মা দীবসের লেখা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৩ মে, ২০১৯, ১১:৩৯:০৫ সকাল
আমার দাদা শেষ বয়সে রোগে শোকে ভূগে শয্যাশায়ী থাকেন বেশ কয়েক বছর। আমি খুবই ছোট ছিলাম, বোঝার বয়স হয়নি তখনও, কিন্তু দেখেছি আমার পিতা তার সেবা করছেন নিজ হাতে। আমার পিতা অত্যন্ত কড়া ব্যক্তিত্বের রাশভারী লোক ছিলেন। ক্ষেপে গেলে কাওকে পরোয়া করতেন না। কিন্তু জীবনেও তাকে তার পিতা-মাতার উপর উঁচু স্বরে কথা বলতে দেখিনি,শুনিওনি। তারা কোনো কথা বললে মাথা নীচু করে মেনে নিতেন এবং কখনও কিছু বলার থাকলে বিনয়ের সাথে তা বলতেন। পিতা-মাতাকে খেদমত করা ভাগ্যের ব্যাপার আর সেক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভাগ্যবান।
দাদা মারা যাবার পর আমার দাদী শয্যাশায়ী হন এবং সে সময় শাশুড়ী হিসেবে আমার মায়ের সেবা প্রদান দেখেছি। নিজ থেকে সওয়াবের আশায় দেখাশুনা করেছেন। দাদীর শেষ সময়গুলো খুব কষ্টের ছিলো। তার শরীরে পচন ধরেছিলো। বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে দিতেন। আর আমার মা স্বযত্নে তা পরিষ্কার করতেন।
আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে সর্বদা মাথায় তুলে রাখি,রেখেছি। সকল বিষয়ে তাদের অবস্থান সবচেয়ে উঁচুতে। আর তারাও তাদের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছেন।
এ ঘটনা শুধু আমার পিতা-মাতার নয়, এটা পুরোনো প্রায় প্রত্যেকটি বাঙ্গালী মুসলিমের। কল্পনায় আশপাশে যাদের ছবি ভেসে উঠছে তাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় দেখছি। একটা দারুন পারিবারিক বন্ধন ছিলো,যেখানে প্রত্যেকে তাদের দায়িত্ব পালনকে বাধ্যতামূলক মনে করত। খারাপ ঘটনা ঘটত কিন্তু তার পরিমান ছিলো কম। সন্তানের নতজানু অবস্থার সুযোগ পিতা-মাতা নিয়েছে, এবং তারা যুলুমও করেছে কিন্তু সেটার একটা মাত্রা ও পরিমান ছিলো এবং সামাজিক শৃঙ্খলাও ছিলো।
বৃদ্ধাশ্রমের চিন্তা তখন আসেননি, প্রয়োজনও হয়নি। আধুনিক সমাজ ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তায় বিভোর করেছে। তার জীবন যাপনের কনসেপ্ট,সামাজিকতা,পারিবারিক দায়িত্ববোধ সকল কিছুর উপর ব্যক্তি স্বার্থকে তুলে ধরেছে। এটাকে নানান রঙে প্রমোট করেছে দশকের পর দশক। তার হাত থেকে সবুজ গ্রাম কেড়ে নিয়ে শহুরে ইট-পাথর তুলে দিয়েছে। ফলে মাটির সাথে তার যে নরম-কোমল সম্পর্ক ছিলো সেটার স্থলে শক্ত কংক্রিট জায়গা করে নিয়েছে। উদ্ভাবনী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উৎপাদনমুখী কর্মে প্রবলভাবে আত্মনিয়োগ না করে সে হয়েছে উদ্ভাবকদের চাকর। জীবনের চাকচিক্যের নেশায় সে উদয়-অস্ত গোলামী করে যা উপার্জন করেছে তার ভেতর আত্মতৃপ্তী পায়নি। এখন সে অনুভব করে তার সেই পূর্বের সাদামাটা সহজ সরল জীবনটাই অধিক মূল্যবান ছিলো,যেখানে ছিলো হাসি,আনন্দ। পরষ্পর পরষ্পরের সহচর্য্যে বাঁচার ভেতর ছিলো পরিপূর্ণতা। কিন্তু লাভ নেই, পেছনে ফেরার পথ নেই। কারন পদ্ধতিগতভাবে সে এতদূর চলে এসেছে যেখান থেকে মন চাইলেও পেছনে ফেরা যায়না। আর পদ্ধতি পরিবর্তনে যে সময়,মানসিকতা প্রয়োজন, তা তার হাতে নেই এবং সেটি এখন আর কিছু সংখ্যক লোকের হাতেও নয়। সম্মিলিতভাবে সকলে ভিন্ন পথে হেটে বিভ্রান্তির সীমায় পৌঁছে হাবুডুবু খাচ্ছে। অবস্থা এমন আকার ধারন করেছে যে, বিদেশীরা তো তাও কিছু কিছু উৎস্যবে,উপলক্ষে পিতা-মাতাকে শ্মরণ করে, কিন্তু বাঙ্গালী মুসলিমদের বিশাল একটা অংশ সেটাও করতে পারেনা। এরা রোবট হয়ে উঠেছে।
এই জেনারেশনের বেশীরভাগেরই অথনৈতিক সামর্থ্য নেই,আবার এদের পিতা-মাতারাও পরনির্ভরশীল। ফলে এদের পিতা-মাতার কপালে বৃদ্ধাশ্রমও জুটছে না এবং সামনে আরও জুটবে না। এ কারনেই আনকালচারড জেনারেশন চরম দায় ঠেকে অথবা সবকিছুকে অর্থনৈতির পাল্লায় মেপে পিতা-মাতাকে আরও বেশী পরিমানে দূরে ঠেলে দিয়ে শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করবে। এখনকার পরিবার,সমাজ,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,সুশীল সমাজ সকল স্থান থেকে এরকম শিক্ষাই তারা পাচ্ছে।
উন্নত বিশ্বের লোকেদের মা দীবস আর আমাদের মা দীবস কখনই এক হবেনা। কারন তারা তাদের একটি কালচারে নিজেদেরকে শত শত বছর ধরে অভ্যস্ত করেছে ফেলেছে এবং সেখানে অনেকগুলো ভালো দিক রয়েছে। তাদের পিতা-মাতা স্বাবলম্বী, রাষ্ট্র তাদেরকে দেখাশুনা করে। সন্তানের উপর অর্থনৈতিকভাবে তারা নির্ভরশীল নয়। তাদের জীবন খুবই মসৃণ আর যথেষ্ট দূর্ভাবনা মুক্ত। তারা পিতা-মাতা থেকে দূরে থাকলেও যোগাযোগ রাখে এবং মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ করে। উৎস্যবে প্রবল আনন্দ করে তাদের সাথে। কিন্তু আমাদের জীবন চলে উৎকন্ঠায়,অর্থনৈতিক চিন্তায়, অপরদিকে রয়েছে বিশ্বাসের সাথে আচরনের প্রবল পার্থক্য। ব্যক্তির বিশ্বাসকে রাষ্ট্র,সমাজ পাত্তা না দিয়ে এমন আচরণ,আইন,কানুন,বিধী বিধান প্রয়োগ করেছে যা ব্যক্তি সমষ্টি মানতে বাধ্য হয় কিন্তু পছন্দ করেনা। চিন্তা ও বাস্তবতার এই মারাত্মক টানাপোড়েনে কোনো জাতি এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হয়না। ফলে এই সামাজিক জীবগুলো ইসলামিক বিশ্বাস নিয়ে চরম অনৈসলামিক কাজে বাধ্য হয় পদ্ধতিগত ভাবে। সে নি:স্ব,সর্বহারায় রূপান্তরিত হয়।
আর এই অবস্থায় সে পরিবারকে হারায়, পারিবারিক ও আত্মীয়তার বন্ধন শিথীল করতে থাকে। এমনকি পিতা-মাতাকে অন্ন ধ্বংকারী যন্ত্র হিসেবে মনে করতে থাকে। অনেকে স্রেফ লোকে কি বলবে, এটাকে বিবেচনায় রেখে পিতা-মাতাকে মেনে নেয়, আর অনেকে নষ্টামীর চূড়ায় উঠে তাদেরকে বের করে দেয়। যে অংশটি এখনও লোক লজ্জাকে ভয় করছে, মহান সুশীল সমাজ ও বিদেশী শত্রুদের প্ররোচনায় সেই লোক লজ্জাটাও উঠে গেলে ওরা পিতা-মাতাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ছুড়ে দেবে। মুসলিমদের বীচ নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে,যাতে ইসলামিক নামে আগাছা বেড়ে ওঠে।
যদি সন্তানকে সুশিক্ষা না দেওয়া হয়, যদি ওরা আল্লাহর ভয়ে পিতা-মাতকে সম্মান ভালোবাসা না দেয়, যদি ওরা এটাকে নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে পালন না করে, তবে অপেক্ষা করেন চরম ধ্বংস দেখার জন্যে। তখন মা দীবসও থাকবে না।
বিষয়: বিবিধ
৬৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন