সঙ্গীতের বিনোদন!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৭ মার্চ, ২০১৯, ১১:৫২:১০ সকাল
---------------------
বিনোদনের কথা উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নাচ,গান,নাটক,সিনেমা,পিকনিক,ঘোরাঘুরি ইত্যাদী বিষয়। বিনোদন হিসেবে সঙ্গীত বহু প্রাচীনকাল থেকেই একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এটি মস্তিষ্কে বিশেষ অনুরোনন তৈরী করে আমাদেরকে আনন্দিত করে অথবা আমাদের আবেগের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক তৈরী করে আবেগকে বিশেষভাবে প্রবাহিত করে। সুখ এবং দু:খ উভয় অনুভূতিই সৃষ্টি করে,বর্ধিত করে সঙ্গীত এবং উভয় ভাবেই আমাদেরকে ভাবের সাগরে নিক্ষেপ করে। বিনোদন হল সেই ভাবেরই নাম।
এবার কিছু ভিন্ন রকম কথা বলব। আমি আগে প্রচুর গান শুনতাম এবং গান গাইতামও। অনেকবার নানান অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মানুষকে বিনোদন প্রদান করেছি এবং এরকম অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছি। আমার মোবাইলে এবং কম্পিউটারে প্রচুর বাংলা,হিন্দী গান থাকত। আমি দীর্ঘ ভ্রমনের পুরোটা পথ জুড়েই গান শুনতাম। যখনই সময় পেতাম তখনই গান শুনতাম। দেশী ও ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দী ছিলো প্রিয় গান। এর ভেতর অল্প কিছু ইংরেজী গান,বিদেশী নাশিদও ভালো লাগত। এয়ারফোন কানে গোজা থাকত। যখনই সময় পেতাম গান শুনতাম। আমি ভাবতাম সঙ্গীত ছাড়া বিনোদনই নেই।
এরপর আমি দুনিয়াতে আমার আগমনের উদ্দেশ্য,সৃষ্টির উদ্দেশ্য, আমার পরিনতি বা গন্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ শুরু করলাম। এরপর এ বিষয় নিয়ে আরও বেশী পড়াশুনা শুরু করলাম। তারপর দেখলাম আমার বিশ্বাসের সাথে আচরনের মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এরপর এক হাদীসে দেখলাম সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে গ্রহন করা হারাম। আমি ভাবলাম, আল্লাহ তার রসূলের(সাঃ) মাধ্যমে আমাদেরকে তার আদেশ শুনিয়ে দিয়েছেন, তা মানলে কি হবে, আর না মানলে কি পরিনতি হবে সেটাও জানিয়েছেন। সিদ্ধান্ত আমার।
আমি সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার সমস্ত চিন্তাকে কবর দিলাম। এরপর ধীরে ধীরে সঙ্গীতের পুরো জগৎ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম। সেখান থেকে বের হতে নিজেকে উৎসাহিত করতে গানের কথা গুলোকে বিশ্লেষন করা শুরু করলাম। খেয়াল করলাম বহু মোহনীয় সঙ্গীতের কথার ভেতর শিরকী কথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, আরও খেয়াল করলাম গানের একটা বিশাল অংশ জুড়েই বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি নানান সব আবেদন,উপমা প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এর অধিকাংশই বানোয়াট, প্রেমিক-প্রেমিকাকে খুশী করতে অবাস্তব ও মিথ্যা কথার ফুলঝুরি। ভাবতে থাকলাম এসব ভূয়া কথা যত সুন্দর সূরেই গাওয়া হোক না কেন,, এ আসলেই ভূয়া জিনিস। আবেগের স্থলে যুক্তি,বুদ্ধীকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু করলাম। এমন একটা সময়ে এই কাজটা করলাম, যখন আমি তরুন এবং বন্ধু সমাজে আমার বিশাল কদর। আমি শুধু নিজে সরে আসলাম না, বহু সংখ্যক মানুষকেও নিরুৎসাহিত করলাম। গান শোনার পরিমান কমিয়ে আমি অন্য ভালো কাজে,পড়াশুনায় সময় ব্যয় করতে থাকলাম।
আলহামদুলিল্লাহ কিছু কালের ভেতর খুব দারুন রেজাল্ট পেলাম। খেয়াল করলাম সঙ্গীত আমাকে তেমন বিনোদীত করতে পারছে না। অবাক হলাম। তারপরও কিছু প্রিয় গান বাজলেই মন আনচান করে উঠত। কিন্তু সঙ্গীতের পুরো ট্রাক থেকেই তখন দূরে। এরপর বিনোদন সম্পর্কে আমার ধারনাই পাল্টে গেল। পূর্বে ভাবতাম বিনোদন মানেই গান-বাজনা, কিন্তু পরে মনে হল এই একই কাজ অন্য কিছু বিষয়ও করতে পারে। আমি খেয়াল করলাম একজন ক্কারী কুরআন তিলাওয়াত করে যথেষ্ট মজা পায়। একজন ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী আল্লাহ,রসূলের প্রশংসামূলক গান করে বা ভালো কিছু বিষয়ে গান করে মজা লাভ করে। এসব আমাকে ভাবতে শেখালো যে, বিনোদন মানেই প্রচলিত গান নয়, বরং এটা ব্যক্তির আবেগ,বিশ্বাসের সাথে চলমান কিছু সূর মূর্ছনা,কিছু বিষয়,কিছু অনুভূতী যা তাকে আনন্দিত,পুলকিত করে, আবেগাপ্লুত করে।
কিছু তুলনামূলক বিশ্লেষণও করে দেখলাম। কোন বিনোদনটি মানুষকে বেশী আন্দোলিত করে বা আবেগতাড়িত করে বা দ্রুত গ্রাস করে ? কিছু বিষয় উপলব্ধীতে আসলো, তা হল প্রচলিত বিনোদনে মানুষের সহজাত ও দূর্দমনীয় উপাদান বা ইন্সটিংক্টকে উস্কে দেওয়া হয় বা ব্যবহার করা হয়। আর এতে মানুষ সহজেই উৎসাহিত হয়। যেমন- কোথাও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হল,যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ রয়েছে এবং প্রচলিত গানগুলো শিল্পীগন আবেদন সৃষ্টিকারী পোষাকে নেচে নেচে পরিবেশন করছে। এখানে সঙ্গীতের পাশাপাশি ইন্সটিংক্টকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন উপাদানসমূহ উম্মুক্ত থাকার কারনে মানুষের আকর্ষনের কেন্দ্রে পরিনত হওয়া স্বাভাবিক। এর বিপরীতে যদি হামদ,নাতের অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয় এবং এমন পরিবেশ রক্ষা করা হয়, যেখানে সমস্ত শরীর ঢেকে শিল্পীগণ স্টেজে এসে শুধু কন্ঠ ব্যবহার করে কিছু সুন্দর কথামালায় সাজানো সঙ্গীত পরিবেশ করবেন, তাহলে এই অবস্থাটি মানুষের মনে পবিত্র একটি অনুভূতির সৃষ্টি করবে বটে, কিন্তু তার ভেতর যৌনতার ছোয়া না থাকায় তার বিনোদন জগতে পূর্বোক্ত গানের মত তোলপাড় করা অসহ্য আবেগ তৈরী করবে না। তাকে পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানে আগমনকারী মানুষের মত আন্দোলিত করবে না। তাকে এই সূর ভালো লাগার অনুভূতি উপহার দিবে কিন্তু তার মাত্রাটি ভিন্ন রকম। কারন এখানে তাকে বিনোদনের ফিল্টার করা অংশ উপহার দেওয়া হয়েছে। তার সমস্ত আবেগের ভেতর মস্তিষ্কের বিশেষ ভালো চিন্তা সমৃদ্ধ আবেগকে বিবেচনায় এনে সে অনুযায়ী বিনোদন সাজিয়ে তা উপহার দেওয়া হয়েছে, ফলে এই বিনোদনে তার ভেতর ভালোলাগা কাজ করবে, কিন্তু সেটির ধারা সম্পুর্ণ ভিন্ন। তবে মজার ব্যাপার হল এই প্রক্রিয়াও তাকে বিনোদীত করবে,যদিও মাত্রাটি ভিন্ন ধরনের। আর এভাবে বিনোদন গ্রহনকারী মানুষের পরিমান অনেক কম।
এবার যদি কল্যানের বিষয়ে কথা বলি,তাহলে বলব, প্রচলিত মিউজিক তাকে শরীর ও মনের একটি স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে গিয়ে মজা করতে শেখায়, যা খুবই সহজাত এবং আনন্দ একেবারে অনাবিল,অবাধ। সকল সুস্থ্য মানুষই এটা পছন্দ করবে, সন্দেহ নেই। যদি বলা হত, এই বিনোদনে কোনো পাপ নেই, এবং ইসলামী সঙ্গীতে বা ভালো কিছু চর্চা করলে কোনো সওয়াব নেই,লাভ নেই, তাহলে সকলেই প্রচলিত মিউজিকেই আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করত।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই যে, যারা প্রচলিত মিউজিক থেকে সরে আসে, তারা মূলত: ভবিষ্যতের একটি কল্যানের কথা চিন্তা করে আত্মত্যাগ করে ভিন্নভাবে শান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। সে বিশ্বাস করে, আল্লাহ নিষেধ করেছেন, ফলে এমন কোনো বিষয়ে প্রবেশ করা যাবেনা,যেখানে প্রবেশ করলে আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে যৌক্তিকভাবে আখিরাতের অনন্ত সময়কে বিবেচনায় আনবে এবং সেখানে সুখী হওয়ার জন্যে দুনিয়ার কিছু সময়কে তুচ্ছজ্ঞান করে আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকবে। আর মনকে একেবারে কিছু না দিলেই নয় তাই সে বিকল্প সঙ্গীতে মন ভরানোর চেষ্টা করবে। আবার অনেকে কোনো সঙ্গীতের ধারে কাছেও যাবেনা কিন্তু তিলাওয়াতের মাধ্যমে সেই শূণ্যতা পূরন করার চেষ্টা করবে। যেহেতু তারা পণ করেছে আত্মত্যাগ করবে,এবং এর প্রাপ্তী মহা পুরষ্কার, তাই প্রচলিত সঙ্গীতে থাকতে না পারার দু:বোধও নেই তাদের, আর এখানেই প্রকৃত সফলতা। আরও মজার ব্যাপার হল আল্লাহ ধারনাতীত উৎস্য থেকে সাহায্য করে পুষিয়ে দেন। এমন কিছু ঘটে ,যা বান্দা জানত না।
যারা সঙ্গীত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে,তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তারা তাদের স্বার্থ ত্যাগ করেছে এবং এর উত্তম বিনিময় আল্লাহ প্রদান করবেন বলে বিশ্বাস করে। আর সে পুরষ্কার হবে অসম্ভব রকমের বিশাল, ফলে তাদের এ সংক্রান্ত চিন্তা দুনিয়ার বহু সহজ প্রাপ্তীকেই তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখায়। একই সাথে ভিন্ন রকমের একটি সুখানুভূতিতে ডুবিয়ে রাখে। সকল কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তাদের সাথে আছেন এবং তাদের কোনো দু:খ নেই, এই অনুভূতি তাদেরকে সত্যিই ভেতর থেকে সুখ প্রদান করে।
আর এখানেই প্রচলিত সঙ্গীতের চরম ব্যর্থতা। প্রচলিত সঙ্গীত মানুষের সহজাত আবেগকে তার মত করে প্রবাহিত করে এক আবেশ তৈরী করে। কিন্তু এই সঙ্গীত কারো অন্তরের সুখ প্রতিষ্ঠা করে দেয়না, বরং তৈরী হওয়া আবেগে উৎসাহ প্রদান করে। আবার এটি খুবই ক্ষনস্থায়ী। পক্ষান্তরে ইসলামী সঙ্গীত বা কোনো ভালো কাজ মানুষকে পুরষ্কারের নিশ্চয়তা প্রদান করে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করে, মানসিক বল সৃষ্টি করে,তাকে নিশ্চিন্ততা প্রদান করে, তাকে আল্লাহর নানান সব ওয়াদার কথা মনে করিয়ে দেয়, আর এসব বিষয় যেহেতু সে সত্য হিসেবে গ্রহন করেছে, তাই এসব বিষয় তাকে অপার্থিক প্রশান্তি প্রদান করে এবং ভেতর থেকে সুখী করে। এটি স্থায়ী অনুভূতির সৃষ্টি করে। সে কোনোভাবেই নিজেকে বঞ্চিত মনে করেনা বরং প্রবল ভাগ্যবান মনে করে। একারনে সে আল্লাহ বিরুদ্ধ একটি বিনোদনকে সহজাত হিসেবে গ্রহন না করে যেটি ত্যাগের মাধ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়,নিজেকে অভ্যস্ত করাতে হয়, সেরকম একটি বিষয়কে বিনোদন হিসেবে নিজের ভেতর প্রতিষ্ঠা করে এবং এতে সে প্রবল সুখ অনুভব করে।
আমাদের উচিৎ আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের অনুকূল কাজ করা। বিনোদনের উপকরন পছন্দে যে স্বাধীনতা রয়েছে সেটি বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে তবে গ্রহন করা। আর দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যানে আসে এমন কিছু গ্রহন করাই সফলদের কাজ,প্রকৃত কল্যানকামী মানুষের কাজ।
বিষয়: বিবিধ
৬৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন