে তাদের কী লাভ হবে? তারা তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যেমনÑ তিন ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ কিংবা দশ ভাগের এক ভাগ ওয়াকফ করে যেতে পারেন। বার্কি অর্থসম্পদ তাদের পরিবারের জন্য থাকবে। এর জন্য একেকজন একেক নামে ফাউন্ডেশন গঠন করে যাবেন। ‘ক’ করবে ‘ক’ ফাউন্ডেশন, ‘খ’ করবে ‘খ’ ফাউন্ডেশন। আর এসবের যদি ওয়াকফ করা ২০, ২৫ কিংবা ৩০ কোটি টাকার সম্পদ থাকে তাহলে তা সমাজের জন্য বিরাট অর্থবহ হয়ে উঠবে। এসব ওয়াকফের মূল সম্পদ নয়, আয় সমাজকল্যাণে ব্যবহৃত হবে। এভাবে যদি আমাদের দেশে ১০০, ২০০, ৩০০ ওয়াকফ ফাউন্ডেশন তৈরি হয় তাহলে তার কী বিপুল প্রভাব সমাজে পড়ে, তা চিন্তার বিষয়। এসব ফাউন্ডেশন কী করতে পারে। কোনো কোনো ফাউন্ডেশন হাসপাতাল করতে পারে, কেউ এতিমখানা করল, সেই সাথে স্কুল-কলেজ করতে পারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও করতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে। কোনো ফাউন্ডেশন হসপিটাল তৈরি করতে পারে, যেখানে কম পয়সায় মানুষ চিকিৎসা নিতে পারবে। লোকেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এলে তাদের থাকার জায়গার অভাব, হোটেল খরচ দিতেও পারে না, কষ্ট পায়; সেখানে অত্যন্ত কম ফির মাধ্যমে, এমনকি বিনামূল্যে তাদের জন্য মুসাফিরখানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেহেতু এটা ওয়াকফ প্রপার্টি, তাই ফ্রিও করা যেতে পারে। নাহলে খুব সামান্য ফি করা যেতে পারে। আবার কোনো ফাউন্ডেশন শুধু এমন হতে পারে যে, তারা বৃদ্ধনিবাস তৈরি করে বয়স্কদের রাখার ব্যবস্থা করবে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। বিধবাদের দেখাশোনার জন্যও হতে পারে। এমনিভাবে বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব অসহায়ের দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ওয়াকফ কাজটি হবে জাকাতের অতিরিক্ত এবং জাকাত থেকে আলাদা। মানুষ জাকাত তো দেবেই, জাকাতের মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচনের বিরাট কাজ হতে পারে। আবার এসব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও জাকাতকে অর্গানাইজ করা যায়। তারা ওয়াকফ ছাড়াও জাকাতের জন্য একটা স্পেশাল ফান্ডের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে তা শুধু জাকাতের খাতেই ব্যয় হবে। সেটা কোনো সমস্যা হবে না। আর জাকাতের মাধ্যমেও বিপুল গরিব পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করা যায়। আমাদের দেশে জাকাতকে প্রধানত স্বনির্ভর করার কাজে ব্যয় করা উচিত। তারপর মানুষের অনেক ঋণ থাকে, সেই ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা উচিত। জাকাতের মাধ্যমে গরিব, মিসকিনদের ভাতা দেয়া উচিত। এটা বয়স্কভাতা বা বিধবাভাতা হতে পারে।
জাকাত আদায়ের পরিমাণ আমাদের সমাজে আগের তুলনায় বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। প্রত্যেক শিল্পপতিই আজ জাকাত দেন। তাদের জাকাতের টাকা যদি তারা নিজেরা সঠিকভাবে ব্যয় করেন, তাহলেও তার প্রভাব সমাজে পড়বে। এই জাকাতের টাকা দিয়ে তারা বিপুল রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন। সমাজের বিধবাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করতে পারেন। বিত্তহীন ও অসহায়দের জন্য ভাতা সিস্টেম করতে পারেন। আর এই জাকাতের সাথে যদি ওয়াকফ যোগ হয়, তাহলে তা দিয়ে কী বিরাট কাজই না হতে পারে সমাজে।
এ জন্য আমি মনে করি, আমাদের দেশে নতুন করে একটি ওয়াকফ আন্দোলন দরকার। আমার আবেদনও থাকবে, যারা কোটিপতি বা শত কোটি টাকার মালিক, তারা একটি করে ফাউন্ডেশন তৈরি করবেন। তারা সব সম্পদ তাদের সন্তান বা পরিবারের জন্য না রেখে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ওয়াকফ করে দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের জন্য রাখবেন। তারাই একটি কমিটি গঠন করবেন বা বলবেন কী ধরনের কমিটি হবে। কমিটির মাধ্যমেই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হবে। নগদ টাকাই যে দিতে হবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেমনÑ কারো দশটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলে তিনটা প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ দিয়ে দিতে পারেন। এতে তিনটি কোম্পানি ওয়াকফে চলে গেল। এর অর্থ জমির আয় থেকে যেমন ব্যবস্থা তেমনি এই ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান থেকেও আয় হবে। সেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থাকবে ফাউন্ডেশন। সেখান থেকে যে আয় আসবে, তা সমাজকল্যাণ কাজে ব্যয় হবে। আবার একটা নতুন ধরনের ওয়াকফে আমরা ব্যাপক সাড়া পেতে পারি। ক্যাশ ওয়াকফ, যা ইসলামী ব্যাংক চালু করেছে। যেকোনো সম্পদ ওয়াকফ করা যায়, ক্যাশ বা নগদ অর্থও সম্পদ। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা ব্যাংকে ক্যাশ ওয়াকফ রাখতে পারেন। তারা যে টাকা ব্যাংকে ওয়াকফ হিসেবে রাখবেন তা ব্যয় করা যাবে না। শুধু আয়টা সমাজকল্যাণ কাজে ব্যয় করতে পারবেন। ক্যাশ ওয়াকফকারী বলতেও পারেন কোন ক্ষেত্রে তার ওয়াকফের আয় ব্যয় করবেন। ব্যাংক এ ক্ষেত্রে মুতাওয়াল্লি বা পরিচালক হিসেবে কাজ করবে। এ ব্যবস্থাটিও জনপ্রিয় করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বর্তমানে যে ওয়াকফ আছে তার পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয় এবং তা খুব একটা ভালো চলছে না। আবার যাও আছে, তার যে ব্যবহার হতে পারত তা হচ্ছে না। এর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা আছে। আবার যারা এর মুতাওয়াল্লি তাদেরও ব্যর্থতা আছে। এসবই সত্য কথা। কিন্তু আমি ওয়াকফের কথা উল্লেখ করেছি তা কিছুটা নতুন ধরনের। এটা একেকটা ফাউন্ডেশন ধরনের হবে বা ট্রাস্ট ধরনের হবে। ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় তা পরিচালিত হবে। সেখানে একটা সিস্টেমেটিক ম্যানেজমেন্ট হবে। সেখানে প্রচলিত ওয়াকফের পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখানে কোনো একক ব্যক্তি কর্তৃক অপব্যয়, অপব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকবে না। আর বর্তমানে যেসব ওয়াকফ আছে তা খুব সামান্য এবং বাস্তবে এসব দিয়ে তেমন কিছুই হবে না। এগুলো যেমন আছে তাই থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান ওয়াকফগুলো হলো কতগুলো দরগাকেন্দ্রিক, এর আয় সমাজের মানুষের খুব একটা কাজেও লাগছে না। কিছু ওয়াকফ মসজিদ পরিচালিত। এগুলো চলবে। কিছু ওয়াকফ চালাচ্ছে এতিমখানা, এটাও চলুক। অনেক মাদরাসা ওয়াকফ চালায়। কিছু কিছু ওয়াকফ মসজিদের খরচ বহন করে। এসবই ভালো। এসব থেকে আমাদের যে নতুন প্রকৃতির ওয়াকফ তা হবে ভিন্ন ধরনের এবং অনেক উন্নত। এখানে মডার্ন করপোরেশন ধরনের ম্যানেজমেন্ট ব্যবহার করা হবে। ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট যাকে বলা হয়, এখানে সেটাই ব্যবহার করা হবে। তখন এ ওয়াকফ দিয়ে অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব হবে।
আগে হয়তো কোনো ব্যক্তি কোনো মাদরাসাকে সম্পদ লিখে দিতেন, আকারও ছোট ছিল। সেটা কখনো বড় আকার ধারণ করেনি। আর সে যুগে আজকের মতো এত সম্পদশালী ব্যক্তিও ছিলেন না। এখন অনেক পরিবারই ১০০, ২০০, ৫০০ কোটি টাকার মালিক। এদের থেকেই নতুন ওয়াকফের কথা চিন্তা করা সম্ভব। তবে আজকের ব্যক্তি-ওয়াকফ খুব কম। সেটাও চলতে থাকবে। কিন্তু তার থেকে বর্তমান প্রস্তাবিত ফর্মে করাই ভালো। এর জন্য সরকারি আইন থাকবে, কেউ যেন এর অপব্যবহার বা অপচয় না করতে পারে। এটা প্রাইভেট-পর্যায়ে থাকবে। যিনি ওয়াকিফ তিনি বলে দেবেন কী কাজে, কিভাবে বা কোন কোন খাতে ওয়াকফের আয়-ব্যয় হবে। তিনি বলতে পারেন, কোন কাজে ব্যয় করা হবে। এর মানে হলো আসলে সব কাজেই ব্যয় করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে সবাই সব কাজ করতে পারে না। কাজেই কাউকে হাসপাতাল, কাউকে এতিমখানা বা স্কুল-কলেজ দিয়ে যেতে হবে। এটা নানা ধরনের হতে পারে। আমাদের দেশে তাই সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দুস্থদের সাহায্যের জন্য নতুন ধরনের ওয়াকফ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশেই নতুন করে ওয়াকফ আন্দোলন করা দরকার। আশা করি, জাতির চিন্তাবিদ, স্কলার ও আলেমগণ এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করবেন। আর সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা সে দিকে নজর দেবেন এবং এগিয়ে আসবেন।
আমাদের নতুন এক ওয়াকফ আন্দোলন প্রয়োজন। ওয়াকফের যে গুরুত্ব, তা আজকের দিনে আমাদের সমাজে হারিয়ে গেছে। সেই গুরুত্বকে আমাদের পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
ওয়াকফের নীতি হলো, যেকোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তির একটি অংশ আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়ে দিতে পারে এবং বলে দিতে পারে সে সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে, কী কাজে ব্যবহার হবে। ওয়াকফ সব সময় ভালো কাজেই ব্যবহার করা যায়, মন্দ কাজে ব্যবহার করা যায় না। ওয়াকফ যিনি করেন, তিনিই ওয়াকফ কিভাবে চলবে তার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তার ব্যবস্থাপনা কৌশল বলে দেন। কমিটির মাধ্যমে বা কিভাবে ওয়াকফ পরিচালিত হবে, এ নির্দেশ তিনি দিতে পারেন।
ইসলামের শুরুতেই ওয়াকফ শুরু হয়। প্রথম থেকেই মুসলমানদের স্বভাব ছিল তাদের সম্পত্তির একটা অংশ তারা আল্লাহর পথে দিয়ে যেতেন। এই সম্পদ কিভাবে ব্যয় হবে তা-ও বলে দিতেন। যেমনÑ এর মাধ্যমে সেখানে সরাইখানা করা হতো যেখানে পর্যটকেরা থাকতে পারতেন। যারা মুসাফির হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেন তারা থাকতে পারতেন। সে সময় বহু হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। সেসব ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন আকারে হয়েছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব কিছুই ওয়াকফের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ওয়াকফের ফান্ড থেকে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা চালু ছিল। সমাজের যত এতিম ছিল তাদের জন্য ওয়াকফের মাধ্যমে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হতো। সমাজের দুস্থ শ্রেণীর শিশুদের জন্য একটি পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাদের ভরণপোষণের সব রকম ব্যবস্থা এই ওয়াকফ ফান্ড থেকে করা হতো। অর্থাৎ বলতে গেলে তখন ওয়াকফের একটি বিরাট সামাজিক ভূমিকা ছিল, গুরুত্বও ছিল।
ঐতিহাসিক বিচারে আমরা দেখতে পাই, মধ্য এশিয়ার ইতিহাস পড়ে আমি দেখেছি, মধ্য এশিয়া বিশেষ করে তাতারস্তান, বশখিরিয়া, ভলগা-উরাল অঞ্চলের মতো রাশিয়ার মুসলিম অঞ্চল অথবা মধ্য এশিয়ার যেসব অঞ্চল এক সময় রাশিয়া দখল করে নিয়েছিল সেসব জায়গায় ওয়াকফের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তাদের ভূখণ্ডের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এত বিপুল সম্পত্তি ওয়াকফের অধীনে থাকার কথা ইতিহাস সাক্ষী দেয়। তখন মূল সম্পদ হিসেবে ভূসম্পত্তিকেই ধরা হতো। এটা আজ থেকে চার-পাঁচ শ’ বছর আগের কথা। এটা শিল্প বিপ্লবের বহু আগের কথা। সে সময় সম্পদ বলতে বোঝাত এক দিকে জায়গাজমি আর অন্য দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্য। আমি Pall Mall Press, London থেকে প্রকাশিত Alexander Bennigsen and C. L Quelquejay-Islam in the Soviet Union বইতে এই বিষয়ে দেখেছি। আবার ড. ওমর চাপরা তার Islam and the Economic Challenge বইয়ে বলেছেন, ওয়াকফের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে এবং একসময় মুসলিম বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ ভাগ সম্পদ ওয়াকফের অধীনে চলে এসেছিল।
কিন্তু পরবর্তীকালে কমিউনিস্টেরা সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে সব সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করল। ফলে সেসব ওয়াকফের অধীনে যেসব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এতিমখানা, সরাইখানা বা হাসপাতাল পরিচালিত হতো তার সবই বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের দেশে একসময় ওয়াকফ সিস্টেম চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে আগ থেকে চলে আসা কিছু ওয়াকফ ছাড়া নতুন করে ওয়াকফ কম হচ্ছে। আমরা যদি সত্যিই সমাজের দুস্থ ও দরিদ্রদের জন্য ব্যবস্থা করতে চাই যারা সমাজে অসহায় ও বিত্তহীন, তাহলে আমাদের নতুন করে আবার ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করতে হবে। এর জন্য একটি নতুন ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করা উচিত বলে আমি মনে করি। এটা সারা বিশ্বেই শুরু করা উচিত, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।
আমাদের দেশের কথাই বলি; এখানে যাদের শত কোটি টাকা আছে বা প্রচুর সম্পদ আছে, তারা তাদের অর্থসম্পদ রেখে মারা গেলে সেই অর্থসম্পদে তাদের কী লাভ হবে? তারা তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যেমনÑ তিন ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ কিংবা দশ ভাগের এক ভাগ ওয়াকফ করে যেতে পারেন। বার্কি অর্থসম্পদ তাদের পরিবারের জন্য থাকবে। এর জন্য একেকজন একেক নামে ফাউন্ডেশন গঠন করে যাবেন। ‘ক’ করবে ‘ক’ ফাউন্ডেশন, ‘খ’ করবে ‘খ’ ফাউন্ডেশন। আর এসবের যদি ওয়াকফ করা ২০, ২৫ কিংবা ৩০ কোটি টাকার সম্পদ থাকে তাহলে তা সমাজের জন্য বিরাট অর্থবহ হয়ে উঠবে। এসব ওয়াকফের মূল সম্পদ নয়, আয় সমাজকল্যাণে ব্যবহৃত হবে। এভাবে যদি আমাদের দেশে ১০০, ২০০, ৩০০ ওয়াকফ ফাউন্ডেশন তৈরি হয় তাহলে তার কী বিপুল প্রভাব সমাজে পড়ে, তা চিন্তার বিষয়। এসব ফাউন্ডেশন কী করতে পারে। কোনো কোনো ফাউন্ডেশন হাসপাতাল করতে পারে, কেউ এতিমখানা করল, সেই সাথে স্কুল-কলেজ করতে পারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও করতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে। কোনো ফাউন্ডেশন হসপিটাল তৈরি করতে পারে, যেখানে কম পয়সায় মানুষ চিকিৎসা নিতে পারবে। লোকেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এলে তাদের থাকার জায়গার অভাব, হোটেল খরচ দিতেও পারে না, কষ্ট পায়; সেখানে অত্যন্ত কম ফির মাধ্যমে, এমনকি বিনামূল্যে তাদের জন্য মুসাফিরখানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেহেতু এটা ওয়াকফ প্রপার্টি, তাই ফ্রিও করা যেতে পারে। নাহলে খুব সামান্য ফি করা যেতে পারে। আবার কোনো ফাউন্ডেশন শুধু এমন হতে পারে যে, তারা বৃদ্ধনিবাস তৈরি করে বয়স্কদের রাখার ব্যবস্থা করবে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। বিধবাদের দেখাশোনার জন্যও হতে পারে। এমনিভাবে বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব অসহায়ের দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ওয়াকফ কাজটি হবে জাকাতের অতিরিক্ত এবং জাকাত থেকে আলাদা। মানুষ জাকাত তো দেবেই, জাকাতের মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচনের বিরাট কাজ হতে পারে। আবার এসব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও জাকাতকে অর্গানাইজ করা যায়। তারা ওয়াকফ ছাড়াও জাকাতের জন্য একটা স্পেশাল ফান্ডের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে তা শুধু জাকাতের খাতেই ব্যয় হবে। সেটা কোনো সমস্যা হবে না। আর জাকাতের মাধ্যমেও বিপুল গরিব পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করা যায়। আমাদের দেশে জাকাতকে প্রধানত স্বনির্ভর করার কাজে ব্যয় করা উচিত। তারপর মানুষের অনেক ঋণ থাকে, সেই ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা উচিত। জাকাতের মাধ্যমে গরিব, মিসকিনদের ভাতা দেয়া উচিত। এটা বয়স্কভাতা বা বিধবাভাতা হতে পারে।
জাকাত আদায়ের পরিমাণ আমাদের সমাজে আগের তুলনায় বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। প্রত্যেক শিল্পপতিই আজ জাকাত দেন। তাদের জাকাতের টাকা যদি তারা নিজেরা সঠিকভাবে ব্যয় করেন, তাহলেও তার প্রভাব সমাজে পড়বে। এই জাকাতের টাকা দিয়ে তারা বিপুল রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন। সমাজের বিধবাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করতে পারেন। বিত্তহীন ও অসহায়দের জন্য ভাতা সিস্টেম করতে পারেন। আর এই জাকাতের সাথে যদি ওয়াকফ যোগ হয়, তাহলে তা দিয়ে কী বিরাট কাজই না হতে পারে সমাজে।
এ জন্য আমি মনে করি, আমাদের দেশে নতুন করে একটি ওয়াকফ আন্দোলন দরকার।
আমার আবেদনও থাকবে, যারা কোটিপতি বা শত কোটি টাকার মালিক, তারা একটি করে ফাউন্ডেশন তৈরি করবেন। তারা সব সম্পদ তাদের সন্তান বা পরিবারের জন্য না রেখে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ওয়াকফ করে দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের জন্য রাখবেন। তারাই একটি কমিটি গঠন করবেন বা বলবেন কী ধরনের কমিটি হবে। কমিটির মাধ্যমেই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হবে। নগদ টাকাই যে দিতে হবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেমনÑ কারো দশটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলে তিনটা প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ দিয়ে দিতে পারেন। এতে তিনটি কোম্পানি ওয়াকফে চলে গেল। এর অর্থ জমির আয় থেকে যেমন ব্যবস্থা তেমনি এই ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান থেকেও আয় হবে। সেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থাকবে ফাউন্ডেশন। সেখান থেকে যে আয় আসবে, তা সমাজকল্যাণ কাজে ব্যয় হবে। আবার একটা নতুন ধরনের ওয়াকফে আমরা ব্যাপক সাড়া পেতে পারি। ক্যাশ ওয়াকফ, যা ইসলামী ব্যাংক চালু করেছে। যেকোনো সম্পদ ওয়াকফ করা যায়, ক্যাশ বা নগদ অর্থও সম্পদ। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা ব্যাংকে ক্যাশ ওয়াকফ রাখতে পারেন। তারা যে টাকা ব্যাংকে ওয়াকফ হিসেবে রাখবেন তা ব্যয় করা যাবে না। শুধু আয়টা সমাজকল্যাণ কাজে ব্যয় করতে পারবেন। ক্যাশ ওয়াকফকারী বলতেও পারেন কোন ক্ষেত্রে তার ওয়াকফের আয় ব্যয় করবেন। ব্যাংক এ ক্ষেত্রে মুতাওয়াল্লি বা পরিচালক হিসেবে কাজ করবে। এ ব্যবস্থাটিও জনপ্রিয় করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বর্তমানে যে ওয়াকফ আছে তার পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয় এবং তা খুব একটা ভালো চলছে না। আবার যাও আছে, তার যে ব্যবহার হতে পারত তা হচ্ছে না। এর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা আছে। আবার যারা এর মুতাওয়াল্লি তাদেরও ব্যর্থতা আছে। এসবই সত্য কথা। কিন্তু আমি ওয়াকফের কথা উল্লেখ করেছি তা কিছুটা নতুন ধরনের। এটা একেকটা ফাউন্ডেশন ধরনের হবে বা ট্রাস্ট ধরনের হবে। ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় তা পরিচালিত হবে। সেখানে একটা সিস্টেমেটিক ম্যানেজমেন্ট হবে। সেখানে প্রচলিত ওয়াকফের পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখানে কোনো একক ব্যক্তি কর্তৃক অপব্যয়, অপব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকবে না। আর বর্তমানে যেসব ওয়াকফ আছে তা খুব সামান্য এবং বাস্তবে এসব দিয়ে তেমন কিছুই হবে না। এগুলো যেমন আছে তাই থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান ওয়াকফগুলো হলো কতগুলো দরগাকেন্দ্রিক, এর আয় সমাজের মানুষের খুব একটা কাজেও লাগছে না। কিছু ওয়াকফ মসজিদ পরিচালিত। এগুলো চলবে। কিছু ওয়াকফ চালাচ্ছে এতিমখানা, এটাও চলুক। অনেক মাদরাসা ওয়াকফ চালায়। কিছু কিছু ওয়াকফ মসজিদের খরচ বহন করে। এসবই ভালো। এসব থেকে আমাদের যে নতুন প্রকৃতির ওয়াকফ তা হবে ভিন্ন ধরনের এবং অনেক উন্নত। এখানে মডার্ন করপোরেশন ধরনের ম্যানেজমেন্ট ব্যবহার করা হবে। ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট যাকে বলা হয়, এখানে সেটাই ব্যবহার করা হবে। তখন এ ওয়াকফ দিয়ে অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব হবে।
আগে হয়তো কোনো ব্যক্তি কোনো মাদরাসাকে সম্পদ লিখে দিতেন, আকারও ছোট ছিল। সেটা কখনো বড় আকার ধারণ করেনি। আর সে যুগে আজকের মতো এত সম্পদশালী ব্যক্তিও ছিলেন না। এখন অনেক পরিবারই ১০০, ২০০, ৫০০ কোটি টাকার মালিক। এদের থেকেই নতুন ওয়াকফের কথা চিন্তা করা সম্ভব। তবে আজকের ব্যক্তি-ওয়াকফ খুব কম। সেটাও চলতে থাকবে। কিন্তু তার থেকে বর্তমান প্রস্তাবিত ফর্মে করাই ভালো। এর জন্য সরকারি আইন থাকবে, কেউ যেন এর অপব্যবহার বা অপচয় না করতে পারে। এটা প্রাইভেট-পর্যায়ে থাকবে। যিনি ওয়াকিফ তিনি বলে দেবেন কী কাজে, কিভাবে বা কোন কোন খাতে ওয়াকফের আয়-ব্যয় হবে। তিনি বলতে পারেন, কোন কাজে ব্যয় করা হবে। এর মানে হলো আসলে সব কাজেই ব্যয় করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে সবাই সব কাজ করতে পারে না। কাজেই কাউকে হাসপাতাল, কাউকে এতিমখানা বা স্কুল-কলেজ দিয়ে যেতে হবে। এটা নানা ধরনের হতে পারে। আমাদের দেশে তাই সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দুস্থদের সাহায্যের জন্য নতুন ধরনের ওয়াকফ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশেই নতুন করে ওয়াকফ আন্দোলন করা দরকার। আশা করি, জাতির চিন্তাবিদ, স্কলার ও আলেমগণ এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করবেন। আর সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা সে দিকে নজর দেবেন এবং এগিয়ে আসবেন।
লিখেছেন:শাহ্ আবদুল হান্নান সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিষয়: বিবিধ
১২৬১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকুম আল্লাহ শেয়ারিংএর জন্য।
অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন