সাহেব আলী
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯, ০২:৪৪:০৩ দুপুর
----------------
:গরুগুলোকে খেতে দিয়েছিস ঠিকমত সাহেব আলী ?
:জি মহাজন, ওরা এখন জাবর কাটছে।
: পূব মাঠের জমিটায় ভালো করে লাঙ্গল চালানো হয়নি, কাল আরেকবার লাঙ্গল দিস, আর বড় বড় মাটির চাংগুলো ভেঙ্গে ফেলিস
:জি মহাজন, গায়ে ভালো বল পাচ্ছিলাম না, নয়ত আজই করতাম।
: গোয়াল ঘর পরিষ্কার করেছিলি রে ?
:জি মহাজন, ও তো গতকালই করেছি।
: বাইরের বাড়িতে বালি ফেলা আছে কিছু, ওগুলো ভেতরে আনতে হবে। এক ফাঁকে ঝুড়িতে করে ওপাশের দেওয়ারে পাশে এনে রাখিস।
:ও তো মেলা মহাজন...
:আহ, মেলা তা বটেই,,, একবারে করার দরকার নেই, ধীরে সুস্তে করিস ক্ষন....ঠিক আছে ?
:জি মহাজন আপনার যা মর্জী !
: দুপুরে খাওয়ার পর একবার বাজারে যাস তো সাহেব আলী, তোর চাচীর জন্যে পান আনতে মনে ছিলোনা। আর হ্যা ফেরার পথে রফিকুলের দোকান থেকে হাকিমপুরী জর্দা নিয়ে আসিস, খাটি জিনিস সবখানে আবার পাওয়া যায়না। টাকা চাইলে বলিস, শুক্কুর বারে দেব।
: জি মহাজন।
: আচ্ছা ঠিক আছে যা এখন,,,,,,আর হ্যা, পুকুরের মাছের খাবার দেওয়া হয়েছে ?
: না মহাজন,,,
:বলিস কি রে,,,,,নাহ,,তোকে দিয়ে একটা কাজও ঠিকঠাকভাবে হয়না,,,, সকালে বলে গেলাম, তাও করলিনে,,,,আগে যা, মাছের খাবার দেওয়া জরুরী....মাছ মরলে খুব লোকসান হয়ে যাবে রে। আর ও....ওই পুকুরের উপরের সিমের গাছ থেকে এক সাঝের মত সিম তুলে আনিস গামছায় বেধে। মায়া মাছ দিয়ে তোর চাচী রান্না করবে।
:জি মহাজন।
সাহেব আলী পাশের গ্রামের এক গরিব দিনমজুরের ছেলে। দারিদ্রের কষাঘাতে লেখাপড়া করা হয়নি। বাপে খেতেও দিতে পারত না তেমন। বছরের অর্ধেক সময়ই তার বাপের কোনো কাজ থাকত না। সে সময়টা ওদের চরম অভাবে কাটত। সাহেব আলীর মা বাগানে বাগানে ঘুরে একটু কচু,শাকপাতা খুঁজে আনত। সস্তায় কেনা খুদের চালের ভাতের সাথে ওটা দিয়ে চালাতো তারা।........কত কথা মনে পড়ে সাহেবের।...... বাজারে কাঠাল বিক্রী করতে গিয়ে বসে ছিলো অনেকক্ষন। কোনো ক্রেতা কিনছিলো না তার কাঠাল। এমন সময় জমির শেইখ এসে তার সবগুলো কাঠাল কিনে নিল। সেই কাঠাল পৌঁছে দিতে জমির শেখের বাড়িতে গিয়ে আর ফেরা হলনা সাহেব আলীর। তার একজন লোক দরকার মাঠ ও বাড়ির টুকটাক কাজের জন্যে। সাহেব আলীরও একটা কাজ দরকার। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্তের কাছে থাকলে তার অভাব দূর হবে ভেবেই রাজি হয়ে যায় সাহেব আলী। ৩ বেলা খাওয়াসহ মাসে ৫০০ টাকা মাইনে, খারাপ না। সাহেব আলীর মনে আনন্দের ঝিলিক দেয়। বাপ মরার পর মাকে কখনই একটা শাড়ী কিনে দিতে পারেনি। মাসের মাইনের টাকায় মায়ের শাড়ী আগে। কাপুড় পট্টির সাইদূরের দোকানে কতদিন সে নীল পেড়ে শাড়ী দেখেছে। ১২০ টাকা দাম, ভয়ে কখনও ধরতেও পারেনি। এবার ওটা সে কিনবেই। তার বৌয়ের জন্যেও একটা শাড়ী কিনতে হবে, কিন্তু সেটা হবে পরের মাসে। বাচ্চাটার একটা প্যান্ট,জামা....ওহ কত স্বপ্ন উকি দেয় সাহেব আলীর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ! কিন্তু ঘটনা ঠিক সেভাবে ঘটলো না। মহাজন জমীর শেইখ তার বেতনের অর্ধেক জমা রাখে, বাকী অর্ধেক কোনো মাসে দেয়,কোনো মাসে দেয়না। অনেক অনুনয় বিনয় করে বেতন নিতে হয়। পাশের গ্রামে থাকা মা,বৌ,ছেলে অনেক কষ্টে থাকে। মাস শেষ হলেই তারা হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। বেতনের টাকায় তাদের চলেনা,তবুও একটা আশা কাজ করে। ওদিকে মহাজন স্বপ্ন দেখায় একদিন তুই একসাথে অনেক টাকা পাবি। পাকা ঘর তুলবি। তোর এক খন্ড জমিও হবে। লোভে লোভে সাহেব আলী তার শরীরের সবটুকু শক্তি শেষ করে দেয় কাজে। ৩ জনের কাজ সে একাই করে। তবে তার অভিযোগও তেমন নেই। যদিও চাকুরীটা সুবিধার না, তারপরও মোটে না থাকার চেয়ে কিছু থাকা ভালো। আর মহাজন মুখে খুব সুআচরণ করে। ধমক দেয়না তেমন। তবে খুব ধুরন্দর মানুষ,তা সে বুঝতে পারে। কৌশলে কাজ করিয়ে নেয়।
সাহেব আলী খুব কর্মঠ যুবক। সবকাজ খুব ভালোভাবে করে। সাহেব আলী আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই মহাজন একজন কর্মচারীকে ছাটাই করে। কারন সাহেব আলী একাই অনেকজনের কাজ করতে পারে। সপ্তায় ১দিন ওর ছুটি, সে সময় সাহেব আলী হাটতে হাটতে নিজ গ্রামে যায়। আবার মাঝে মাঝে তার বৌও ছেলেটাকে সাথে নিয়ে মহাজনের বাড়িতে আসে। মহাজন বেশ খাতিরই করে। সাহেব আলীকে সে হারাতে চায়না, আবার নায্য পাওনাও দিতে চায় না। এভাবে সাহেব আলীর জীবন চলতে থাকে।
=======================
দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসলো প্রায়। ছেলেটা বায়না ধরেছে লাল শার্ট কিনে দিতে হবে। মায়ের শাড়ীটার কয়েক জাগায় তালি দেওয়া, তারপরও সে বলে বৌমার একটা শাড়ী কিনে দিস, ওর শাড়ী নেই। আমার তো আর বয়স নেই, ওর দরকার। অন্তত ছেলেটার একটা জামা কিনে দিস সাহেব। সাহেব আলী মাথা নাড়ায়, কিছু বলেনা। জমীর শেখের পেটের ভেতর থেকে টাকা বের করা কত কষ্টের তা সে জানে। টাকার কথা বললেই নানান প্যাচের গল্প শুরু করে। নানান অভাব অভিযোগ তুলে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে,যেন মহাজনের অবস্থা সাহেবের চাইতেও করুন। আর বিশেষ উপলক্ষ্য আসলে মহাজন আরও বেশী কষা হয়ে ওঠে। সাহেব আলী স্বপ্নের জন্যেই বেঁচে থাকে। ঈদের মাত্র ১ সপ্তাহ বাকী।
:মহাজন, আপনাকে তো সব বলেছি, সংসার চলেনা। কিছু টাকা বাড়ায় দেন।
: আহা সাহেব,, কেন বুঝিস না, এই মাসেই কতগুলো উটকো খরচ এসে জমা হল, এটা কি জানতাম ! আর আমারও তো পারার দরকার, একটু বোঝার চেষ্টা কররে সাহেব..... আর তোর টাকা তো আর মারা যাচ্ছেনা, কড়ায় গন্ডায় সব শোধ করে দেব দেখিস....সবুরে মেওয়া ফলে। অপেক্ষা কর। তোর সুদিন আসছে,,,,তখন দালান বাড়িতে থাকবি, নিজের জমি হবে, পুকুর হবে,,,গরু কিনবি....তুই রাজা বাদশা হয়ে যাবিরে....!
:মহাজন, আমি রাজা বাদশাহ হব না, আপনি আর কিছু টাকা দেন, বৌয়ের শাড়ী ছিড়ে গেছে। আমি তো আপনার পুরোনো লুঙ্গী পরি, আমার কথা বাদ দিলাম, কিন্তু আমার ছোট ছেলেটা ! ওকে যে বলেছিলাম, এবার ঈদে লাল জামা কিনে দেব ,, তার কি হবে ?
:আহ সাহেব তুই বড় বিরক্ত করিস, বলছি না, এখন টাকা হাতে নেই,, আচ্ছা যা, কথা দিলাম পরের মাসে কিছু বাড়ায় দেব,,এখন যা তো,,,আর গরুর গোসল করাইছিস ? আহা গরুগুলোর গা এরকম খসখসে দেখ্যায় ক্যান ? উত্তর মাঠের জমিটার কি খবর বলতো সাহেব ? সেচ কি ঠিকঠাক হয়েছে ? ওরা আবার পানি চুরি করে,,,, আল্লাহর ভয় নেই মনে,,, রোজ হাশরে জবাব দিতে হবে বুঝলি। অন্যকে ঠকালে নিজেকে ঠকতে হয়। বছল শেষে টাকা ঠিকই নিয়ে যাকে কিন্তু পানির হিস্যা ঠিকঠাক দেবেনা,,,,প্রতারক সব !
সাহেব আলী জানে তার আর কথা বলার কোনো জো নেই। মহাজনের থেকে অল্প কিছু টাকা নিয়ে বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে। যাবার আগে বাজার থেকে ছেলের জন্যে দারুন একটা জামা কিনে নিল সে। বেশ মানাবে তার ছেলেকে। গরিব হলে কি হবে, ছেলে দেখতে তার রাজপুত্র। সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছলো সাহেব। ছেলে লাল জামা পেয়ে তো আনন্দে আত্মহারা।
সাহেব আলীর মা ডিম,নারকেল বেচা কিছু টাকা দিল সাহেবের হাতে, বলল বৌয়ের একটা শাড়ী কিনে আন। সাহেব না করা সত্ত্বেও মা জোর করে দিল। সাহেব শাড়ী কিনতে গেল বাজারে।
---------------------------------------------------------------
ঈদের দিন , সাহেব আলীর বাড়িতে গোস্ত রান্না হয়নি। অল্প সেমাই রান্না করছে তার মা। ছেলে খুব খুশী তার নতুন জামা হয়েছে। বৌটাও খুশি কিন্তু শাশুড়ীর পরনের কাপুড়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় শাড়ীটা পরতে পারেনি। সাহেব এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে ঈদের মাঠে গেল। বিশাল ঈদ গা মাঠ। সেটা আবার মহাজনের গ্রামের কাছে। নামাজ শেষে মহাজনের সাথে সাহেব আলীর দেখা। মহাজন আজ কোলাকুলি করল। বাচ্চার মাথায় হাত দিয়ে আদরও করল। এরপর মহাজন বলল, চল সাহেব আমাদের বাড়ি চল, ভালোমন্দ কিছু খাবি চল।
মহাজনের কথা ফেলতে পারলো না সাহেব, তাছাড়া বাচ্চাটাও কিছু ভালো খেতে পারবে আজ। সাহেব মহাজনের পেছন পেছন তার বাড়িতে গেল। কিন্তু ভেতরে গিয়ে সাহেবের গলা আটকে গেল। বাড়িতে তার মা,বৌ ভালো খেতে পাবেনা, সে কিভাবে এখানে খাবার খাবে ! মহাজনের স্ত্রী বাচ্চাটাকে ভেতরে নিয়ে গেল খাওয়াতে। সাহেব ঠাই দাড়িয়ে থাকল। বললো তার পেট ভরা।
বেশ কিছুক্ষন পর সাহেব আলীর ছোট্ট ছেলেটা হাসিখুশী মুখ নিয়ে বের হয়ে আসলো। বাপের কাছে এসে বলল, বাবা বাবা দ্যাখো কি দিয়েছে.....। বাবাকে একটা কাগজ দিল। সাহেব খুলে দ্যাখে ৫০টাকার একটা নোট। জিজ্ঞেস করল, কে দিয়েছে ? জবাবে বলল, ওই যে উনি, যে নিয়ে গেল। সাহেব বুঝলো মহাজনের স্ত্রী দিয়েছে টাকাটা। এটা যে আজ সাহেবের বড় দরকার ! সাহেব ছেলের ঈদ সালামীর টাকাটা পকেটে ভরে বাজারের দিকে চলল। কিছু গোস্ত হবে এ টাকায়। আজ সে বাড়ির সকলকে নিয়ে গোস্ত খাবে ।
বিষয়: বিবিধ
৬৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন