প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০১ মার্চ, ২০১৯, ০৮:৩৫:৫০ রাত
---------------------------
আমাদের দেশে ৭০,৮০ ও ৯০ এর দশকের শুরুতে বাম চিন্তা ছিলো উন্নত চিন্তা ও প্রগতির প্রতিক। তারও আগে ভারতে এর ধাক্কা লাগে। আপনারা যারা পুরোনো দিনের ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখেছেন,,যেমন উত্তম-সূচিত্রা বা অন্যদের,, খেয়াল করবেন সেখানে স্পষ্টভাবে নৈতিকতা,সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রকে মডেল মানা হত। কম্যুনিস্টদেরকে সর্বাধিক জ্ঞানী মনে করা হত। তারা এমন সব জটিল টার্ম ব্যবহার করে মানুষের সামনে জ্ঞানগর্ভ কথা বলত যা সহজে বোধগম্য হতনা। ফলে মানুষ তাদেরকে আরও বেশী জ্ঞানী মনে করত।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোনো কালেও মানসম্মত ছিলোনা,এখনও নেই। নানান ধরনের বিক্ষিপ্ত শিক্ষা শুরু থেকেই ছিলো। আর শিক্ষার ভেতর উদ্দেশ্যগত পার্থক্য ছিলো স্পষ্ট। মাদ্রাসায় সাধারনত তারাই গমন করত যারা সমাজে সবচেয়ে তলানীতে রয়েছে বা সুবিধাবঞ্চিতরা। এখানে মেধা ছিলোনা তা নয় কিন্তু সেই মেধার কোনো সামাজিক মূল্যায়ন ছিলোনা। এখান থেকে বের হওয়া ছাত্ররা ভালো জব পেতনা,এখনও পায়না। আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে এরা সামাজিক প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্নও দেখত না। কুরআন সুন্নাহ শিক্ষা করার একটি বড় কারন ছিলো এই,যাতে কোনো মসজিদের ইমাম হতে পারে এবং অন্যের দয়ার উপর জিবীকা নির্বাহ করতে পারে। মাদ্রাসা থেকে যে অংশটি আলোকিত হয়ে বের হয়ে মানুষকে আলোর পথ দেখানোর স্বপ্ন দেখত, তাদের নানান ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিলো। সুযোগের অভাব ছিলো। ফলে আমাদের দেশের ইসলাম চর্চাকারী মানুষের সাধারন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সেভাবে হয়নি। এরা সমাজের অনেক লেভেলের মানুষের সাথে মিশতেও চাইত না,পারতও না। এর কারনে অনেক চিন্তা ,কর্ম এদের জানাও ছিলোনা।
আর এই সুযোগে বামরা সমাজে তাদের নানান সব কনসেপ্ট ছড়িয়েছে। তারা এমন সব জটিল সাবজেক্ট দাড় করিয়ে কথা বলত যে, মানুষ ঘাবড়ে যেত তাদের যুক্তিপূর্ণ কথায়। আলেম সমাজ আস্তাগফিরুল্লাহ বলে পিছু হটত। আলেম হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা সবকিছুকেই বিশ্বাসের নিরিখে মূল্যায়ন করত এবং সেখানে যুক্তি,বুদ্ধির উপস্থিতি একেবারেই কম ছিলো। অপরদিকে বামদের কাছে ছিলো শুধুই যুক্তি। আলেমরা বামদের বিষয়কে শয়তানী মনে করে দোয়া দুরুদ পড়ে কেটে পড়ত। অপরদিকে বামরা ইসলাম নিয়েও বেশ পড়াশুনা করত এবং তাদের নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ইসলামের ভুল খুঁজে বের করত বা চেষ্টা করত। এমন সব বিষয়ে এমন সব যুক্তি পেশ করত যে অনেক মানুষ নাস্তিক হয়ে যেত। আর যেহেতু সমাজের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বেশ পড়াশুনা করে এসব যুক্তি মগজে ঢুকানো লাগত, তাই তারা সমাজে বুদ্ধিমান শ্রেনী হিসেবে পরিচিত হয়।
কিন্তু ৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর কম্যুনিস্টদের মানসিক বলের প্রাবল্য কমে আসতে থাকে। আর এর কিছুকাল পর থেকে স্কুল,কলেজ,ইউনিভার্সিটিতে পড়া শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করেই ইসলাম চর্চা শুরু করে। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই একদল তরুন যুবক ইসলাম এমনভাবে বুঝতে শুরু করে যে, তারা বামদের ভেলকী ধরে ফেলে। এরপর তারা হাটে,মাঠে রাস্তাঘাটে বামদের সাথে তাদেরই তৈরী করা নানান যুক্তি ও বক্তব্যের উচিৎ জবাব দিতে শুরু করে আধুনিকতা,বিজ্ঞান,ইসলাম এসবকিছু দিয়ে। বামরা সূর নরম করতে শুরু করে। ইসলামপ্রিয় মানুষেরা ও নতুন প্রজন্মের বহু তরুন নতুনভাবে অনুপ্রানিত হতে শুরু করে। আর বামগুলো তাদের কুতর্কের হাটবাজার থেকে হটে যেতে শুরু করে।
এরপর হঠাৎই বেশ কিছু আলেম প্রকাশিত হয় এবং জনসম্মুখে চলে আসে। এরা ইসলাম এবং আধুনিক সমাজ দুটো সম্পর্কেই সুধারনা রাখে এবং মানুষকে দারুনভাবে উৎসাহিত করতে থাকে। বাপ দাদার কিচ্চা কাহিনী,পীরদের অলৌকিক ক্ষমতার বয়ান ,নিজেদের কারিশ্মা ইত্যাদী বলা কমে আসতে থাকে। শিক্ষিত তরুন-যুবকরা কুরআন ও সুন্নাহ সঠিকভাবে বুঝতে শুরু করে। এক কালের বিদাতী,শির্কী,আলেম হিসেবে পরিচিত মূর্খরা দৃশ্যপট থেকে বিদায় হতে শুরু করে। জ্ঞানের দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ে দুটি গ্রুপ, একটি হল আলোকিত মুসলিম, আপরটি হল অন্ধকারের কিট পতঙ্গ নাস্তিক,সেমী নাস্তিক,সমর্থকগোষ্ঠী।
আজকের প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ হল এরকমই একটি প্রেক্ষাপটে তৈরী। আরিফ আজাদ ভায়ের লেখা মূলত এরকমই একটি অবস্থায় একজন মুসলিমের প্রকৃত চিন্তার ধরন নিয়ে। উনি সাজিদ নামের একটি ক্যারেক্টার দাড় করিয়ে তার দ্বারা কিছু যুক্তি উপস্থাপন করিয়ে ইসলামকে নাস্তিকতার সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছুড়ে দিয়েছেন। কিছু বাস্তবতা ও কিছু কল্পনা দিয়ে উনি সঠিকভাবে ইসলামকে উপস্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এটা করতে গিয়ে কুরআন ও হাদীস উপস্থাপন করে সেটার বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়টিকে হাইলাইট করেছেন বেশী। আর এখানেই কিছু সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে, যা হওয়া অস্বভাবিক নয়।
আরিফ আজাদের উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু সকল বিষয়ে যুক্তি উপস্থাাপনকে আলেম সমাজ সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করেননি। কিন্তু আরিফ আজাদ নিজেকে আলিম হিসেবে প্রমান করারও চেষ্টা করেননি কোথাও ,আবার বিশ্বাসের বিষয়টিও কোথাও ছোট করেননি। বরং তার লেখার একটি প্রেক্ষাপট ছিলো, আর সেটা হল সমাজে প্রচলিত নানান জটিল,কঠিন ও জ্ঞানপূর্ণ মনে হওয়া কনসেপ্টসমূহ। এই বিষয়েই উনি খেদমত করতে চেয়েছেন। কারন মানুষ কুরআন-সুন্নাহ শিখতে পারবে, আলেমসমাজ শেখাতে প্রস্তুত। সে নিজেও এ বিষয়ে পড়াশুনা করতে পারবে, কিন্তু যেসব ভ্রান্ত বিশ্বাস জ্ঞান বিজ্ঞানের নামে নাস্তিকরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেসবের জবাব যদি না দেওয়া হয়, তাহলে বহু লোক কুরআন-সুন্নাহ অধ্যায়ন করার পরও বেকুফ থেকে যেতে পারে, অথবা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে আটকে থেকে ইমান হারা হতে পারে। এই বিষয়টি উনি উপলব্ধী করেই কলম ধরেছেন।
মূলত: আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তার ইবাদতের জন্যেই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। দুনিয়াতে চলার জন্যে বিধান দিয়েছেন। নবী,রসূল দ্বারা তা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়াই হল আমাদের ইমান। আল্লাহ যা বলেছেন সেটাই অধিক যুক্তিপূর্ণ এবং প্রকৃত সত্য, যদিও তা আমরা সবসময় অনুধাবন করতে পারিনা। আরিফ আজাদ বাঙ্গালীর জ্ঞানের সেই চোখকেই খুলে দিতে চেয়েছে, যা খোলা থাকলে কুরআন সুন্নাহ অধ্যায়নে আরও বেশী আস্থাশীল থাকা যায়, আরও বেশী উদ্দীপনা পাওয়া যায়, আরও বেশী শানিত করা যায় জ্ঞানের রাজ্য, সর্বোপরি একজন ভালো মুসলিম হওয়া যায়।
আমার সমালোচনা হল এই যে, আমরা কাওকে মহান করতে করতে যেন এত বেশী উপরে না নিয়ে যাই, যেখানে নিলে সমালোচনার রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। ইসলামের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই আসল,যদিও এর ভেতর উৎকৃষ্ট যুক্তি রয়েছে। কিন্তু আরিফ আজাদের লেখাগুলো একটি বিশেষ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যার কারনে স্বাভাবিক যুক্তি,বুদ্ধিকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার লেখা অসাধারণ। তার বইগুলো ইসলামের প্রসারে সহায়ক হবে বলেই বিশ্বাস করি। হীনমন্যততায় ভোগা বহু মুসলিম অনেক বেশী উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ। লেখকের জন্যে দোয়া রইলো।
বিষয়: বিবিধ
৮৮৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল লাগলো ভাই ভালোবাসা ও দোয়া রেখে গেলাম
মন্তব্য করতে লগইন করুন