কর্ণেল রুস্তম !
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ০১:৪৩:০২ দুপুর
--------------
: কিরে...কি নাম তোর ?
পাশ থেকে: কর্ণেল রুস্তম !
:বাড়ী কোথায় ?
পাশ থেকে: নেই,,,
:হুম,,, থাকিস কোথায় ?
পাশ থেকে: সবখানেই,,,
:করিস কি ?
: কালি করি,,,
: কি, জুতো ?
:না, কালি করা মানে বুঝেন না ?
: না, বুঝিনা,,বুঝিয়ে বল না শুনি....
: এত বড় মানুষ তাও জানেন না !
: আরে না, ভেঙ্গেচুরে বলনা শুনি...
:বলা যাবেনা....
:ওরে ইচড়ে পাকা,,,, আচ্ছা আমি প্রশ্ন করছি,,,কর্ণেল সাহেবকে আর তুই উত্তর দিচ্ছিস ক্যান রে ভাংতী পয়সা?? তুই কি সাগরেদ নাকি ??
:না, আমি ছোটভাই,
:ও নিজেই তো ছোট,,,ওর আবার ছোটভাই ??
:হুম...
এতক্ষনে নিরবতা ভেঙ্গে কর্ণেল সাহেব বলে উঠলেন,,আপনি যান তো,,এখন বিজি আছি...
:ওরে বাবা তুই দেখী খুব বিজি....তা করছিস টা কি শুনি...? খাতায় আকিবুকি করছিস,,,পড়াশুনা পারিস কিছু ??
:হুমম,,, পারি কিছু আপনি যান এখন,,,, পান্ডারা আসবে...
:ওরে বাবা তারা আবার কারা ?? তু্ই জানিস পান্ডা কত দামী প্রানী,,,দুনিয়ায় খুব বেশী পিছ নেই কিন্তু....আর কতজন পান্ডা আসবে বল ?
:ধুর ! আপনি বিরক্ত করেন,,,যান তো....ওরা আসবে ওদের আজ ডিউটি ভাগ করে দেব...
: আচ্ছা তুই বিরক্ত হোস আর যাই হোস,,আমি এই বসলাম,,,আসুক তোর পান্ডারা,,,ওদের সাথে ছবি তুলবো...
খানিক বাদেই ১০ জন, ১০-১৩ বছরের বাচ্চা এসে হাজির। মজার ব্যপার হল কেউ বসলো না। সারি বেঁধে দাড়িয়ে থাকলো। কর্ণেল উঠে দাড়ালো এবং তাদের সামনে দাড়ালো। কি অসাধারণ আনুগত্যে ১০টা ছেলে ঠাই দাড়িয়ে চুপ করে রইলো কোনো আদেশের। অবাক হলাম। কর্ণেল তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। কে কোন এলাকায় কি কি টোকাবে। কোথায় বিক্রী করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। চুরি করা যাবেনা। মিথ্যা বললে মাইর। জীবন গেলেও মিথ্যা বলবে না পণ করছে। কথা দিয়ে কথা রাখবে। সততা,আমানতদারিত্ব সম্পর্কে কর্ণেল যা বলছে তা দেশের কোনো বুদ্ধিজীবীও কাওকে এভাবে উপদেশ দেয়নি। সে বললো, তোরা যদি সততা,ন্যায় নীতির ক্ষেত্রে অটল থাকিস, তাহলে লোকে তোদের বিশ্বাস করবে, তখন রাস্তায়,রেল স্টেশনে দাড়িয়ে যখন কিছু বিক্রী করবি, মানুষ তোদের জিনিস কিনবে। যদি কখনও দোকান করতে পারিস, মানুষ তোদের থেকেই কিনবে। তোরা জীবনে যে যেখানেই থাকিস না কেন, নীতির প্রশ্নে অটল থাকলে মানুষ তোদের বিশ্বাস করবেই। তোরা হবি প্রকৃত নেতা। সে আরো বললো, তোরা কোনো রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যাবিনা, একদিন তোরা বড় হবি,তখন নিজেরা বিবেচনা করতে পরবি। পয়সা দিলেও যাবিনা। নিজে উপার্জন করে খাবি। নিজেকে পয়সার কাছে বিক্রী হতে দিবিনা। আর রোজগারের থেকে প্রতি শুক্রবার ৫০ টাকা আমার হাতে দিবি, এটা গরিবের ফান্ড। আমি দেব ১০০ করে। আমি প্রতি মাসে এক একজন গরিবকে পুঁজি দিয়ে ছোট ব্যবসা ধরায় দেব।
আমি এতক্ষন বসে ছিলাম। তারপর উঠে দাড়ালাম। আমার মুখ হা হয়ে আছে। কি বলব বুঝতে পারছি না। ১৫ বছরের একটা ছেলে এত বাস্তব জ্ঞান রাখে ! এত সৎ,এত যোগ্য !! এতক্ষনে বুঝলাম কেন ওকে প্রশ্ন করলে ওর পাশে থাকা ১০ বছরের ছেলেটা পটপট করে উত্তর দেয়। সবই নিখাদ ভালোবাসা...।
কর্ণেল রুস্তম জানেনা ওর বাপ মা কারা। এক ডাস্টবিনে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো এক মুদী দোকানের কর্মচারী। তারও ইহজগতে কেউ ছিলোনা। নিজেরই অনেক কষ্টে চলত, কিন্তু তবুও কর্ণেলের দায়িত্ব ভুলে যায়নি। রুস্তমের বয়স যখন ১০, তখন ওই লোক মারা যায়। এরপর থেকে কর্ণেল রাস্তায়। যেখানে রাত সেখানেই কাইত। তবে বেশীরভাগ সময় কমলাপুর রেল স্টেশনে থাকে। সম্ভবত কোনো ধনী ও অভিজাত পরিবারের কেউ লোক লজ্জার ভয়ে পাপের ফসলটা ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। রুস্তমের মেধা,ব্যচনভঙ্গী জানান দেয় তার ভেতর আভিজাত্য আছে, যাকে হত্যা করা যায়নি। বাচ্চাগুলো কেবল এর কথা মেনে চলে তাই নয়, ওরা অন্যদেরকেও এভাবে শেখায়। ওর ব্যক্তিত্ব,আভিজাত্য আর অনুসারীদের উপর প্রভাব দেখে লোকে ওর নাম দিয়েছে কর্ণেল। একেবারে আর্মী অফিসারের মতই আচরণ করে, কিন্তু ইনসাফ কি তা সে বোঝে। এত অল্প বয়সে এতকিছু শিখে ফেলা সত্যিই বিশ্ময়কর ! আমার এত ভালো লাগলো !
কর্ণেল: ঠিক আছে তোরা এখন যা, শুক্রবারে দেখা হবে আবার। ....ও,, চা খাবি নাকি তোরা ?
বললাম: না, ওরা চা খাবেনা,,, কর্ণেল ! কিছু মনে না করলে চল আমরা কোথাও গিয়ে খাই ? কথার ভেতর "কিছু মনে না করলে" কথাটা আমাকে উল্লেখ করতেই হলো,যদিও রাস্তার মলিন পোষাকে থাকা কোনো টোকাইকে এভাবে কেউ সাধারণত বলেনা। কিন্তু তার যে পরিচয় পেলাম,,,তাতে আমার ভোল পাল্টাতে হল...
: সে বলল, না, সমস্যা নেই। আপনি চা খাইলে আসেন...
:আহ কি আতিথেয়তা,,কিভাবে শিখলো সে এসব ! আমি মনে মনে ওর প্রতি প্রবল দূর্বল হয়ে উঠলাম, কিন্তু প্রকাশ করলাম না, কারন এতে অনেক সময় উভয়ের জন্যেই অকল্যান হয়। আমি বললাম, আজ আমরা সকলেই ফুল প্লেট বিরিয়ানী খাব। আর তোরা আমার ছোটভাই। তোদের কাজে ,কথায় আমি খুব খুশী। কি যাবিনা আমার সাথে ?
কর্ণেল: এই চল, ভাই আজ খাওয়াবে। আচ্ছা, আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কালি মানে কি। বলছি শোনেন। কালিকরা মানে হল পরিমাপ করা। এটা আমাদের একটা শব্দ। এরকম অনেক শব্দ আমরা ব্যবহার করি। এতে বক্তব্য আরও বলিষ্ঠ হয়। কোনো এলাকা জরিপ করে আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নেই, ওই জরিপটাই হল কালি করা...বুঝলেন ?
:হাহাহা করে হেসে বললাম,,,,কি জিনিসরে তুই,,, এত কিছু পারিস....তুই তো দুনিয়া চালাবি রে.....। প্রত্যেক শুক্রবারে এখন থেকে আমরা একবেলা এক সাথে খাব। তোরা বলবি কোথায় খাব, আমি খাওয়াব। আর তোরা যে কাজ করিস, তাতে আমি খুব খুশী। কিন্তু শোন দুনিয়ায় কেউ তোদের না থাকলেও কে আছে জানিস ?
কর্ণেল বলে উঠলো, আমাদের আল্লাহ আছে, উনিই আমাদের অভিভাবক ! তাকে ডেকে তো নিরাশ হইনা। আমরা কেবল আল্লাহকেই পরোয়া করি.....
১৩ জনের একটি দল বিখ্যাত এক বিরিয়ানীর রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করল। ওরা আমাকে সামনে এগিয়ে দিল। আমি সামনে গিয়েও যেন পেছন ফিরে কর্ণেলকে একটা মিলিটারী স্যালুট দিলাম ! মন প্রশান্ত হল। স্যালুট কর্ণেল !!
বিষয়: বিবিধ
৬৭২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কর্ণেল সাহেব সামনে আরও এগিয়ে যাক দোয়া রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন