লস্ট লেক
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৯ জুন, ২০১৯, ০১:২৭:৩১ দুপুর
দূরবর্তী স্থানে প্রত্যেকটা প্লান করার আগে বেশ ভাবতে হয়, কারন একটা পরিকল্পনাকে সফল করতে অনেকগুলো কাজ একের পর এক করা লাগে। রোজার মধ্যেই লস্ট লেকের প্লান করলাম। স্থানটা অসাধারণ। লস্ট লেক হল মাউন্ট হুড থেকে ১৬ কি:মি: উত্তর-পশ্চিমে। মাউন্ট হুড হল ওরেগনের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ,যার উচ্চতা ১১২৫০ ফুট। লস্ট লেক তৈরী হয়েছে আগ্নেয়গিরী থেকে লাভা উদগীরনের ফলে সৃষ্ট একটি ফাঁকা স্থানে। পর্বতের বরফ গলা পানি,বৃষ্টি এর পানির উৎস্য। লেকটার উচ্চতা ৩১৪৬ ফুট। এ হল অসাধারণ সৌন্দর্য্যের আধার। লেকের পানি স্বচ্ছ টলমলে। লেকের চারিদিকে বিশাল ফার গাছের বনভূমী। লেকের চারিপাশে পায়ে হাটার পথ রয়েছে,তবে কোথাও কোথাও বেশ দূর্গম।
লস্ট লেকে কিছু লগ হাউস,লজ রয়েছে রাত যাপনের জন্যে কিন্তু গত ৪/৫ মাস আগে থেকেই সেগুলো মানুষ দখল করে ফেলেছে। যদিও এখানকার প্রতিরাতের ভাড়া প্রচুর,তারপরও এটা ফাঁকা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে টাকা মানুষের কাছে কোনো ব্যাপার না। তবে আমার কাছে এটা অবশ্যই একটা ব্যাপার। আমি এখান থেকে ১ ঘন্টা ড্রাইভের দূরত্বে একটি অসাধারণ ক্যাম্প গ্রাউন্ডে মোটর হোম পাকিং স্পেস নিলাম ১ রাতের জন্যে। তুলনামূলক এটা সস্তা মনে হলেও আদলেই তেমন সস্তা না। কারন মোটর হোম যেই পরিমান তেল খায়,তা দিয়ে ভালো হোটেলে থাকা যায়,কিন্তু এর ভিন্ন রকম সুবিধা রয়েছে। এটা একটা পুরো বাড়ির মত, ফলে অনেক কিছু সঙ্গে নিয়ে ঘোরা যায়।
ঈদের খুশীর আরেকটা অংশ ছিলো এই ভ্রমন। খুব সকালে বাদ ফজর সকল সাজ সরঞ্জাম নিয়ে রওনা হলাম হাইওয়ে ৫ বরাবর। পোর্টল্যান্ডের ভেতর দিয়ে হাইওয়ে ৮৪ ধরে এগিয়ে গেলাম কলাম্বিয়া রিভার গর্জ এলাকায়। অসাধারণ মনোরম এলাকাসমূহ পার হয়ে হুড রিভার আসলাম। এখান থেকে লস্ট লেক ড্রাইভ ধরে এগিয়ে পথ হারালাম। জিপিএস থেকে নির্দেশনা নিয়ে পথ চলা অনেক সময় বেশ কষ্টকর হয়,বিশেষ করে যখন দ্রুত রাস্তা বদল করার প্রয়োজন হয়। রাস্তা ভুল করে মাউন্ট হুড ভ্যালীর আপেল ক্ষেতের রাস্তায় আসলাম। ওরেগনে এই এলাকার আপেল বিখ্যাত। মাইলের পর মাইল আপেল ও অন্যান্য ফলের বাগান। খুবই সুন্দর সেসব বাগান। এর ভেতর দিয়ে আনন্দের সাথেই পথ চললাম। খানিক পর আমার কাঙ্খিত রাস্তা পেলাম,তবে অনেক দূর ঘুরে।
সরু ও মসৃন রাস্তা ধরে পর্বতের উচ্চ শিখরের দিকে এগিয়ে চললাম। উপরের দিকে ওঠার সময় বড় গাড়ি ঢকঢক করে তেল খায়। প্রতি লিটারে মাত্র ২ মাইল যায় এই হাতি। তবে তেল খরচের হিসাব মাথায় রাখলে ঘোরাঘুরি হয়না,তাই ভুলে গেলাম। পিচপিচে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তা ভেজা। ৩০ মিনিট চলার পর মাউন্ট হুড ফরেস্টের 'লস্ট লেক' ক্যাম্প গ্রাউন্ডে প্রবেশ করলাম। ৯ ডলারে ডে টাইম পাস(সূর্য্যদয় থেকে স্যূর্যাস্ত পর্যন্ত) গ্রহন করে পার্ক করলাম ভেতরে। এবার ধরব মাছ, খাব আরামে। সাথে মশলাপাতি সব এনেছি। সাথে বিশেষ নাইফও আছে। মাছ তেড়িবেড়ী করলে জীবন হরন করে সাথে নিয়ে আসব। একহাত সাইজের একটা পেলেই চলবে। বেশী ধরলে তো অনেক সময় ধরে ধ্যান করতে হবে, অত ধৈর্য্য আমার নেই।
এখানে খুব ঠান্ডা। চারিদিকে কুয়াশার মত। লেকের ওপাশে ভালো দেখা যাচ্ছেনা। আমি হাটতে থাকলাম,চারিদিকটা দেখার জন্যে। লেকের ধারে গেলাম। অনেকগুলো বোটরাম্প রয়েছে এখানে,যেদিক দিয়ে নৌযানগুলো পানিতে নামানো হয়। ঘাটে দেখলাম ছোট,মাঝারি,ক্ষুদ্র নানান সাইজের হস্তচালিত নৌকা। এগুলো ঘন্টাভিত্তিক ভাড়া নেওয়া যায়। মাছ ধরার নৌকাগুলোতে ৪/৫ জন বসতে পারে,সেগুলো ঘন্টায় ২৮ ডলার, বাকীগুলো ঘন্টায় ২০ ডলার। একেবারে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ছোট নৌকা রয়েছে,খুব সুন্দর। পুরো পরিবেশটা অসাধারণ।
লেকের চারিদিকে সবুজ পাহাড়ী বনভূমী। লেকের পানি স্বচ্ছ। এই ঠান্ডায়ও দেখলাম অনেকে শীতের পোষাক পরে মাছ শিকার করছে। ঘাটের উপর একটা ঘরে লাইফ জ্যাকেট ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে। এই লেকে সামারে মানুষ সাতার কাটে। জুলাই এর শেষ ও আগস্ট থেকে এই পানির তাপমাত্রা উষ্ণ হয়ে ওঠে। আমি উপরের দিকের জেনারেল স্টোরে প্রবেশ করলাম। এটা একটা রেস্টুরেন্টও। খুব দারুন করে বানানো এটা। গাছের বড় বড় গুড়ি দিয়ে ভেতরে বাইরে দৃষ্টিনন্দন বসার স্থান বানানো হয়েছে। লোকেরা দেখলাম নাস্তা করছে। আমি ব্রেড কিনলাম, সাথে চিজ,ডিম এসব ছিলো। সকালে ডিম স্যান্ডুইচ বানায় খেলাম।
জীবনে প্রথমবার ফিশিংপোলে মাছ ধরব। ইউটিউবে দেখেছি কিভাবে বর্শী বাধে,ভারী সিসা বাধে,সাথে ববারস যা ভেসে থাকে সেটা বাধার কৌশলও শিখলাম। তবে এখানে মোবাইলের কোনো নেটওয়ার্ক নেই, ফলে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার সাথে রয়েছে অন্তত ৭/৮ রকমের ও সাইজের বর্শী, নানান রকম ও সাইজের মাছ ধরার জন্যে। কিছু বর্শী আছে যাতে মাছের খাবার বাধতে হয়না। এটা ফেলে রিলটা গোছাতে হয় ,কাছে আসলে আবারও দূরে নিক্ষেপ করে টেনে আনতে হয়। এর সাথে এক ধরনের ফেদার থাকে,যাতে মাছ আকৃষ্ট হয়ে কামুড় দেয়। আমার সাথে ৩ রকমের মাছের খাবার আছে। এগুলো মাছকে আকৃষ্ট করে কামুড় দিতে। স্যামন মাছের ডিমও আছে,এটা মাছেদের প্রিয় খাবার। সবই রেডী এবার বর্শী বাঁধার পালা।
যন্ত্রপাতি বের করলাম। বর্শীর সাথে সূতা বাধা থাকে, এটা মূল রশির সাথে বাধলেই চলে। আমি বাধলাম। এই বর্শীটার ৩ মাথা। ৩টা মাথা ৩ দিকে করা। মাছ কামুড় দিয়ে পালাতে পারবে না। এবার বর্শীর উপরের অংশে ভারী সিসার বল চাপ দিয়ে লাগানোর সময় বর্শী নাড়া খেয়ে আমার টিশার্টে গিয়ে বিধে গেল। সে যে কি অবস্থা রে.....। এত টানাটানি করলাম তাও খুললো না। ভাবলাম কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলি ! তবে তা না করে টানাটানি করতেই থাকলাম। বেশী জোর দিতে পারছিলাম না,কারন হাতে ফোটার সম্ভাবনা রয়েছে। এবার হ্যাচকা টানে বর্শী ছাড়াতে গিয়ে দেখী বর্শীর আরেক মাথাও টিশার্টে বিধেছে, ল্যাও ঠেলা ! সেই মাথা ছাড়ালাম, এমাথাও ছাড়ালাম কিন্তু টিশার্ট ছিড়ে। এবার সিসার উপরের অংশে ববারস, যা পানির উপর ভেসে থাকে,সেটার হুকের সাথে ফিট করতে গিয়ে বর্শী গিয়ে আবার বিধলো টিশার্টে। আবারও টেনে ছিড়লাম। বাইরে খুব ঠান্ডা, জ্যাকেট গায়ে দিলাম। এবার বর্শী গিয়ে বিধলো আমার জ্যাকেটের হাতায়, টেনে ছিড়লাম।
মাছের সাত সকালের নাস্তা এবং সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে ট্রেইল ধরে পানির দিকে এগিয়ে চললাম। লেকের পাশ দিয়ে পায়ে হাটা রাস্তার কোথাও কোথাও সুদৃশ্য সেতু তৈরী করা হয়েছে কাঠ দিয়ে। কোথাও কোথাও বসার স্থান এবং সাথে বারবিকিউ তৈরীর স্থান। মানুষ মাছ ধরে এখানে বারবিকিউ করে খায়। আজ আমিও খাব ইনশাআল্লাহ !
ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে একটা সুন্দর স্থান বেছে নিলাম। কমলা কালারের খাবার বাধলাম মাছের জন্যে। মনে হচ্ছিলো এখানকার মাছেদের প্রিয় রং কমলা, কারন এরা সবুজ রং তো জন্ম থেকেই দেখে। সূতা ঢিল করে বিশেষ কায়দায় জীবনে প্রথম বার বর্শী ছুড়লাম......। কিন্তু এ কি ! শালার বর্শী গিয়ে পড়লো আমার থেকে ৩ হাত দূরে হাটু পানিতে,অথচ ছোড়া সময় দূরে তাকিয়ে ভাবছিলাম অতদূর গিয়ে এটি পড়বে। আবার তুললাম, কিন্তু ছিপের মাথায় সূতা পেচিয়ে গেল। অনেক কষ্টে সেটা ঠিক করলাম। এবার আমি প্রস্তুত। ছিপ ফেললাম দূরে। তবে ততটা দূরে গেলনা,কিন্তু আমি সন্তুষ্ট। এবার শুরু হল টান্ডা বাতাস। বাতাসে আমি কাপছি,অথচ গায়ে মোটা জ্যাকেট,এর নীচে আরও ৩টি স্তর। বাতাসে আমার ববারস ভাসতে ভাসতে আমার পায়ের কাছে চলে আসলো। আমি সূতা গুছানোর সময় আবারও তা পেচিয়ে গেল। ওদিকে খাবারও খুলে পড়ে গেছে। সূতাটা খুবই চিকন আর স্বচ্ছ,ভালো করে ধরাও যায় না। তবুও অনেক কষ্টে ছাড়ালাম। নতুন খাবার বাধলাম। এবার বর্শী ছুড়লাম, কিন্তু বর্শীর মাথা থেকে ববারস খুলে পড়ে গেল পানিতে। টেনে আনলাম, সূতা প্যাচ খেয়ে জড়ায় গেল,মোটেও সোজা হলনা। বহু কষ্টে ঠিক করে অন্য আরেক রকমের ববারস বাধলাম। আবার ছুড়লাম,এবার সীসা খুলে পড়ে গেল,আবার গোছালাম,সূতায় কয়েকটা গিট পড়ে গেল। আমার ধৈর্য্যের বাধে ইতিমধ্যেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, আমি পানি মেরে যাচ্ছি আনমনে।
ভাবছিলাম , আচ্ছা মাছ খাওয়া কি এতই জরুরী ! কিনে খেলেই তো হয়,, আরেক মন বললো এরকম তাজা মাছ তো আর পাবিনা কোথাও, ফ্রোজেন মাছ,মরা মাছ খেতে হবে। আবারও লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো,তাছাড়া অনেক টাকায় লাইসেন্স কিনেছি। এবার বর্শীতে খাবার বেধে সবকিছু ঠিকঠাক চেক করে জোরছে বর্শী নিক্ষেপ করলাম দূরে বহুদূরে.......। বুঝলাম মাছের কপাল সবার থাকেনা। শালার বর্শী,সিসা,খাবার,ববারস সব সহ ছিপের মাথা থেকে খুলে পানিয়ে গিয়ে পড়ল। আমি সূতা পেচিয়ে খানিকক্ষন পানির দিকে তাকিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। মন আমার ফুরফুরে। আসলে মাছ পেলে তো সেটার আঁশ ছাড়াতে হত,কাটতে হত, ভাজতে হত....কত ঝামেলা(মনকে বুঝ দিলাম) ! আল্লাহ বাঁচায় দিয়েছে....এটা চিন্তা করতে করতে চলে আসলাম।
ফরুফুরে মনে চরম একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখী দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। দিনের বেলা এত বেশী ঘুমাইনি বহু বছর। বিকেলে দেখী চারিদিকে রৌদ্র ঝলমল অবস্থা। বেশ উষ্ণ পরিবেশ। লেকের দিকে হাটলাম। লেকের শুরুর অংশে একটি কাঠের ব্রিজ আছে, সেটা দিয়ে ওপাশে গেলাম। এত সুন্দর দৃশ্য ভাবাও যায় না। মনে হচ্ছিলো পবিত্র মহান আল্লাহ সৌন্দর্য্য সব ঢেলে দিয়েছেন এখানে। আল্লাহ পৃথিবী ভ্রমন করতে বলেছেন। আসলে ভ্রমন করলে আল্লাহর প্রশংসা না করে পারা যায় না,শুধু অবাক হতে হয় সুন্দরসব সৃষ্টি দেখে। সমু্দ্র সমতলের বহু উঁচুতে এত সুন্দর ঝকঝকে পরিবেশে চলমলে পানির সুন্দর লেক, এ কি ভাবা যায় ! বহু মানুষকে দেখলাম নানান ধরনের নৌকা চালাচ্ছে পানিতে। অনেকে বারবিকিউ পার্টি করছে। অনেকে তীরে দাড়িয়ে মাছ ধরছে। এক চায়নিজ পরিবারকে দেখলাম এক হাত লম্বা অনেকগুলো মাছ ধরেছে অল্প সময়ের ভেতর। দেখে মনটা খাই খাই করে উঠলো, তবে আবেগের গলায় পা দিয়ে চেপে ধরলাম। বুনো ট্রেইল ধরে অনেকদূর পর্যন্ত ভ্রমন করে হুড রিভার সিটিতে এসে ডিনার করলাম এক থাই রেস্টুরেন্টে।
এরপর ক্যাসকেড লক ফরেস্টের ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পার্ক করে এখন চিৎ হয়ে পড়ে আছি। মাছ খাওয়া আমার হলনা, তবে কাল ইনশাআল্লাহ আবার চেষ্টা করব। হাল আমি ছাড়ব না ।
বিষয়: বিবিধ
৬৩১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন