নির্যাতিত এক জনপদের নাম জিনজিয়াং

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১১:৫৭:২৪ সকাল



২০০৯ সালে চীনের জিনজিয়াং (চায়না উচ্চারণ শিনজাং) এর রাজধানী উরুমকী(চায়না উচ্চারণ উরুমচী) তে হান চায়নিজ ও উইঘুর মুসলিমদের কিছু লোকের ভেতর বাজারে দোকানে কেনাকাটা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক হয় এবং সেখান থেকে হাতাহাতি। এরপর উভয়পক্ষের কিছু সদস্য কর্তৃক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ভেতর দুই জন উইঘুর মুসলিম মারা যায়, অন্য পক্ষেরও দু একজন আহত হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উইঘুর মুসলিমরা সংঘবদ্ধ হয়ে উরুমচীতে মিছিল বের করে প্রতিবাদ করে। উক্ত মিছিলের উপর চায়নিজ পুলিশ নির্লিপ্তভাবে ভারী গুলি বর্ষণ করে। বিবিসির গোপন তথ্য মতে ওই দিন প্রায় দুই শতাধীক মুসলিম নিহত হয়(বাস্তবে হাজারের উপর নিহত হয়)। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ১৯৭ জন নিহত হয় এবং ১৭২১জন আহত হয়। অনেক পূর্ব থেকেই পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের জায়গায় হান চায়নিজদের জোরপূর্বক বসতি স্থাপন চলছিলো,মুসলিমদের সম্পত্তি দখল করা হচ্ছিলো। এটা নিয়ে মুসলিমদের ক্ষোভ ছিলো দীর্ঘদিনের।

কিন্তু আসল বিষয় হল এই যে, এই ঘটনার সময় কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অল্প কিছু সংবাদ সংস্থা গোপনে ঝুঁকি নিয়ে কিছু সংবাদ সংগ্রহ করেছিলো এবং চিত্র ধারণ করেছিলো। ঘটনার সময় আমি চায়নার আরেক প্রান্তে পড়াশুনারত ছিলাম কিন্তু সেখানেও উক্ত ঘটনার রেশ টের পাওয়া যাচ্ছিলো।

হঠাৎ করেই চায়না সরকার ফেসবুক,ইউটিউব বন্ধ করে দেয়(উক্ত ঘটনার পর এখনও পর্যন্ত চায়নাতে ফেসবুক,ইউটিউব বন্ধ) । হান-উইঘুর নিয়ে যেকোনো সংবাদ প্রচারের উপর চরম নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হাজারে হাজারে চায়নিজ আর্মী পুরো জিনজিয়াং এ মজুদ করা হয়। মসজিদ,মাদ্রাসা পুলিশ ও আর্মীরা নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। হাজার হাজার মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়। হান ও উইঘুরদের ওই দ্বন্দে দোষ ছিলো হানদের, মারা গেল উইঘুর মুসলিম এবং নির্যাতনও করা হল মুসলিমদের। চায়নিজ টিভি ঘুরে ফিরে বারবার মাত্র ২/৩টি ঘটনা দেখাচ্ছিলো আর তা হল হান চায়নিজ কয়েকজন লোক বর্ণনা করছে, কিভাবে একজন উইঘুর মুসলিম দা নিয়ে আক্রমন করেছিলো, কিভাবে তাকে ও অন্য আরেকজনকে মেরেছিলো। এর বেশী কিছু তারা দেখাতে সক্ষম হয়নি। চায়নিজ টিভি চ্যানেল মুসলিমদের পক্ষে একটা কথাও প্রচার করেনি, তাদের সাক্ষাৎকারও নেয়নি। চায়না সরকার পরিকল্পিতভাবে তার জনতার অমুসলিম অংশকে মুসলিমদের বিপক্ষে দাড় করানোর চেষ্টা করে। তাদের মিডিয়াগুলোর অপপ্রচারে আমার এ ধারনা প্রবল হয়েছিলো। পরবর্তীতে চায়নিজ সরকার জিনজিয়াংয়ে বিভৎস্যভাবে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করে এবং তা অব্যাহত রাখে।

প্রায় ৪০ বছর পূর্বে চায়নিজ সরকার স্বীকার করেছিলো যে চায়নাতে মুসলিমদের সংখ্যা ৪কোটির বেশী। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল ২০০৬ সালে চায়নিজ সরকার ঘোষণা করে মুসলিমদের সংখ্যা সোয়া এক কোটি। যদিও চায়নাতে এক সন্তান নীতি বলবৎ কিন্তু জিনজিয়াংয়ে অনেক মুসলিমেরই একাধিক সন্তান রয়েছে। সে হিসেবে বর্তমান মুসলিম সংখ্যা ৬কোটির উপরেই যাওয়ার কথা(চায়নিজ মুসলিমদের ভাষ্যমতে মুসলিমদের সংখ্যা সেখানে ৮কোটির উপরে)।

উইঘুররা হল মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তূর্কী বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী। এদের ইতিহাস প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরোনো। চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করে। চীনের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৫টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে দশটি গোষ্ঠীই প্রধানত সুন্নি মুসলিম। তার মধ্যে উইঘুর, হুই, কানসু মুসলিম সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য।

চীনে ইসলামের ইতিহাস বহু পুরোনো। প্রশিদ্ধ সাহাবি সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রাঃ) , হযরত সাইদ(সাঃ), ওহাব ইবনে আবি কাবাসা (রাঃ) এবং আরও কিছু সাহাবীদের মাধ্যমে ৬৫০ সনে সাম্রাট গাওজংগের শাসনামলে ইসলামের সাথে চিনের প্রথম পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে সিল্ক রোডের বদৌলতে দিন-দিন ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটে। মুসলীম ব্যবসায়ীদের কারনে সিল্ক রোডের আশপাশে বিপূল সংখ্যক লোক ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। চীনের মোট মুসলিমের অর্ধেকই হল উইঘুর মুসলিম।

উইঘুররা প্রায ৪ হাজার বছর পূর্বেকার একটি জাতিগোষ্ঠী। ১৩শত বছরের বেশী সময় ধরে তাদের বর্ণমালাও আরবী। মূলত, এরা মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিনস্ত স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে।মূলত, ৯৬ হিজরী সনে 'উমাইয়া' বংশীয় শাসক ওয়ালীদ বিন আবদুল মালিকের যুগে বিখ্যাত মুসলিম বীর সেনাপতি কুতাইবাহ বিন মুসলিমের হাতে পূর্ব তুর্কিস্তানের ঐতিহাসিক শহর 'কাশগড়' বিজয় হয়। পরে মধ্যযুগে তাং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকেই সেখানে ইসলাম ও আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে। স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সিল্ক রোড দিয়ে বানিজ্যের জন্য চিনে আসা আরব মুসলিম ব্যাসায়ীর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে পরে উইঘুরের পুরো জনগোষ্ঠীই ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হয়।

১৮৮৩ সালের আগ পর্যন্ত উইঘুররা তাদের নিজ দেশ ইসলামি সালতানাতের অধিনে পূর্ব তুর্কিস্তানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিলো। বিপত্তি ঘটে ১৮৮৪ সালে। চিনা কিং রাজত্বের প্রভাবশালী জেনারেল ঝু ঝাংয়ের নেতৃত্বে পূর্ব তুর্কিস্তানকে চিনারা নিজের দখলে নিয়ে নেয়। এবং এর নাম পালটে জিনজিয়াং রাখা হয়। যার অর্থ 'নতুন ভূখণ্ড'। পরে ১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে পুরদস্তুর চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দু'বার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে তারা মাও সেতুংয়ের চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হন, আর পূর্ব তুর্কিস্তানে কমিউনিস্ট আশ্রিত উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে।

জিনজিয়াং এর ভৌগলিক গুরুত্ব অপরিসীম, এই প্রদেশ চিনকে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করেছে। চিনের উচ্চাভিলাষী ট্রিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড (নতুন সিল্ক রোড) জিনজিয়াং প্রদেশের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ তেল, গ্যাস, তামা, হিরা, কয়লা, সুনায় প্রদেশটি ভরপুর। চিনের মোট জাতীয় চাহিদার ৮০% এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে পূরণ হয়।

এই কারণে চিন জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে নিজের করতলে রাখতে চাইছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চিন এখানে জুলুমের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। ৩৯ টি বন্দী শিবিরে ও অসংখ্য ছোট-বড় ক্যাম্পে ১০ লক্ষেরও অধিক স্থানীয় উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখে অসহনীয় মাত্রায় বর্বরোচীত নির্যাতন চালাচ্ছে। সামান্য কারনে আটক করে তারা অমানুসিক নির্যাতন করছে। মুসলিমদের সাধারণ ইবাদতেও তারা বাধা দিচ্ছে। একসাথে অনেক মানুষ জামাতবদ্ধভাবে নামাজ আদায়েও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। গৃহে কুরআনের কপি রাখার কারনেও গ্রেফতার,নির্যাতন চলছে। রোজার মত ইবাদতেও কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কখনও জোর পূর্বক দাড়ী কামাতে বাধ্য করছে। সরকার চাপ প্রয়োগ করে তাদেরকে আরবীর বদলে চায়নিজ বর্ণমালার চর্চায় বাধ্য করছে। মুসলিমদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস করতে তারা উঠে পড়ে লেগেছে।

চায়নার পূর্বের শাসকগনের ভেতর কেউ কেউ ইসলামের ব্যাপারে যথেষ্ট সহনীয় ছিলো,সহযোগীতাও করেছে, কিন্তু কম্যুনিস্ট সরকার আসার পর ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে মুসলিম নিধনে তৎপর হয়ে উঠেছে। আর তারা বিশ্বকে এ অত্যাচার নির্যাতনের সংবাদগুলো জানতে দিতে চায়না। আমাদের দায়িত্ব সারা বিশ্বকে এ তথ্য জানিয়ে দেওয়া,প্রচার করা এবং মজলুম চায়নিজ মুসলিমদের পক্ষ অবলম্বন করা। আল্লাহ মুসলিমদের সহায় হোন !

বিষয়: বিবিধ

৭৩৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386400
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বিকাল ০৫:৪১
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

৭১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File