আমেরিকার পরিবার
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১১:৪৭:৩৬ সকাল
আমার হাউসমেট জিম জীবনের অন্তত ২২টি বছর মানুষ বাদ দিয়ে কুকুরের সাথে কাটিয়েছে। মানুষকে সে খুবই ঘৃণা করত এবং সহসা মিশতো না। গতকাল আমাকে স্টিলের খেলনা থালা বাসন,চামুচ এসব দেখিয়ে বললো এটা স্যামুয়েলের জন্যে। স্যামুয়েল হল অটিস্টিক বেবী,বয়স আড়াই। স্যামুয়েল যখন এই বাসায় আসে, সে সর্ব প্রথম আমাদের কিচেনের সমস্ত চামুচ,বাটার নাইফ,ফর্কস,খুন্তি,হাড়ি পাতিল যা পায় সব নিজের দখলে নেয় এবং খেলা করতে থাকে। ওর বহু দামী দামী খেলনা আছে কিন্তু সেসব রেখে হাড়ি পাতিল তার পছন্দ। জীম অনেক দামী দামী খেলনা কিনেছে তার জন্যে, কিন্তু গতকালের খেলনাটা আসলেই স্যামুয়েলের উপযোগী। বাচ্চাটার আবারও সার্জারী হয়েছে। ওর কপালের পাশে হালকা একটু ফুলে মত উঠেছিলো, সেটা নিয়ে ওর মা প্রচন্ড টেনশন করলো এবং শেষে ব্যয়বহুল সার্জারী করালো। অথচ সেটা এতই সাধারণ ছিলো যা চোখেই পড়েনা।
স্যামুয়েলের পূর্বে জীম কখনই কোনো বাচ্চার কাছে যায়নি। মানুষের বাচ্চা কেমন হয়, কেমন তাদের আবেগ সেসব সম্পর্কে সে কিছুই জানতো না,অথচ জীমের বয়স ৫৭। এই বাচ্চাটা একেবারেই ছোট থেকে এখানে আসে। আর ধীরে ধীরে জীম বাচ্চাটার প্রতি মায়া বাড়াতে থাকে। প্রথমে কাছে যেতনা,পরে যাওয়া শুরু করে, আর এখন স্যামুয়েল ছাড়া সে কিছু বোঝেনা। স্যামুয়েল আসলে সব কাজ রেখে তার সাথে খেলা করে।
জীম অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট একজন ছাত্র ছিলো। পরে সে এক ভালো কেমিস্ট হয়। এলাকার একটা বিশাল কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিতে সে জব করত। কিন্তু ওই কোম্পানীটি দেউলিয়া হয়ে যায়,সে জব হারায়। পরে সে অলসতার কারনে জব খোঁজেনি। এখন যে জব করে তা সে পছন্দ করেনা। লোকটা এক সময় খুব গোছালো ছিলো্ কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে। সেই মেয়ে তার সাথে প্রতারণা করে অন্যের কাছে যায়। জীম খুবই সহজ সরল আর উদার মনের। কিন্তু মেয়েটার প্রতারণা তাকে প্রবলভাবে হতাশ করে দেয়। সে এমন লোক ছিলোনা যে অন্য মেয়ের কাছে যাবে। আর তার জীবনটাও অন্য রকম।
জীমের বাপ-মা কে, তা জীম জানেনা। খুব ছোটবেলায় এক দম্পতি তাকে দত্তক গ্রহন করে। দত্তক পিতা-মাতাকেই আপন করে নেয়। কিন্তু সেই ছোটবেলায়ই তার মানসিকতার উপর চরম একটা আঘাত আসে। তার পিতা-মাতার মোট সন্তান ছিলো ৭টা। জীম ছিলো সকলের ছোট। কোনো এক কারনে জীমের পিতা-মাতা সিদ্ধান্ত গ্রহন করে যে, ছোট ছেলে জীমকে তারা পালন করবে না। তারা তার অন্য ৬টি ভাই-বোনকে লালন পালন করে আর জীমকে দত্তক দেয়। এ বিষয়টি তাকে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে অতন্ত নেতিবাচক ধারনার জন্ম দেয়। জীবনে কখনই সে তার পিতা-মাতার সাথে দেখা করেনি এবং কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। অপরদিকে তার পিতা-মাতাও তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেনি। দত্তক পিতা-মাতাকে ছেড়ে সে অনেক আগে থেকেই একা থাকতে অভ্যন্ত ছিলো। আর এরপর প্রেমিকা দিল ধোকা। সব মিলিয়ে সে নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এক সময় শুনতে পায়, তার বাপ-মা মারা গেছে। এরপর তার দত্তক পিতা-মাতাও মারা যায় ,সেও অনেক আগের কথা। তার কাজিনও মারা যায়। তার রক্তের সম্পর্কের কাওকে সে চিনেনা। চেনার চেষ্টাও করেনা, তাদেরকে চেনার গুরুত্ব অনুধাবন করেনা।
জীম ছিলো একা,সাথে একটি কুকুর। স্যামুয়েলের পূর্বে আমি তার কাছাকাছি আসি। সে অনেক খারাপ আচরণ করেছে কিন্তু আমি ছিলাম চরম ধৈর্য্যশীল। তার খারাপ আচরনের বিনিময়ে অতিরিক্ত ভালো আচরণ করেছি। ফলে সে আমাকে আপন মনে করে,বিশ্বাস করে। এরপর স্যামুয়েল আসলো, এই বালককে নিয়েই সে মেতে থাকে।
একটি পরিবার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমেরিকায় না আসলে বোধহয় বোঝা যাবেনা। একটা শিশুর চিন্তা ভাবনা থাকে অদ্ভূত ধরনের। সে যখন পিতা-মাতার ভালোবাসা বঞ্চিত হয়, তখন তার বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক হয়না। কিছু বিষয় পয়সা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় না, সেটা হল আপনজনের ভালোবাসা। আমেরিকাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে, এর অনেক ভালো দিক রয়েছে কিন্তু খারাপ দিকও অনেক এবং কখনও কখনও তা খুব মারাত্মক। বহু লোক সন্তান গ্রহন করবে না, এমন সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তবে বহু লোক যারা সন্তান গ্রহন করেছে, নিজের একান্ত স্বাধীনতা উপভোগের কারনে তারা কখনও কখনও সেই সন্তানকে অন্যের কাছে ছেড়ে দেয়। আবার কখনও আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারনে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়,নেশায় আসক্ত হওয়ার কারনেও সেটা তৈরী হয়। তবে সেই সব সন্তানদের একটা অংশ দূর্বলভাবে বেড়ে ওঠে,অন্ত:সার শূণ্য অবস্থায় বেড়ে ওঠে। অনেকের ভেতর নানান বিকৃতির জন্ম হয়। এমনকি কখনও কখনও তারা চরম হিংসাত্মক হয়ে বড় অপরাধ ঘটিয়ে ফেলে। আমেরিকাতে যতগুলো শিশু আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের উপর গুলি বর্ষণ করেছে, তার বেশীরভাগেরই পারবারিক জটিল সমস্যা ছিলো।
একটা শিশুর মানসিক সুন্দর বিকাশে সুন্দর পরিবার প্রয়োজন রয়েছে। অকৃত্তিম ভালোবাসা আর সুন্দর গাইডলাইন দরকার রয়েছে। পৃথিবীতে উন্নত,আধুনিক হিসেবে পরিচিত অনেক সমাজের ভেতরে জটিল সব সমস্যা তৈরী হয়ে রয়েছে, আধুনিকতা গ্রহনের নামে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সেসবও আমদানী করেছে,করছে। যা কিছু কল্যানকর,তা যে কোনো স্থান থেকে গ্রহন করা যায়, কিন্তু সেটা বুঝতে যে উপলব্দী দরকার সেটা সঠিকভাবে জাগ্রত হচ্ছেনা।
বিষয়: বিবিধ
১০৫৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন