যাঁদের চোখে সহযে কান্না আসেনা এ লেখাটি সুযোগ করে দিবে ইনশাআল্লাহ।

লিখেছেন লিখেছেন মিজবাহ ২২ জুলাই, ২০১৪, ০৫:০১:৫৩ বিকাল

হে শ্রেষ্ঠ অভিভাবক ফিলিস্তিনিদের বাঁচান: গোলাম মাওলা রনি

তাবৎ দুনিয়ার মুসলমানদের মতো আমিও কোনো বিপদ-আপদ বা সঙ্কটে পড়লে পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াতের শেষ চুম্বক অংশটুকু পড়ি। বিশেষ করে যখন নিজের ওপর বিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণ একেবারেই থাকে না, তখন কায়মনোবাক্যে জপতে থাকি- হাসবুনাল্লাহু ওয়া নে’মাল ওয়াকিল। সরল বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়- আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ ওয়াকিল। এখানে ওয়াকিল বলতে কার্য নির্বাহকারী বা চমৎকার কামিয়াবি দানকারীকে বোঝাতে গিয়ে মানুষ তার সব কিছু তদারক করার ভার আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে থাকে। গত রমজানে আমি যখন জেলে, তখন অন্যান্য বন্দীর সাথে পাল্লা দিয়ে দিনরাত দোয়াটি পাঠ করতাম। প্রায় এক বছর পর গত ১৭ রমজানে তারাবি পড়তে গিয়ে আমার অতীতের সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে গেল। নিজের অসহায় অবস্থায় কিভাবে আল্লাহকে ডেকেছিলাম, সেই ঘটনা স্মরণ করার পাশাপাশি স্মরণ করছিলাম অসহায় এক ফিলিস্তিনি মহিলার কথা।

ভদ্রমহিলার নাম খুব সম্ভবত রাফেজা। তিনি একজন কুরআনের হাফেজা। তার স্বামী মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৩ বছরের সন্তান জায়েদকে নিয়ে রাফেজা থাকেন গাজায়। স্বামী মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে বলেন মিসরে গিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু রাফেজা তার জন্মভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে নারাজ। তাই স্বামীকে বাধ্য হয়েই বিভিন্ন ছুটিছাটা ও উৎসব-পার্বণে ছুটে আসতে হয় পরিবারের কাছে। সেবারও তিনি এলেন। অমনি শুরু হয়ে গেল ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণ। যে সময়টার কথা বলছি, সেটা সাত-আট বছর আগের ঘটনা। ইসরাইলি বাহিনী গাজায় স্থল হামলা চালাচ্ছে। তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়- রাস্তায় যাকে পায় তাকেই গুলি করে বা ধরে নিয়ে যায়। এই সঙ্কটময় অবস্থাতেই গাজার ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবন চালিয়ে যাচ্ছিল।

ঘটনার দিন রাফেজা ব্যস্ত ছিলেন পরিবারের জন্য দুপুরের খাবার বানানোর কাজে। জায়েদের প্রিয় একটি খাবার বানাতে গিয়ে তিনি বারবার আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছিলেন এই ভেবে যে, আজ অনেক দিন পর স্বামী-সন্তানকে নিয়ে একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ তিনি পেয়েছেন। তার খুব ইচ্ছে হলো, মধ্যাহ্নভোজের পর তিনজন মিলে দিবানিদ্রা উপভোগ করার। জায়েদ ইদানীং খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠেছে। সেই বালকবেলা থেকেই সন্তানটি যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে শুয়ে দুরন্তপনার নানা খুঁনসুটি করত, তখন রাফেজার মনে হতো আকাশের চাঁদ যেন তাদের সংসারে ধরা দিয়েছে। ইদানীং জায়েদের যে কী হয়েছে তা বোঝা মুশকিল। আগেকার ছোট বালকটির মতো তার মিহি সুর যেমন নেই, তেমনি আবার কিশোর বা তরুণদের মতো স্বরও নয়। ছেলের এই অবস্থা দেখে রাফেজার মায়া আরো বেড়ে যায়। মনে হয় কলিজার টুকরা সন্তানকে সারা দিন বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু জায়েদ আর আগের মতো মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সে সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাড়ির সামনের মাঠে সমবয়সী ছেলেদের সাথে খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

রান্নার পর্ব যখন প্রায় শেষ হতে যাচ্ছিল তখন রাফেজা লক্ষ করলেন, জায়েদ ঘরে নেই। তিনি স্বামীকে বললেন বাইরে গিয়ে জায়েদকে তাড়াতাড়ি ডেকে আনতে। উদ্দেশ্য, একসাথে খাওয়া-দাওয়া করবেন এবং তারপর দিবানিদ্রা যাবেন। অন্য দিন হলে রাফেজার স্বামী তার স্ত্রীর কথা শোনামাত্র তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে লাফিয়ে উঠতেন। কিন্তু সেদিন তিনি উঠলেন না, বরং বসে বসে হাই তুলতে লাগলেন। স্বামীর এই অদ্ভুত আচরণে রাফেজার মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেল। তিনি অনেকটা কর্তৃত্বের সুরে ধমক দিয়ে স্বামীকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন সন্তানকে খুঁজে আনার জন্য। স্বামী বাইরে চলে যাওয়ার পর রাফেজা অতি দ্রুত রান্নার কাজ শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিল সাজিয়ে বসে রইলেন। এ দিকে আধ ঘণ্টা পার হয়ে গেল। স্বামী এলো না। কিন্তু খেলা শেষে জায়েদ ফিরে এলো। এভাবে আরো কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর রাফেজা এবার জায়েদকে পাঠালেন তার বাবাকে খুঁজে আনতে। মায়ের নির্দেশ পেয়ে জায়েদ সেই যে বের হলো, আর ফেরার চেষ্টাই করল না।

স্বামী-সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাফেজা যেই না বিরক্তির প্রান্তসীমায় পৌঁছতে যাবেন, অমনি বাইরে থেকে ভেসে এলো হইচই আর কান্নার শব্দ। তিনি আনমনে দরজা খুললেন এবং কয়েক শ’ লোককে কাঁদতে দেখে কিছুই বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ করেই অনুধাবন করলেন সবাই যেন তার কোনো ব্যাপারেই কাঁদছে। তিনি অনুমান করলেন, হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি যথাসম্ভব দৃঢ়তা নিয়ে লোকজনের কথামতো এগোতে থাকলেন। তিনি যা জানতে পারলেন তাতে তিনি নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারলেন না। চিৎকার করতে করতে তিনি ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে থাকলেন। লোকজন বলল- রাফেজার স্বামী যখন রাস্তায় নেমে তার ছেলেকে খুঁজছিলেন, ঠিক তখনই ইসরাইলি টহল সেনারা তাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। তিনি সাথে সাথে মারা যান। তার রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় পড়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর জায়েদ পিতাকে খুঁজতে এসে পিতার লাশ দেখে শুরু করে কান্না। সে তার জন্মদাতার রক্তাক্ত লাশ জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী আওয়াজে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার শব্দে আশপাশের কয়েক শ’ ফিলিস্তিনি এগিয়ে আসতে শুরু করে। এ অবস্থায় ইসরাইলের সৈন্যরা কান্নারত জায়েদ এবং মৃত বাবার লাশের ওপর দিয়ে ট্যাংক চালিয়ে পিতাপুত্র উভয়কে রাজপথে রক্তকবর দিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে।

রাফেজা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন, তখন সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্তপিণ্ড, মাংসপিণ্ড, মাথার মগজ এবং খুলির কিছু অংশ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। রাফেজা রাস্তায় শুয়ে পড়ে স্বামী-সন্তানের রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড এবং মাথার খুলি কুড়িয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। আসমানের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর চোখ বুজলেন। তার চোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে গেল। তিনি আবার চোখ মেললেন এবং চিৎকার করে বলতে থাকলেন- হাসবুনাল্লাহু ওয়া নে’মাল ওয়াকিল!

নামাজ পড়তে পড়তে আমার রাফেজার কথা মনে পড়ছিল আর ভেসে উঠছিল গত কয়েক দিনে ইসরাইলি হামলায় নিহত ও আহত শত শত মানুষ বিশেষ করে অসহায় নারী ও শিশুর মুখমণ্ডল। আমি নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিলাম না। সিজদায় গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। আবার সিজদা থেকে উঠে যখন দাঁড়ালাম, তখনো কান্না রোধ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কে যেন আমার বুকের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চোখের পানি, নাকের পানি একাকার হয়ে পাঞ্জাবি ভিজে যেতে থাকল। নামাজ শেষেও আমার কান্না থামছিল না। কাঁদতে কাঁদতে যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন মহল্লাবাসীর অনেকে সেই দৃশ্য দেখল। সম্ভবত আমার মর্যাদা ও সম্ভ্রমের দিকে তাকিয়ে তারা নীরব থাকল, কেউ জিজ্ঞেস করল না, কেন কাঁদছি।

আমরা সামান্য একটু বিপদে পড়েই নিজের প্রতি এবং আমাদের মালিকের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলি। রাফেজা যে অবস্থায় এবং যে পরিস্থিতিতে বলতে পারলেন- আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনিই উত্তম ও শ্রেষ্ঠ অভিভাবক বা ওয়াকিল; সেই অবস্থায় আমাদের দেশের ক’জন অমন করে বলতে পারতেন জানি না; তবে আমি হয়তো জ্ঞানই হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু রাফেজা জ্ঞান হারাননি। রাফেজার মতো হাজার হাজার গৃহবধূ গত ৫০ বছরে ফিলিস্তিনে বসে তাদের স্বামী-সন্তানকে হারিয়ে একবারের জন্যও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেননি কিংবা ঊষর মরুভূমির অনুর্বর প্রস্তরভূমি বলে ঘৃণা করে নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাননি। এখানেই ফিলিস্তিনি মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব আর ইসলামের মহিমান্বিত সৌন্দর্য প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।

ইতিহাস কেবল ২০১৪ সালের রমজানকে ঘিরেই আবর্তিত হবে না। জেরুসালেম, নাবলুস, গাজা, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর এবং রামাল্লার হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিটি ফোঁটা রক্তের দায় একদিন না একদিন ইহুদি এবং তাদের দোসরদের মেটাতে হবেই? ইহুদি নামের অভিশপ্ত জাতিটির শেষ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা:-এর ভবিষ্যদ্বাণী নিম্নরূপ- ‘এমন একটা সময় আসবে যখন ইহুদিরা মুসলমানদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকবে। কিন্তু জমিনে তাদের বহুমুখী অত্যাচার, অনাচার আর ব্যভিচারের কারণে সৃষ্টিকুলের প্রতিটি বস্তু তাদেরকে ঘৃণা করতে থাকবে। তারা কোথাও আশ্রয় লাভ করতে পারবে না। তারা যদি কোনো গাছের আড়ালে লুকাতে যায়, তবে গাছের জবান খুলে যাবে এবং গাছ মুসলমানদেরকে বলে দেবে ইহুদিদের অবস্থান সম্পর্কে।’ এত বড় অভিশপ্ত এবং দুনিয়াব্যাপী বিজয় সৃষ্টিকারী ইহুদিরা কিন্তু এক সময় মহান আল্লাহ পাকের সবচেয়ে বেশি রহমতপ্রাপ্ত বান্দা ছিল। এই দুনিয়ায় তাদেরকে যত বড় বাদশাহী দেয়া হয়েছিল, তা অন্য কোনো জাতিকে দেয়া হয়নি। নবী-রাসূল, নেতা ও সেনাপতি এই জাতির মধ্যে যত পয়দা করা হয়েছিল, তা অন্য কোনো জাতি পায়নি। আল্লাহর দয়ায় ইহুদিরা বহু বছর বিনাশ্রমে বেহেশতি খাবার খেয়েছিল এই দুনিয়ায় বসেই। কিন্তু সব নেয়ামত তারা নিজেরাই ধ্বংস করে দিয়েছে কেবল অহঙ্কার, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, নাফরমানি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি সীমাহীন অবিচার, অত্যাচার ও অনাচারের কারণে।

ইহুদি জাতির শুরুটাই হয়েছিল তাদের জন্মদাতা পিতাকে সীমাহীন লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা প্রদানের মাধ্যমে। নিজেদের ভাইকে মেরে ফেলার চক্রান্ত দিয়েই এই জাতির অপকর্মের ইতিহাস শুরু। হজরত ইব্রাহিম আ:-এর দুই সন্তান। প্রথমজন হজরত ইসমাইল আ: এবং দ্বিতীয়জন হজরত ইসহাক আ:। হজরত ইসমাইল আ:-এর বংশধরেরাই সেমেটিক আরব, যা পরবর্তীকালে উম্মতে মোহাম্মদীরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্য দিকে হজরত ইসহাক আ:-এর ছেলে হজরত ইয়াকুব আ:-এর বংশধরেরা বনি ইসরাইল বা ইহুদি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আজকের জেরুসালেম নগরীতেই বাস করতেন হজরত ইয়াকুব আ:। তার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এগারো সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে দুই সন্তান। একজনের নাম হজরত ইউসুফ আ:, অন্যজন বিন ইয়ামিন। প্রথম পক্ষের এগারো ভাই চক্রান্ত করলেন হজরত ইউসুফ আ:কে মেরে ফেলার জন্য। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। পবিত্র আল কুরআনের সূরা ইউসুফে আল্লাহ সেই কাহিনী চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইহুদিদের প্রথম উত্থান হয় মিসরে। যখন হজরত ইউসুফ আ: রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হলেন, তখন তিনি তার সৎ ভাইদের ক্ষমা করে দিলেন এবং তার পিতাসহ বংশের লোকজনকে মিসরে নিয়ে এলেন। এর পরবর্তী প্রায় ৫৫০ বছর তারা মিসরে ব্যাপকভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটালেও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে ধীরে ধীরে প্রায় সবাই ক্রীতদাসে পরিণত হলেন। হজরত মুসা আ:-এর জমানায় মিসরে এমনতর ক্রীতদাস প্রকৃতির ইহুদির সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। আরবের অন্যান্য ভূখণ্ডে কম করে হলেও ৫০ লাখ ইহুদি ছিল। হজরত মুসা আ:-এর নেতৃত্বে অভিশপ্ত ইহুদিরা পুনরায় আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে স্থান লাভ করেছিল। এভাবে অনেক দিন তাদের বেশ ভালোভাবে সময় কাটে। বিশেষ করে হজরত দাউদ আ: ও হজরত সোলায়মান আ:-এর সময়কাল পর্যন্ত। কিন্তু এর পরই তারা শুরু করে একের পর এক নাফরমানি। আল্লাহ ইহুদিদের বহু জাতি, সম্প্রদায়, গোত্র ও দলকে বিভিন্ন সময় সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সেইসব খোদায়ী গজবের নিদর্শন আজো জমিনে বিদ্যমান। কুখ্যাত আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়ার কাহিনী আমরা যেমন কুরআন শরীফ থেকে জানতে পারি, তেমনি বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কারে সেইসব জাতির বাড়িঘর, হাটবাজার ও রাজপ্রাসাদের যে প্রমাণ আমরা পাই, তাতে মানবজাতির জন্য রয়েছে বিরাট এক সতর্কতামূলক শিক্ষা।

ইসলাম বিস্তারের প্রারম্ভিক সময়ে বিশেষত মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের পর তথাকার ইহুদিরা বড়ই বাড়াবাড়ি শুরু করল। প্রথমে তারা ইয়াসরিব অর্থাৎ মদিনা নগরীতে শুরু করল তাণ্ডব। আল্লাহর রাসূল সা: তাদেরকে শহর থেকে বের করে দিলেন। তারা তাদের প্রধান ঘাঁটি খায়বারে গিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হলো এবং সেখান থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালিয়ে যেতে থাকে। রাসূল সা: খায়বার আক্রমণ করে তাদের দুর্গ, বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি সব তছনছ করে দেন এবং তাদের এলাকা ছাড়া করেন। এই ঘটনার পর সমগ্র আরব ভূমিতে ওদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না প্রায় ১৩০০ বছর ধরে। প্রথম মহাযুদ্ধে ওসমানিয়া খেলাফতের পতন হলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, উত্তর আফ্রিকা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট জনপদ ইউরোপীয় শক্তির দখলে আসে। তখন থেকে শুরু হয় নতুন দুর্ভোগ। সারা দুনিয়ায় ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা দলে দলে ভূমধ্যসাগরের তীরে এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে অতি সঙ্গোপনে এবং পরিকল্পিতভাবে।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় মক্কার গভর্নর শরিফ হোসাইন তার নিয়োগকর্তা অটোমান বা ওসমানিয়া খলিফাদের সাথে বেঈমানি করে ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানেরা পরাজিত হয়। সিরিয়া, লেবানন, জেরুসালেম, মক্কা-মদিনা, ইরাক, জর্ডান, মিসর, কুয়েত প্রভৃতি অঞ্চল প্রায় ১৩০০ বছরের মুসলিম শাসন ও সার্বভৌমত্ব থেকে বের হয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্রিটিশরা শরিফ হোসাইনের বড় ছেলে ফায়সালকে প্রথমে সিরিয়ার বাদশাহ এবং পরে ইরাকের বাদশাহ মনোনীত করে- অনেকটা আমাদের দেশের মীরজাফরের মতো। ১৯১৯ সালের ৩ জানুয়ারি বাদশাহ ফায়সাল এবং বিশ্ব ইহুদিদের নেতা ওয়াইজম্যানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘শান্তিচুক্তি’ মোতাবেক ইহুদিরা দলে দলে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে জেরুসালেম, পশ্চিম তীর, হেবরন প্রভৃতি এলাকায় বসতি স্থাপন করতে থাকে। মুসলমানেরা তখন আত্মকলহ এবং ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামে এতটাই ব্যস্ত যে, ফিলিস্তিন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া মহাসর্বনাশ সম্পর্কে তাদের চিন্তা করার ফুরসত ছিল না।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ওয়াইজম্যান হলেন সেই রাষ্ট্রের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ১৯৪৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই যে বিষবৃক্ষের সূচনা হলো, যার বিষবাষ্প সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, দুনিয়ার সব মুসলমানের আত্মাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ইঙ্গ-মার্কিন খ্রিষ্টান ও ইহুদি লবিগুলো ৬৬ বছর ধরে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইসরাইল রাষ্ট্রকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে কেবল মুসলমানদের পদানত করার জন্য।

প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। দ্বিতীয়বার আবার যুদ্ধ বাধে ১৯৫৬ সালে সুয়েজখাল নিয়ে। এরপর ১৯৬৭ সালে। সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় ১৯৭৩ সালে। প্রতিটি যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের নিকট গো-হারা হেরেছে এবং একই সাথে বিশাল এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে। ইতঃপূর্বে পশ্চিম তীর ছিল জর্ডানের অধীন এবং গাজা উপদ্বীপ ছিল মিসরের মালিকানাধীন। ’৬৭ সালে যুদ্ধে জয়লাভ করে ইসরাইল ওইসব এলাকা নিজেদের দখলভুক্ত করে নেয়। প্রতিটি যুদ্ধের পর ইসরাইল আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং তাদের দোসরেরা আরো বেশি সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে তাদের মদদ দিতে থাকে। অন্য দিকে মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলের দালালদের বহুমুখী চক্রান্তের কারণে অধিকৃত ভূখণ্ড মুসলমানদেরকে ফেরত দেয়া এবং ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।

আজ সময় এসেছে ইসরাইলকে প্রতিহত করার। সময় এসেছে ইসরাইলের দোসরদেরকে ধিক্কার জানানোর এবং ফিলিস্তিনি অসহায় মুসলমানদের সাহায্য-সহযোগিতা করার। মুসলমানেরা যেমন পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো নয়, তেমনি অন্যান্য জাতিও আমাদের মতো নয়। ইসরাইলি, তথা ইহুদি এবং তাদের দোসরদের যাবতীয় আঁতাতের মূলে রয়েছে দুনিয়ার স্বার্থ। তাদের বন্ধনের মূলে রয়েছে অর্থবিত্ত, রাজত্ব এবং মুসলিমবিদ্বেষ। অন্য দিকে মুসলমানদের সব সম্পর্কের মূলে রয়েছে মহান আল্লাহ এবং তার রাসূল সা:-এর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা। উম্মতে মোহাম্মদীর মানবিক মূল্যবোধ, সৌজন্য ও অন্তর্নিহিত ঈমানি শক্তি যদি একবার জাগ্রত হয়, তবে পৃথিবীর কোনো শক্তির সাধ্য থাকবে না ইসরাইলকে রক্ষা করার। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা- হে আল্লাহ, আমরা প্রতিবাদ করতে চাই। আপনি আমাদেরকে প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়ে দিন। আমরা যুদ্ধ করতে চাই, আপনি আমাদেরকে হজরত উমর রা:, খালিদ বিন ওয়ালিদ কিংবা গাজী সালাহউদ্দীনের মতো নেতা দান করুন। হে আমাদের উত্তম অভিভাবক এবং শ্রেষ্ঠ ওয়াকিল- আপনি অসহায় ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের আপনার শত্রুদের জুলুম থেকে বাঁচান। আপনি নিঃসন্দেহে অতি উত্তম কৌশলী এবং সকল কার্য নির্বাহকারী।

আমরা বিশ্বাস করি, আপনার একটি ‘কুন’ (হও) শব্দে মহাবিশ্বে প্রলয় হয়ে যায়। আপনার সেই সার্বভৌম শক্তির দোহাই দিয়ে বলছি আপনি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করুন! সব জালিমকে ধ্বংস করুন এবং ঈমানদারদের করুন বিজয়ী। আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৩৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

247242
২২ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৩
হতভাগা লিখেছেন : প্রথম অংশ পড়ে খুব খারাপ লাগলো , আবার ঈর্ষাও হল । আমরা কি রাফেজার মত এমন ঈমান আনতে পেরেছি আল্লাহর উপর ? আল্লাহ আমাদের রহম করুন ।

রাফেজাসহ সকল ফিলিস্তিনিদের হেফাজত করুন ইহুদী ও তাদের দোসরদের হাত থেকে । সমূলে ধ্বংস করে দিন তাদের এবং পরকালে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে দাখিল করুন - আমিন ।

ইহুদীদের এহেন আচরনের কারণে এখন বিশ্ববাসী হিটলারের মত নৃশংস কাউকে চাইছে এদের সাইজ করার জন্য ।
247283
২২ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৫
মিজবাহ লিখেছেন : আসলে ভাই,রাফেজা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে!
247360
২২ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:০৩
শেখের পোলা লিখেছেন : " হাসবুনাল্লাহু অনেয়মাল ওয়াকীলল, নেয়মাল মওলা অনেয়মান্নাসীর"
২৩ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৮:৩৫
192121
মিজবাহ লিখেছেন : " হাসবুনাল্লাহু অনেয়মাল ওয়াকীলল, নেয়মাল মওলা অনেয়মান্নাসীর"
247872
২৪ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৮
মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন লিখেছেন : " হাসবুনাল্লাহু অনেয়মাল ওয়াকীলল, নেয়মাল মওলা অনেয়মান্নাসীর"

আসলেই অনেক কিছুই শেখার আছে।
২৪ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৭
192468
মিজবাহ লিখেছেন : জাজাকুম আল্লাহ খাইরান

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File