পাগলী
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১০:৫৮:৪৭ সকাল
-------
বাপ-মার কথা স্পষ্ট মনে নেই, তবে ছিলো নিশ্চিত। আমি রাস্তারই সন্তান বলা যায়। ছোটবেলা থেকে তেমন কিছু মনে রাখতে পারতাম না। স্কুলে যাওয়া হয়নি কখনই। দিন দুনিয়া সম্পর্কে ধারনা খুব বেশী না। আগে এক থেকে ২০ পর্যন্ত গুনতে পারতাম, এখন কিছু মনে রাখতে পারিনা। তবে আলাদা আলাদাভাবে কিছু সংখ্যা বুঝতে পারি। টাকা চিনি , কিন্তু মাঝে মাঝে তালগোল পাকিয়ে যায়। মানুষের সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারনা না থাকলেও একটা বিষয় ভালোভাবে উপলব্ধী করি তা হল তাদের ধমক। তারা আমাকে মোটেও সহ্য করতে পারেনা।
আল্লাহর দুনিয়া সুবিশাল হলেও আমার জন্যে তা খুবই সংকীর্ণ। আমি যেখানেই যাই,সেখান থেকেই একটা আওয়াজই বরাবর ভেসে আসে-'এই পাগলী ভাগ !' আমার উপস্থিতি মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ঘৃণায় তারা যেন এলাকা ছাড়তে পারলেই বাঁচে, শেষে কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থেকে আমি চলে আসি। আমি বসি সেখানে, যেখানে মানুষের যাতায়াত কম এবং মানুষ নাক চেপে ধরে দ্রুত হেটে যায়। ওটাই আমার নিরাপদ স্থান। সেখানে কেউ এসে আমাকে অন্য কোথাও ভেগে যেতে বলেনা। আমিও কখনও জানতে চাইনা,ভেগে যাব কোথায় !!
আমি জীবনে খুব কম দিনই ভালো খাবার খেয়েছি। পেট পুরে আমি খুব কম দিনই খেতে পাই। পঁচা খাবার বেশী খাওয়া যায়না। কখনও কখনও কেউ কেউ কিছু উচ্ছিষ্ট ভালো খাবার ফেলে দেয়, সে সময় আমি সেসব লোকেদের জন্যে প্রান খুলে দোয়া করি। একবার এক ঈদের সময় পাশের মসজিদের হুজুর আমাকে একটা শাড়ি দিয়েছিলো আর সেমাই,গোস্ত খেতে দিয়েছিলো। না, রাস্তায় খাবার ছুড়ে দেয়নি কুকুরের মত। সে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তাদের বাড়িতে। টিনশেডে থাকে তারা। পাশে বসিয়ে আমাকে যত্ন করে খাওয়ালো। এ কথা কখনও আমি ভুলে যাব না। কখনও কখনও কেউ কেউ দু,পাচ টাকা হাতে গুজে দেয়। রমজানে কেউ কেউ ১০০ টাকাও দিয়েছে। কিন্তু ওতে কি আর চলে ! তবে বেশীরভাগ লোক ঘৃণায় কাছে আসেনা। আমি দোকানে টাকা দিয়ে বলি খাবার দেন। তারা আমাকে দূরে গিয়ে দাড়াতে বলে এরপর তাদের মত করে কিছু দেয়। কখনও পয়সা ফেরত দেয়,কখনও দেয়না। আমি গোসল করিনা তেমন,কারন সে ব্যবস্থা নেই। কয়েকবার রমনার লেকে নেমেছিলাম,কিন্তু গার্ড আমাকে উঠিয়ে দিয়েছে।
আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হল যৌবনকালের সেই ঘটনা। অপরিচ্ছন্ন কাপুড়ে,ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমি রাস্তার পাশে শুয়ে ছিলাম। গভীর রাতে কিছু যুবক আমাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে যায় পার্কের নির্জন স্থানে, ধর্ষন করে আমাকে ফেলে যায়, খেতেও দেয়নি ! এরপর পুরো ১০ মাস আমি ওদের পাপের বোঝা বহন করেছি। কিন্তু কখনই আমার পেটের সন্তানকে দোষারোপ করিনি,তাকে ভালোবেসেছিলাম অন্তর দিয়ে। তার পৃথিবীতে আগমনের প্রতিক্ষায় থাকতাম। আবার এটাও ভাবতাম তাকে খাওয়াবো কি ! আবার মনে হত, আল্লাহ খাওয়াবেন,যেভাবে আমাকে খাওয়ান। সন্তান পেটে আসার পর আমার ক্ষুধা বেড়ে গেল,সারাক্ষন অস্বস্তি লাগত। স্বস্তিতে থাকতে পারতাম না। শরীর বয়ে বেড়ানোর শক্তিও যেন নি:শ্বেষ হয়ে আসলো। তারপরও না মরে বেঁচে থাকলাম।
এরপর একদিন যখন আমার সন্তান প্রসবের সময় সমাগত হল, তখন দামী গাড়িতে করে এক মহিলা আসলো নিকাব পরে। আমাকে অনেক শান্তনা দিল। আমার শাড়ীর আচলে অনেকগুলো টাকা বেধে দিল। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমার হাসপাতালের সকল খরচ তারা দিবে বলল। জীবনে প্রথমবারের মত এরকম সুন্দর ভবনের ভেতর প্রবেশ করলাম। আমাকে কেউ কখনও কোনো শপিংমল,বড় সুন্দর বাড়ি,কোনো সুন্দর স্থপনাতে প্রবেশ করতে দেয়নি। প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হত, কিন্তু পরে এসে উপলব্ধী করেছি, আমার জায়গা ডাস্টবিনের আশপাশে,ফুটপাথে,ওখানে নয়। আমার এই বিশ্বাস আছে যে, আমার রব আমাকে জান্নাতে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে বলবেন, কোটি কোটি ফেরেশতা আমাকে অভিবাদন জানাবে, আজ যারা আমাকে তাদের মূল্যবান স্থাপনায় প্রবেশে বাঁধা দেয়, সেদিন ওদেরকে নির্মমভাবে জান্নাতে প্রবেশে বাঁধা দেওয়া হবে। আল্লাহর কথা মনে হলেই আমার ভেতর শক্তি তৈরী হয়, ক্ষুধা,রোগ ব্যাধী আমাকে দূর্বল করতে পারেনা। আমি যা খাই,যেখানে থাকি,যেভাবে জীবন ধারণ করি, তা যদি একদিনের জন্যে আপনারা করতেন, আপনাদেরকে হয়ত পুরো মাস হাসপাতালে কাটাতে হত। অথচ আমি এর ভেতর দিব্বি বেঁচে আছি।
আমি বিশাল হাসপাতালের সুন্দর মোলায়েম বিছানায় শুয়ে থাকলাম। সারা জীবনে কখনই আমি এরকম বিছানায় শুয়ে দেখিনি। আমার কল্পনায় জান্নাতের চেহারা এতটা চমৎকার ছিলোনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে স্থানটা অনেক অনেক বেশী ভালো। আমি মন থেকে সেই মহিলার জন্যে দোয়া করলাম, যিনি আমাকে এরকম হাসপাতালে এনেছেন। এরপর আমাকে আরেকটা ঘরে নেওয়া হল.....। আমার প্রসব বেদনায় আমি জ্ঞান হারালাম। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার আমাকে বললো তোমার মৃত বাচ্চা হয়েছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে গেলাম। তাদেরকে বললাম, আমার মরা বাচ্চাটাকে একবার দেখতে দাও। তারা বলল, বাচ্চা দেখলে তোমার খারাপ লাগত। আর তুমি পুরো একদিন অজ্ঞান ছিলে। আর এর ভেতর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম তোমার সন্তানের লাশ নিয়ে দাফন করেছে। আমি বললাম,সেখানে আমাকে নিয়ে চলো। কিন্তু এবার হাসপাতালের অন্য কয়েকটা কর্মচারী আর নেকাব পরা সেই মহিলার স্বামী,আরও কয়েকজন আমার সাথে দূর্ববহার করলো। আমাকে তারা কিছু পয়সা আর ওষুধ দিয়ে বের করে দিল। আমি পাগলের মত রাস্তায় হাটতে থাকলাম। আমি এখনও রাস্তায় আনমনে হাটতে থাকি। কতবার গাড়ির নীচে পড়তে গেছি, কিন্তু আমার মরণ হয়না, না রোগ আমাকে মারতে পারে,আর না রাস্তার যানবাহন মারতে পারে !
আমার ক্ষুদ্র জীবনের পুরোটাই না পাওয়ার বেদনা দ্বারা পরিপূর্ণ, অবশ্য আমি এটাও জানিনা আমার আসলে কি কি পাওয়ার কথা ছিলো। তবে আমি মনে করি আমি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি তো একটা সময়ের অপেক্ষায় ইহজীবনটা চরম অবজ্ঞায় বহন করে চলেছি। প্রবল ক্ষুধায় মাথায় রক্ত উঠে যায়, কিচ্ছু ভালো লাগেনা,তাই অশ্রাভ্য গালিও দেই। সেসময় কেবল গালি দিতেই ভালো লাগে কিন্তু ওটা আসলে গালি না, ওটা হল আপনাদের পাওনা বকেয়া,যা আমি পরিশোধ করি।
চরম ক্ষুধা,তৃষ্ণা নিয়ে আমি আমার এই জীবন অতিবাহিত করি। প্রভুর প্রতি কোনো অভিযোগ করিনা। মানুষ আমাকে দেখে দূরে সরে যায়, যেন আমার গায়ের দূর্গন্ধ তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব ! ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত,রোগ,শোকে জর্জরিত মানুষটাকে পাগলী,ডাইনী বলে ডাকে। কখনও বোঝার চেষ্টা করেনি, ওদের মতই আমার জন্ম হয়েছিলো। আমারও অধিকার আছে ওদের থেকে সুআচরণ পাবার, অথচ ওরাই হয়ত মসজিদের সামনের কাতারে গিয়ে নামাজ পড়ে,রমজানে রোজা রাখে। কি দূরাবস্থা মানুষের নৈতিকতা বোধের ! তোমাদের ছুড়ে ফেলা খাবারে জান্নাত কিনতে চাও !! তোমরা এতই চালাক, আল্লাহকেও ধোঁকা দিতে চাও ! মনে রেখো বুক ফাটা তৃষ্ণায় আমি ড্রেনের নোংড়া পানি পান করতে বাধ্য হই, আমাকে তোমার আশপাশে পাঠিয়ে আল্লাহ তোমাকে পরিক্ষা করেন। এখন তুমি তোমার মহা হিসাব নিকাশের জন্যে প্রস্তুত হও।
বিষয়: বিবিধ
১১৪১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অন্তর কেঁপে উঠলো
রব্বিগফির ওয়ারহাম..
মন্তব্য করতে লগইন করুন