জায়েদ বিন হারিসা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:৩৪:২৮ রাত
জায়েদ ইবনে হারিসা ছিলেন ইয়েমেনের শিশু। তার পিতা ছিলেন স্বচ্ছল,সম্মানিত ব্যক্তি। তার পিতার প্রতি তার আত্মীয়দের কোনো কারনে ক্রোধ ছিলো, আর সে কারনে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে তারা জায়েদকে কিডন্যাপ করে মক্কার উকাজ মেলায় দাস হিসেবে বিক্রী করে। মা খাদীজা(রাঃ) এর পক্ষ থেকে তার নিজস্ব লোক তাকে ক্রয় করে। সে খাদীজার গৃহে লালিত পালিত হয়। যদিও সে সময় দাস/দাসীর সাথে সুআচরণ করা হতনা, কিন্তু কিছু কিছু সজ্জন লোকও ছিলো যারা সুআচরণ করত। খাদীজার(রাঃ) বিয়ের পর উপহার হিসেবে জায়েদকে দাস স্বরূপ রসূল(সাঃ)কে তিনি উপহার দেন। জায়েেদের বয়স ছিলো ৭ অথবা ৮।
জায়েদ নামে দাস হলেও রসূল(সাঃ) তাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। পিতার মত আচরণ করতেন,ভালোবাসতেন। জায়েদ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রসূল(সাঃ) কখনই আমাকে কোনো ব্যাপারে বলেননি যে, এটা এরকম কেন করলে, বা এটা কেন এমন হলোনা।..... মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসায় সিক্ত ছিলো জায়েদ।
ওদিকে জায়েদের পিতা-মাতা পুত্রশোকে পাগলপ্রায় অবস্থা। জায়েদের পিতা তার পুত্রের বর্ণনা দিয়ে চারিদিকে খোজ লাগায়। নিজে সকল জনসমাবেশে গমন করে জায়েদের বর্ণনা দিয়ে তাকে খুজে দিতে বলে,পুরষ্কার ঘোষনা করে। কিছুকাল পর ইয়েমেনের এক লোক মক্কায় হজ্জ(পূর্বেও হজ্জ ছিলো কিন্তু নিয়ম কানুনের ভেতর জাহেলীয়া প্রবেশ করেছিলো) ও ব্যবসার গমন করে। লোকটি মক্কায় বালক জায়েদকে দেখে সন্দেহ করে, কারন তার চেহারা আরবের এ অংশের লোকদের মত ছিলোনা। সে তখন জায়েদের সাথে কথা বলে এবং বুঝতে পারে এই সেই ছেলে যাকে তার পিতা খুজছে। ওই লোকটি ফিরে গিয়ে যায়েদের পিতাকে বলে, তোমার পুত্রকে দেখেছি ,সে এখন মুহাম্মদ বিন আব্দুল মুত্তালিবের অধীনে রয়েছে।
জায়েদের পিতা হারীসা অনেক টাকা বা মুদ্রা জমা করলেন এবং তার ভাইকে সাথে নিয়ে মক্কায় গমন করলেন। তিনি দেখলেন কাবা চত্তরে মুহাম্মদ(সাঃ....তিনি তখন নবী ছিলেন না)অবস্থান করছেন। তার কাছে যায়েদের পিতা দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জায়েদের কথা জানতে চাইলেন। জায়েদকে ডাকা হল। জায়েদর পিতা হারীসা রসূল(সাঃ)কে বললেন আমি আপনাকে এই পরিমান অর্থ দিচ্ছি, আনি জায়েদকে মুক্তি দিন। কিন্তু রসূল(সাঃ) বললেন, জায়েদ তো মুক্ত। কিন্তু এ পর্যায়ে রসূল(সাঃ) জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, জায়েদ যেতে চায় কি না সেটা জায়েদ নিজেই বলুক। ঐতিহাসিকরা বলেন, দীর্ঘ সময় জায়েদকে পিতৃ স্নেহে লালন করার কারনে রসূল(সাঃ)এর মনে জায়েদের প্রতি প্রবল ভালোবাসা জন্মায়,যার কারনে জায়েদকে চলে যেতে তিনি আদেশ করেননি। কিন্তু জয়েদ তার পিতা ও চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, উনি আমাকে যে ভালোবাসা ও অধিকার দিয়েছেন তা আমার পিতা ও চাচার সম্মিলিতভালোবাসা ও অধিকারের চেয়ে বেশী। আমি উনাকে ছেড়ে যাবনা। হারীসা তার সন্তানকে বিনয়,ভালোবাসা,অধিকারের সাথে বলেন যে তুমি দাস, তোমার অধিকার নেই, কিন্তু তুমি আমার কাছে পাবে উত্তম জীবন। তোমার জন্যে সবকিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু জায়েদ তার সিন্ধান্তে অনড় থাকে। সেখানে অনেক কথোপকথন হয় কিন্তু জায়েদ কোনোভাবেই মুহাম্মদ(সাঃ)কে ছেড়ে যেতে চায়না।
তখন জায়েদের পিতা ও ভাই ফেরত যেতে উদ্যত হয়। এ পর্যায়ে রসূল(সাঃ) কাবার উচুঁ চত্তরে দাড়িয়ে লোকদেরকে ডাকে। লোকেরা আসলে ,তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন যে, আজ থেকে জায়েদ আমার পুত্রে সে দাস নয়, আজ থেকে সে জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ, সে মুক্ত, তোমরা সাক্ষী থাকো। এই ঘোষনায় জায়েদের পিতা,চাচা খুশী হয়। সম্ভবত এটা এই কারনে রসূল(সাঃ)করেন, যাতে ব্যথিক পিতা তার নিজের মনে শান্তনা খুজে পায় যে, তাদের পুত্র ভালো থাকবে ও আছে। জায়েদের পিতা-মাতার ব্যাপারে বিস্তারিত এখনও জানিনি, তবে পরবর্তী কালের ঘটনায় সেটা আসতে পারে।
হাদীসে এসেছে জায়েদের জন্যে কিছু কাজ নির্ধারিত ছিলো, কিন্তু রসূল(সাঃ) নিজের নির্ধারিত কাজ করার রও জায়েদের কাজটাও কখনও কখনও করে দিতেন বা সাহায্য করতেন। ওমর(রাঃ)এর পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমর, বলেন যে, আমি ৩০ বছর ধরে জায়েদকে চিনতাম এবং ছেলেটার নাম জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ বলেই জানতাম। জায়েদ ইবনে হারীসা জানতাম না। সূরা আল আহযাবের আয়াত অবর্তীর্ণ হওয়ার পরই বুঝতে পারি। আলকুরআনে কোনো সাহাবীর নাম নেওয়া হয়নি, তবে একমাত্র জায়েদের নাম এসেছে।
জায়েদ যখন বয়োঃপ্রাপ্ত হয় তখন মা আমীনার রেখে যাওয়া দাসী উম্মে আয়মানের সাথে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। জায়েদের চেয়ে উম্মে আয়মন অন্তত ২০ বছরের সিনিয়র ছিলেন। জায়েদের একটি পুত্র হয় যার নাম রাখেন রসূল(সাঃ) উসামা। এই উসামাকে আল্লাহর রসূল(সাঃ) অত্যধীক ভালোবাসতেন।
রোমানদের সাথে তাবুকের যুদ্ধে হযরত জায়েদ ছিলেন সেনাপতি। বাহিনী প্রেরন কালে রসূল(সাঃ)বলেন, সেনপতি হবে জায়েদ, যদি তার কিছু হয়ে যায়, তবে সেনাপতি হবে জাফর বিন আবু তালিব(হযরত আলীর ভাই), তার কিছু হয়ে গেলে সেনাপতি হবে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা,,,,এরপর তোমরা বিবেচনা করে সেননাপতি নির্ধারন করবে। তার এই কথার অর্থ ছিলো এরা সবাই শহীদ হবেন। জায়েদ এই যুদ্ধে শহীদ হন, এবং উপরোক্ত সাহাবীগনও। এরপর সাহাবীরা হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদকে সেনাপতি নির্বাচিত করেন। তখন খালিদ কেবল মাত্র ৩ মাস হয় ইসলামে প্রবেশ করেছেন। ওখান থেকেই খালীদের(রাঃ) শুরু। এরপর রোম-পারশ্য তিনি পদানত করেন। জীবনে ১২৫টি যুদ্ধের প্রত্যেকটাতেই তিনি বিজয়ী। তাকেই সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সেনাপতি বলা হয়....খালিদ সাইফুল্লাহ !
রসূল(সাঃ) তার শেষ জীবনের শেষ সেনা অভিযানে সেনাপতি নির্বাচিত করেন জায়েদের পুত্র ওসামাকে। রসূলের(সাঃ)ওফাতের পর আবু বকরের(রাঃ) শাসনামলে ওসামার সেনাপতিত্বে সৈন্য প্রেরন করা হয়। তখন ওমর(রাঃ) আবু বকরের(রাঃ) হাত ধরে বলেন, ওসামার বয়স মাত্র ১৬ বছর, আপনি অন্য কোনো অভিজ্ঞ সেনাপতিকে পাঠান। আবু বরকর(রাঃ)বলেন, আল্লাহর রসূল(সাঃ) তাকে নির্বাচন করেছেন, আমার কি সাধ্য তাকে রুখি। ওমর(রাঃ) খ্যান্ত হন।
হযরত ওমর(রাঃ) এর শাসনামলে তার সন্তান আব্দুল্লাহ(কমান্ডার) তাকে বলেন, হে আমার পিতা, সেনাবাহিনীতে আপনি আমার বেতন জায়েদের পুত্র ওসামার অর্ধেক কেন করলেন ? দুজন তো একই রাঙ্কের লোক ! ওমর(রাঃ) বলেন কারন হল আল্লাহর রসূল(সাঃ) উসামাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন, তাই আমরাও তাকে অত্যধিক ভালোবাসি। আর উসামার পিতাকে(জায়েদ) আল্লাহর রসূল(সাঃ) তোমার পিতার(স্বয়ং ওমর) চাইতেও বেশী ভালোবাসতেন। ফলে যা পাচ্ছ সন্তুষ্ট থাকো। সাহাবীদের চরিত্র ছিলো এমন যে, আল্লাহর রসূলকে তারা প্রানের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন এবং রসূল(সাঃ) যা কিছু ভালোবাসতেন, তা তারাও ভালোবাসতেন।
বিষয়: বিবিধ
৮৫৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন