ব্রেভ হার্ট
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১০:০০:৫৯ রাত
ওসমান ইবনে মাযউন
------------------------
মক্কায় যখন মুসলিমদের উপর প্রবল নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো এবং কাওকে কাওকে হত্যাও করা হয়েছে, তখন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে রসূল(সাঃ) কিছু সাহাবীকে হাবশায় হিজরত করতে বললেন। প্রথম দলে ছিলো ১২জন পুরুষ এবং ৫জন নারী। হাবশা বা আবিসিনিয়ার শাসক বা নাজ্জাশীর নাম ছিল আসহুমা। তিনি ছিলেন খুবই ন্যায়পরায়ন বাদশাহ এবং সে সময় যে কজন খ্রিস্টান একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। তিনি আসমানী কিতাবের জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। তার অনুমতিতে মুসলিমদের ছোট দলটি সেখানে বসবাস করতে থাকে।
কিছুকাল পর মুসলিম গ্রুপের কাছে একটি গুজব পৌঁছে যে, মক্কার মুশরিকরা রসূল(সাঃ)কে মেনে নিয়েছে,সকলে মুসলিম হয়ে গেছে। তখন তাদের মনে মাতৃভূমীর প্রতি মায়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা স্থায়ীভাবে মক্কায় বসবাসের জন্যে আবার ফিরে আসে। কিন্তু মক্কার উপকন্ঠে পৌছে জানতে পারে,খবরটি ছিলো মিথ্যা। যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মত না হওয়াতে তাদের পক্ষে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে গুজবটির পেছনে এক চমকপ্রদ ঘটনা ছিলো।
একদিন রসূল(সাঃ) ক্কাবার চত্তরে সূরা আন নাজম তিলাওয়াত করছিলেন। রসূল(সাঃ)এর তিলাওয়াত এতটাই মধুর হত যে, কখনও কখনও রাতে তার তিলাওয়াত শোনার নেশায় মক্কার কাফির নেতারা অন্ধকারে তার ঘরের পেছনে চুপি চুপি দাড়িয়ে থাকত। তো, যখন তিনি ক্কাবা চত্তরে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন, তখন ওই সূরার ভেতর সেজদাহর আয়াত পড়ার পর তিনি(সাঃ) হঠাৎ সেজদাহ প্রদান করেন। আর তিলাওয়াতে বিভোর হয়ে থাকা লোকেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রসূলের(সাঃ) সাথে সাথে সেজদা দেয়। সেখানে মক্কার প্রধান প্রধান নেতারা উপস্থিত ছিলো এবং সেজদাহ দেয়। এই বিষয়টি নিয়ে পরে গুজব তৈরী হয় এবং সেই গুজবের কারনে হাবশা থেকে হিজরতকারী প্রথম দল ফিরে আসে। এদের ভেতর ওসমান ইবনে মাযউন(রাঃ) ছিলেন।
ওসমান ইবনে মাযউন(রাঃ) ছিলেন বানু মাখযুমের লোক। আর এই গোত্রে গোত্রপতি ছিলো হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের পিতা আল ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবি। বানু মাখযুম কুরাইশদের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়টি দেখাশোনা করত। ফিরে আসা মুসলিমরা একটা ট্রাপে পড়ে যায়। তারা আবারও নির্যাতিত হতে থাকে। সে সময় কোনো প্রতিষ্ঠিত গোত্রের সম্মানিত কেউ কারো নিরাপত্তা দিলে তাকে মেনে চলা মানুষেরা তার ক্ষতি করত না। আরবের জাহেলদের বেশ কিছু উঁচু মানের গুন ছিলো, এর একটি হল তারা ওয়াদা পালন করত এবং এক্ষেত্রে খুব কঠোর ছিলো। যদি মুখ দিয়ে বলে ফেলত এই লোককে নিরাপত্তা দিলাম, তবে তার ক্ষতি করত না।
উসমান ইবনে মাযউন সম্পর্কে আল ওয়ালিদের ভাগিনা হতেন। ওসমান তার কাছে নিজের নিরাপত্তার গ্যারান্টি চাইলে ওয়ালিদ ক্কাবা চত্তরে ঘোষনা করেন যে, একে আমি নিরাপত্তা দিয়েছি। সকলে তখন বলে, আমরাও নিরাপত্তা দিলাম। যদিও তারা তার শত্রু কিন্তু আল ওয়ালিদের সম্মানে তাকে কেউ নির্যাতন করেনি। গোপনেও ক্ষতি করেনি। আরবের জাহেলদের ভয়াবহ কিছু ভালো বৈশিষ্টের কারনে এরা পরবর্তীতে ইসলামে প্রবেশ করে অত্যন্ত উচুঁ দরের মানুষে পরিনত হয়।
কিন্তু যেসব লোকেরা মক্কার বাইরে থেকে এসে মক্কায় ছিলো,সেসব নও মুসলিমদের উপর অত্যাচার চলতে থাকে। উসমান ইবনে মাযউন সেসব নির্যাতন দেখতেন এবং ব্যথীত হতেন এই ভেবে যে, আমি নিরাপত্তায় রয়েছি কিন্তু আমার ভায়েরা নির্যাতিত হচ্ছে ! একদিন তিনি আল ওয়ালিদকে বললেন, আমার উপর থেকে নিরাপত্তা উঠিয়ে নিন, আমার মুসলিম ভাইদের সাথে আমিও অত্যাচারিত হতে চাই কিছুই যখন করতে পারছি না, ওদের কষ্ট সহ্য করতে পারছি না, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আল ওয়ালিদের নিষেধও শুনলেন না তিনি।
এরপর একদিন যখন আরবের শ্রেষ্ঠ কবি লবীদ আমন্ত্রিত হয়ে আসলো আসরে কবিতা শোনানোর জন্যে, তখন আল ওয়ালিদ গেলেন সেখানে। উল্লেখ্য: কবি লবীদ হল সেই কবি, যখন রসূল(সাঃ) আল্লাহর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে পুরো আরবকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, যদি আল কুরআন মানুষের বানানো হয়ে থাকে, তবে তোমরা এর সূরার মত আরেকটা সূরা তৈরী করে আনো, ছোট সূরা আল কাওসারের মত একটা সূরা তৈরী করো। এই ঘোষনায় কবি,সাহিত্যিকরা কিছুই পারেনি, তবে কবি লবীদ লিখেছিলেন:
"ইন্না আ-তায়না ক্কাল কাওসার
ফাসাল্লি লি রাব্বিকা ওয়ানহার
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার"
এরপর লবিদ ছন্দ মিল রেখে লেখে-
"লায়সা ক্কালামিল হাজামিন বাশার"
(এই বানী কোনো মানুষের তৈরী নয়)
লবিদ পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহন করেন কিন্তু সে সময় তিনি মর্যাদাশীল কবি হিসেবে আসরে এসেছিলেন। সেই সময় আল ওয়ালিদ ইপস্থি হয়ে ঘোষনা করে যে, ওসমানের দাবী অনুযায়ী তার উপর থেকে নিরাপত্তা তুলে নিলাম। সকলেও নিরাপত্তা তুলে নেয়। এরপর লবিদ একটা কবিতা আবৃত্তি করে যার প্রথম অংশের অর্থ হল...." আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু আছে সবই তুচ্ছাতিতুচ্ছ...." সঙ্গে সঙ্গে উসমান ইবনে মাযউন বলে ওঠেন, আপনি খুব দারুন কথা বলেছেন, খুবই সত্যি,,আসলেই তাই...। এরপর কবি লবীদ কবিতার বাকী অংশ আবৃত্তি করে, যার মানে ছিলো...."কিন্তু সকল সুখ সুবিধা যা আল্লাহর কাছে আছে , সবকিছু শেষ হয়ে যাবে....। "
এটা শুনে উসমান বলে ওঠেন, আপনি ভুল বলেছেন,মিথ্যা বলেছেন, আল্লাহর জান্নাতের সকল নিয়ামত হবে চীরদিনের জন্যে, মানুষেরা সেখানে চীরদিন থাকবে। তার এই কথায় লবিদ আহত হল এবং রাগান্বিত হল। কারন সে সম্মানিত কবি এবং আমন্ত্রিত অতিথী। সম্মিলিত জনতা উসমান ইবনে মাযউনকে চরম নির্যাতন করলো এবং তার এক চোখ প্রচন্ড ফুলে উঠলো এবং কালো হয়ে গেল।
ঘটনা শুনে আল ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা বললেন, তুমি ভুল করেছো, এখনও সময় আছে তুমি আমার নিরাপত্তা বলয়ে এসো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তখন উসমান ইবনে মাযউন বলেন--"না বরং আমি চাই আমার অপর চোখটিও ওটার মত মর্যাদাবান হোক, আমি সত্য অবশ্যই প্রকাশ করব"
যদিও এভাবে জোর করে নিজের উপর অত্যাচার চাপিয়ে নেওয়ার অনুমতি নেই, কিন্তু তার বিবেকবোধ তাকে এটা করতে বাধ্য করেছিলো। চোখের সামনে ঘটা মুসলিমদের উপর অমানসিক নির্যাতন দেখে তিনি সহ্য করতে পারেননি। নিজে অত্যাচারিত হয়েছেন কিন্তিু সত্য বলা থেকে বিরত থাকেননি। আর শেষ পর্যন্ত সত্যেরই বিজয় হয়।
উল্লেখ্য: উসমান ইবনে মাযউন(রাঃ) তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান(রাঃ) নন, তিনি হলেন উসমান ইববে আফফান। সম্ভবত ইসমান ইবনে মাযউন বদরের যুদ্ধে শহীদ হন। বদরের শহীদরা আল্লাহর কাছে অত্যধিক মর্যাদাপূর্ণ শহীদ।
বিষয়: বিবিধ
৭২৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন