ঈদ ২০১৯

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৬ জুন, ২০১৯, ১২:০৫:২০ দুপুর

আসেন আজকের ঈদের গল্প করি। বাচ্চারা চারিপাশে গোল হয়ে বসো। বড়রা দাড়ায় থাকেন, কারন যেই টানা টেনেছেন বসতে বলাটাই এখন অভদ্রতা,ব্রাকেডে পদাঘাত। আর বুড়োদের সম্মানে চেয়ার ছেড়ে দিলাম। বুড়োরা হল সমাজের মুরগী,মুরব্বী আর মুরগীর বসার ভেতর ইহজাগতিক কল্যান(ডিম,বাচ্চা) রয়েছে।

এবার ঈদের চান বাবাজি যেই খেল দেখালোরে বাবা, অনুমান করছিলাম ঈদের উপর এর প্রভাব পড়বেই, পড়লোও তাই। গভীর রাতে চন্দ্র দর্শন হল। বহু বছর পূর্বে একবার রাত ১১টায় বিটিভিতে চাঁদ দেখা গিয়েছিলো। ততক্ষনে লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছিলো এবং দোকানদাররাও বাড়ি চলে গিয়েছিলো। মনে আছে বিটিভির কথায় লোকেরা বিছানায় লাথি মেরে উঠে শপিং করতে দৌড়, আমরাও সেই দলে ছিলাম। গিয়ে দেখলাম অনেক দোকানদার পূণরায় ফিরে এসেছে দোকান খোলার জন্যে। আমরা আবার চাঁদ রাতে কেনাকাটা পছন্দ করতাম। মনে থাকত অনাবিল,অনাখাল,অনানদী আনন্দ। হৃদয় থাকত উৎফুল্য।

সেই দিনগুলো মরে গেছে, যাইহোক এবার চাঁদ নিয়ে মারামারির জেরে লোকেরা অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে ঈদ পালন করেছে। এই সুযোগে অনেকের দুটো ঈদ হয়ে গেছে। রোজা শেষ হবার সময় দুরকম অনুভূতি ছিলো। একমনে ভাবছিলাম রহমত বরকত সব চলে গেল, খারাপ লাগছিলো, আরেকমনে ভাবছিলাম, যাক এবার দিনের বেলা খেতে পারব। দীর্ঘ দিনের রোজার কষ্টটাই এর কারন। আজ আমার কাজের দিন ছিলো কিন্তু ছুটি নিলাম। গতকাল রাত থেকেই কম কম খাবার খেয়েছি, বুঝতেই পারছেন কেন।

আজ সকাল ভোরে বিয়ের পাঞ্জাবীটা পরে রেডী হলাম। মাথায় পাগড়ী বাধলাম আমার স্টাইলে। এবার এভেরী পার্কে গেলাম। গিয়ে দেখী মাত্র দুটি আদম সন্তান উপস্থিত। আদী পিতা হযরত আদম(আঃ)এর সূত্রে ভাই বলে ঝাপিয়ে পড়লাম। ওরা সাউন্ড সিস্টেম ঠিক করছিলো। মাঠে মোটা প্লাস্টিক কভার বিছালো। আমি কাতার সোজা করার জন্যে দড়ি ফিট করলাম। দু মাথায় দুটো করে লোহার স্টিকের সাথে লম্বা লম্বা দড়ি বাঁধলাম। কিন্তু আমার দড়ির রং হুবহু নীচে পাতা মাদুরের রঙের মত,ফলে বহু লোক বসার সময় দড়ি খেয়াল না করে লন্ডভন্ড করার চেষ্টা করেছে। অনেকে ঠ্যাংয়ে জড়িয়ে বিব্রত হয়েছে। তবে কাতার ছিলো সোজা। এ কাজে বুড়োভাই আলী সাহায্য করলো,পরে এক তরুন এসেছিলো কিন্তু সে একেবারেই নবীন,আনাড়ী। তারপরও আমাদের সকলের সওয়াব সমান হোক , সওয়াব প্রদানের মালিক আমাদের মত না। Happy

ধীরে ধীরে লোকজন আসতে শুরু করলো। হুজুরসমূহ মোছাহাফা করল। এভারগ্রীন রেস্টুরেন্ট থেকে গাড়ি ভর্তি খাবার আসলো। বিভিন্ন লোকেরাও তাদের রান্না বান্না নিয়ে আসতে লাগল। হৃদয় আমার নেচে উঠলো, কিন্তু দমন করলাম,যদিও আজ আমার হাত আল্লাহর আইনের হাতে বাঁধা নয়। ক্রমাগত তাকবীর বলতে থাকলাম,সকলেই বলছিলো। আমাদের কাতার হয়েছিলো ৬টা এবং প্রত্যেক কাতারে ৮০/১০০ লোক হবে অনুমান করলাম। এর পেছনে একটু দূরে মহিলাদের কাতার ছিলো। ইমাম খুৎবা প্রদান করলেন। খুৎবার আগে ইমাম সাহেব আবু দাউদ শরীফ থেকে একটি সহি হাদীস বর্ণনা করলেন, সেখানে রসূল(সাঃ) বলছেন, ঈদের খুৎবা যার ইচ্ছা হয় শুনবে,যার ইচ্ছা হয় সে চলে যাবে। ঈদের খুৎবা হয় ঈদ সালাতের পরে। অনেক শিক্ষার্থীর পরিক্ষা চলছে যার কারনে তিনি এটা উল্লেখ করলেন। দেশে শুনেছিলাম ওই খুৎবা না শুনলে নামাজই হবেনা। দেশী হুজুরদের পাওয়ার,জজবা বেশী। তারা ইলমের পাশাপাশি শরীরের শক্তি দিয়েও কথা বলেন।

নামাজে খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু যেখানে দাড়িয়েছিলাম তার তলদেশে একটি শুকনো ডাল পড়ে ছিলো আড়াআড়ি,ওই জিনিসটা জ্বালিয়েছে। নামাজ থেকে সকলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে জড়িয়ে ধরলো। কি যে প্রশান্তি লাগল ! অন্তত ৩জন খতিব আমাকে অক্টোপাসের মত ধরলো কোলাকুলির জন্যে। ছোট বড় সকলেই আগ্রহসহকারে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করছিলো। দেশী ভায়েরা ৩বার, আরব ভায়েরা ১ বার, অন্যরা ২বার করে বুক মেলাচ্ছিলো। তবে আমি বাঙ্গালী, কাওকে ছেড়ে কথা বলিনি। অন্যদের সাথে তারা একবার করুক আর দুবার করুক, আমার বুকে তিনবার করে ঠোকাঠুকি করেছে তারা। তবে আরব ভাই গুলো কোলাকুলি করার সময় অনেক দোয়া পড়ে, যেমন আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন,বরকত দান করুন,তোমার ইবাদতসমূহ কবুল করুন আরও অনেক....আমি শুধু আমিন আমিন,জাজাকাল্লাহ এসব বলে পার করেছি।

ঈদমাঠে বরাবরের মত এক আরব পরিবার আসলেন। মনে হয় অরিজিন জর্ডান। এক পিতা,যিনি প্যারালাইজড এবং আরও অনেক সমস্যা আছে। কথা বলতে পারেন না। উনার হাত পা কিছুই চলে না তেমন, আর দুহাতের আঙ্গুলও বাঁকা, পা'গুলো অতি চিকন ও অকেজো। কিন্তু লোকটা ভাগ্যবান বটে। হয়ত যৌবনে এক অতি পরহেজগার বৌ যোগাড় করেছিলেন। আল্লাহর রসূল(সাঃ) বলেন, দুনিয়াতে সর্বোচ্চ উপভোগের জিনিস হল উত্তম স্ত্রী। ....যার উত্তম স্ত্রী আছে,প্রশান্তি তার থাকতে বাধ্য। আল্লাহ লোকটির পরিবারে রহমত ঢেলে দেন। লোকটার বেশ কিছু উত্তম সন্তান রয়েছে। তারা এবং তার স্ত্রী সর্বদা তার দেখাশুনা করে। তার সন্তানরা বার বার তার মাথায় হাত বুলায়, মুখ পরিষ্কার করে দেয়,চুমু খায় কিন্তু এসবে বৃদ্ধের চোখ ছলছল করে ওঠেনা। এর কারন আছে, আমরা যখন এসব দৃশ্য প্রথম প্রথম দেখী তখন আমাদের চোখ ছলছল করে,আর কোনো পিতা-মাতা যখন সন্তানের থেকে প্রথম প্রথম এরকম সেবা পায় তখনও তারা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে, কিন্তু যখন ২৪ ঘন্টা তারা এরকম জান্নাতি সার্ভিস পায়,তখন এটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিনত হয়ে পড়ে। এই পরিবারটির উপর আল্লাহ রহমত আর বরকত ঢেলে দিক,তাদেরকে অসহ্য নিয়ামত দান করুন। আমি ওই লোকটির গায়ে অনেকবার হাত দিয়ে ইশারায় সালাম দিয়েছি,অনেক দোয়া করেছি। লোকটার কোনো নেক আমলের কারনে আল্লাহ হয়ত তাকে সম্মান দিয়েছেন,যদিও তার শক্তি তিনি কেড়ে নিয়ে কঠিন পরিক্ষা চপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু লোকটা ভাগ্যবান, সে তো পাপ করার যোগ্যতাও হারিয়েছে,ফলে তার যা আছে তার সবই জান্নাতের জন্যে জমা, তাকে আমার জান্নাতি লোক মনে হয়, আল্লাহ কবুল করুন !

নামাজ শেষে সকলে খাবারের স্থানে গেল সারিবদ্ধভাবে। বিশাল এলাকা জুড়ে ২টা শেড আছে,পিকনিক টেবিল আছে অনেক,মানুষ খেল, আমি খেলাম না, কারন আছে।

প্রফেসর সাহেব দাওয়াত করেছিলেন। এটা উম্মুক্ত দাওয়াত বাঙ্গালী কমিউনিটির জন্যে। উনাদের বাসার খাবার আমার খুব প্রিয়। আসলে বাঙ্গালী পরিবারের যেকোনো রান্নাই আমার প্রিয়। প্রফেসর মাহফুজ স্যার অমায়িক মানুষ। আমি গেলাম সেখানে। টেবিলে খাবার দেখে মনে হল গায়ে তেল মেখে লাফ দেই,যা থাকে কপালে। কিন্তু ভদ্রলোক আমি, তাছাড়া বেশ রিস্ক হয়ে যায়,ক্ষ্যান্ত দিলাম। একপাশে গরু ও খাসির হালিম ছিলো। আমি ছাগলের উপর আমার নখ বসালাম,তাকে পরাভূত করলাম। গরুর হালিমের উপর ঝটিকা আক্রমন চালাবো কিনা ভাবছিলাম,কিন্তু এমনেই আমি গরুখোর,নিয়মিত খাই। আজকের এই শুভ দিনে হালিমসমেত গরু রেহাই পেল, কিন্তু তার বংশের শেষ রক্ষা হলনা। টেবিলে ভূনা গরু,গরুর কিমা ভূনা,মুরগীর নানান আইটেম আমার পদস্খলন ঘটালো। আমি চীর উন্নত মমশীর স্টাইলে আগ্রাসন চালালাম। সম্ভবত: প্রফেসর সাহেব বিষয়টা আচ করতে পারলেন, উনি পেপার প্লেট ডাবল করে নিতে বললেন,যাতে তা অধিক শক্তিশালী হয়। আলহামদুলিল্লাহ,খাবারের যা স্বাদ ! জান্নাতি অবস্থা। আমি মাত্র ৩বার নিলাম। পেটে তখনও কিছু এলাকা অনাবাদী থেকে গেছে, মিস্টি দিয়ে আবাদ শুরু করলাম। রসমালাই,চমচম,সেমাই,পায়েস,গোলাপজাম অসহ্য কারবার। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খাবারে ভরে উঠলো। সাথে ছিলো নানান রকম পানীয়,চা ইত্যাদী। শেষে খাবারের উপর গোলাপজল ছেটানোর মত করে চা ছড়িয়ে এ পর্ব ক্ষ্যান্ত করলাম। সকলে মিলে ক্রিকেট খেলা দেখছিলো, আমিও খাবারের মাথে মাথে টিভির দিকে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু বহু বছর পূর্বেই কিছু অভ্যাস বনবাসে পাঠিয়েছি, তার একটি হল মিউজিক শোনা, আরেকটি হল ক্রিকেট নিয়ে উত্তেজনা। এর খবরও এখন রাখিনা। এখন কে হারলো আর কে জিতলো ওসবে আর আগ্রহ পাইনা। জানতামও না যে এটা বিশ্বকাপ। দুনিয়ার বহু বিষয়ের উপর থেকে আমার মন উঠে গেছে। আর এতে আমি খুশী ও সুখী।

এক ভাই আজ সন্ধ্যায় তাদের বাসায় দাওয়াত করেছে। এই ভাইটা খুব নরম সরম ভদ্র। ওরেগনের ইতিহাসে এ ঘটনা এবারই প্রথম যে,একদিনে দুটি দাওয়াত পেয়েছি। এই ঘটনাকে শ্মরনীয় করতে আগামী ৩দিন ডাল-ভাত খাব ইনশাআল্লাহ। গতরাতে ঘুম খুব কম হওয়াতে আমার ঘুম পাচ্ছিলো বেশ। আমি কিচুক্ষন বসে অন্য অমায়িক ভাইদের থেকে বিদায় গ্রহন করলাম। ঈদ, তাই পেটের ভেতর আজ চরম আনন্দ খেলা করছে।

বিষয়: বিবিধ

৬৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File