ছোটবেলার সেই দিনগুলো
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ০৯:৫৫:০৫ সকাল
ছোটবেলায় শীতকালে সবচেয়ে আকর্ষনীয় জিনিস ছিলো খেজুরের রস। খেজুরের রসের ভেতর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হল দেইড়ো গাছের জিড়েন রস। দেইড়ো গাছ মানে হল বয়ষ্ক ও মোটাতাজা গাছ। আর জিড়েন রস মানে হল পরিচ্ছন্ন লাল টকটকে রঙের রস। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের বেশীরভাগ লোকই জীবনে সেই রস চোখে দেখা দূরে থাক, কানেও শোনেনি। এটা আসলেই সহসা দেখা মেলা ভার। ভালো মানের গাছি দরকার হয় সেই রস পেতে। দেইড়ো গাছ ২ সপ্তাহ অন্তর কাটতে হয় বিশেষ কায়দায়। তবেই সেই রস পাওয়া যায়। আবার দেশের সকল অঞ্চলের গাছ থেকে তা পাওয়া যায় না। কেবল যশোর,ফরিদপুর,মাগুরা,কুষ্টিয়া আরও দু একটি এলাকায় এটা পাওয়া যায়। জিড়েন রসের গুড় থেকে যে পাটালী পাওয়া যায়, তার নাম নলেন পাটালী। এই পাটালীর ঘ্রান দূর থেকে পাওয়া যায়। এখনকার জেনারেশন এসব কথা কানেও শোনেনি। আমরা ছোটবেলায় এসব খেয়েছি।
মামু বাড়ির খেজুরের রস ছিলো সবচেয়ে উত্তম। মামুদের হাজারের উপর খেজুর গাছ ছিলো। শীতকালে গেলে সকালে দেখতাম গাছি আর মামাতো ভায়েরা মিলে শত শত ভাড় খেজুরের রস নিয়ে আসছে। এর ভেতর থেকে সবচেয়ে ভালোটা বা জিড়েন রসটা আলাদা করে রাখা হত আমাদের জন্যে। সে রসের যে কি স্বাদ রে...। আমরা মুড়ি দিয়ে খেতাম। গ্লাসে রস নিয়ে উপরের খালি অংশে মুড়ি ঢালতাম। রস আর মুড়ি কুচুরমুচুর করে খেতাম। গ্লাস ঘালি হতে থাকলে আবার মুড়ি,আবার রস দিয়ে পূর্ণ করতাম। মুড়ি ছিলো বাড়িতে ভাজা। এভাবে আমরা ৪/৫ গ্লাস খেয়ে ফেলতাম। শীতের দিনে মুড়ি ভাজাও ছিলো আরেক উৎস্যব।
রসের পিঠা ছিলো আমার দুনিয়ার মান্না-সালওয়া। এত বেশি পছন্দ করতাম যে কি আর বলব। মা বানাতো অসাধারণ কাচিফোঁড়া পিঠে। এটাকে চিতোই পিঠা বলে। গরম চিতোই পিঠে হাতে নিয়ে ফু দিয়ে হাত পুড়ে যেত,কারন এর ভেতর অনেক সংখ্যক ফুটো থাকে যা দিয়ে বাষ্প বের হয়। আব্বা বলত, সে নাকি ছোটবেলায় গরম কাচিফোঁড়া পিঠে কারো হাতে রেখে জোরে ফু দিত, এতে সে গেলাম-মলাম করে উঠত, আর তখন আব্বা সেই পিঠে তুলে নিয়ে দৌড়.....। বলাই বাহুল্য, এ কাজ আমিও করেছি। যাইহোক খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করত। এটাকে বলে তাতরস। এর ভেতর নারকেল কোরা আবার কখনও একটু দুধও দিত। এরপর কাচিফোঁড়া পিঠে তাতরসের ভেতর দিত। সকাল ভোরে উঠে যখন সেই পিঠে প্লেটে নিতাম, দেখতাম রসে টৈটুম্বুর অবস্থা। এত দারুন লাগত রে পাগলা ! ওহ....মনে হচ্ছে এখন খাচ্ছি !!
আমাদের গাছ ছিলো হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা। আমার দাদারা দুই ভাই এবং উভয়ের সম্পত্তি একসাথেই ছিলো। ফলে তাদের গাছ মানে আমাদের সকলেরই গাছ। এলাকার মুঞ্জুর চাচা ছিলো গাছি। সে আরও অনেকের গাছ কাটত। যেহেতু গাছ ছিলো অল্প আর খেজুর গাছ নিয়মিত কাটা যায়না, তাই আমরা নিয়মিত রস খেতে পেতাম না। বাড়ির পেছনে অবস্থিত ফজিলা ফুফুদের বাড়িতে মাঝে মাঝে রস খাওয়া যেত,ওদের বেশী গাছ ছিলো। মুঞ্জুর চাচা যেদিন রস দিত, সেদিন মনের ভেতর ব্যপক আনন্দ খেলা করত। সে সময়ে খেজুরের রস খুব একটা কেনা বেচা হতনা। কারন প্রায় সকলেরই আশপাশে রস থাকত। আর মামুদের এলাকায় তো জানতোই না যে খেজুরের রস বিক্রী হয়। ওরা জানত গুড় বিক্রী হয়। মামুদের বাড়ির সামনের রাস্তার ওপাশে ছিলো বিশাল কাঠাল বাগান। সেখানে শতাধিক কাঠাল গাছ ছিলো এবং সেসব কাঠাল ছিলো বিখ্যাত। সেই কাঠাল বাগানের বিশাল উঠোনে বড় বড় জালা চড়ানো হত। শত শত ভাড় রস সেসব জালা বা কড়াইতে ঢালা হত। দীর্ঘক্ষন জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো হত।
মাঝে মাঝে আত্মীয়দের বাড়ি যেমন রোহিতা ও কাশিপুরে গেলে খেজুরের রস খেতাম আযান দিয়ে। এসব এলাকায় খেজুরের রস ছিলো বিখ্যাত। মেঝো ফুফুদের বাড়ির রস ছিলো অতি উৎকৃষ্ট।
ছোটবেলায় আমরা মাঠের খেজুর বাগানে দলবেধে যেতাম,আর পাটকাঠি দিয়ে রসের ভাড় থেকে রস খেতাম। গাছিরা ভোরে রস পেড়ে,আরেকটা ভাড় গাছে চড়িয়ে দিত। সেই রস দুপুর নাগাদ বেশ খানিকটা হত। কখনও কখনও উলা রস বা অনেকটা পচা রসও খেয়ে ওয়াক ওয়াক করতাম। সন্ধ্যা রসও ছিলো খুব প্রিয়। মামু বাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা রস খাওয়ার একটা উৎসব ছিলো। তখন মামুরা ছোলার চাষ করত। কাচা ছোলার গাছ তুলে এনে খেজুর গাছের ফাতরা দিয়ে পুড়াতাম। ওই এলাকায় এটাকে বলে ছুলাহুড়া। ওইটা যে কি মজা ! ছোলা পুড়িয়ে খেতে খুব মজা। ওটা আমরা সন্ধ্যা রস ঝেড়ে এনে খেতাম। হাতে এ্যালুমিনিয়ামের কলস অথবা মাটির ভাড় থাকত, প্রত্যেক ভালো গাছ থেকে একটু একটু করে রস এনে তাতে ঢালা হত। এরপর ছুলা পুড়িয়ে তার সাথে খেতাম আর কত রকমের যে খেলাধুলা করে আনন্দ উপভোগ করতাম তা বলার মত না।
ছোটবেলায় দেখতাম কাটাখালি,পদ্মপুকুর এসব এলাকা থেকে কিছু লোক সাইকেলের সাথে অনেকগুলো রসের ভাড় বেধে নিয়ে এলাকায় বিক্রী করত। সম্ভবত প্রতিভাড় ছিলো ৬/৭ টাকা। এরপর ইটের ভাটার প্রচলন শুরু হল। যেহেতু খেজুর গাছের কোনো মুল্য নেই তাই বিশাল সাইজের খেজুরগাছগুলো লোকেরা মাত্র ৬০/৭০ টাকায় বিক্রী করে ইটের ভাটায় দিত। এরপর দেখলাম খেজুরের রসের ভাড় ১০টাকা। তারপর দেখলাম ২০ টাকা প্রতি ভাড়। তখনও সন্ধ্যা রাতে ১টাকা গ্লাস রস পাওয়া যেত। এরপর বাড়তেই থাকলো। রসের গ্লাসের সাইজ ছোট হতে থাকল। তারপর প্রতি ভাড় দেখলাম ৫০ টাকা,এরপর ১০০ টাকা। ইটের ভাটা বাড়তে থাকল,খেজুর গাছ পুড়তে থাকল। এখন শুনি মানুষ ২০০/৩০০/৫০০ টাকা দিয়ে খেজুরের রস কেনার জন্যে শীতের দিনে নানান স্থানে দাড়িয়ে থাকে,কেউ পায়,কেউ পায়না। অনেক গাছিকে আগেই পয়সা দেয়। প্রচুর চাহিদার কারনে শুনেছি খেজুরের রস নাকি কেমিকেলস দিয়েও বানায়। আমরা খেজুরগাছকে তুচ্ছজ্ঞান করেছি, অথচ এর যে ডিমান্ড তা আচ করতে পারিনি,ফলে তার মূল্য দিচ্ছি। এ ছিলো এক বিশাল সম্পদ। আগে বাজারে খেজুরের গুড়ের কেজী দেখেছি ১৫ টাকা আর চিনি ছিলো ৩০ টাকা। খেজুরের গুড়কে তখন মানুষ মূল্য দিতনা। এখন খেজুরের গুড়ের কেজী ২০০টাকা আর চিনির দাম এর অর্ধেক। বাজারের প্রায় সকল খেজুরের গুড়ে চিনি মেশানো থাকে। আমার মনে হয়, কারো যদি ১০০০ গাছ থাকে,তবে সে ধনী হয়ে যাবে এক শীতেই। সাদা চিনি হল বিষ, কিন্তু খাটি খেজুরের গুড়ে রয়েছে পুষ্টি। আমরা পুষ্টি বাদ দিয়ে বিষ বেছে নিয়েছি। মূর্খতা আমাদের জীবন থেকে জীবন কেড়ে নিয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
৭৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন